কোলাহলের শহরগুলো এখন ঘুমের ছুটিতে

করোনা আতঙ্কে নিউইয়র্কের রাস্তা - সংগৃহীত

  • সাইমা আকন্দ
  • ০৬ এপ্রিল ২০২০, ১৪:০৩

সারা পৃথিবীতে যেন নেমে এসেছে অন্ধকার। করোনা ভাইরাস আতঙ্কে মানুষ লুকিয়েছে ঘরের ভেতর। হারিয়ে গেছে বাইরের কোলাহল। পৃথিবীর যে শহরগুলো রাত জেগে থাকতো, সেগুলোও এখন ঘুমের ছুটিতে। ধরা যাক ব্যস্ততম শহর নিউইয়র্কের কথাই। পৃথিবীর রাজধানী এই শহরটির আরেক নাম সদাজাগ্রত শহর। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারিতে সেই নিউইয়র্কও এখন জেগে নেই। তন্দ্রায় ঢুলে আছে।

গত ১৬ মার্চ থেকে নিউইয়র্কবাসী ঘরবন্দী। খুব দরকার না হলে শহরের লোকেদের বাইরে আসা নিষেধ। রাত আটটার পর রেস্টুরেন্ট, বার, ক্যাফে বন্ধ। সিনেমা হল, থিয়েটারের সামনের সড়কগুলোও এখন শোকাচ্ছন্ন।

খুব দরকারে যারা বের হচ্ছেন, তারা অন্য মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে চলছেন। কোনোরকম দরকার শেষ করেই সেঁধিয়ে যাচ্ছেন বাড়িতে। ঘরের ভেতর সঙ্গ দিচ্ছেন পরিবারকে। সেই সঙ্গটাকে উপভোগ্য করতে চাইলেও হয়ে উঠছে না। বাইরের দুনিয়ার শঙ্কা আর উদ্বেগ ঘিরে ধরছে তাদের। মৃত্যুর সংখ্যা যতই বাড়ছে, নিউইয়র্ক ততই পরিণত হচ্ছে বিরান শহরে।

ঘুমের ছুটিতে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের জেগে থাকা আরেক শহর লস অ্যাঞ্জেলস। এই ঘুম ‘সুখনিদ্রা’ নয়। ঘুমের ভেতর থেকে থেকে দুঃস্বপ্ন দেখছেন স্থানীয়রা। গোটা শহর এখন স্তব্ধ। কেউ বাইরে থেকে আসছে না। কারো বাইরে যাওয়ারও সুযোগ নেই। লস অ্যাঞ্জেলস থেকে ১৪৪ কিলোমিটার দূরে একটি মরুভ’মিতে অলস ঘুমুচ্ছে কয়েকশত বিমান।

গত ২৭ মার্চ লস অ্যাঞ্চেলস বন্দরে ভীড়েছে সবচেয়ে বড় মার্কিন ভাসমান হাসপাতাল ‘ইউএসএনএস মারসি’। ভাসমান এই হাসপাতালে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হবে। যতদিন জাহাজ বন্দরে থাকবে, এতে কর্মরত নারী-পুরুষের জাহাজের ভেতরেই থাকবেন। করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হবে বিশেষ সতর্কতায়।

লস অ্যাঞ্জেলসের বাসিন্দাদের আরো দুই মাস গৃহবন্দী থাকতে হবে বলে সতর্ক করেছেন শহরটির মেয়র অ্যারিক গারসেট্টি। পরিস্থিতির ব্যাপারে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে নাগরিকদের ঝুঁকির মুখে ঠেলতে চান না এই মেয়র। মিথ্যা আশ্বাস দিলে মানুষ স্বাভাবিক কাজ করতে শুরু করবে। এতে ক্ষতি হবে সবার।

মেয়রের স্পষ্ট ভাষণকে বাসিন্দারা ইতিবাচক হিসেবেই নিয়েছেন। তারা ঘরে বন্দি থেকেই প্রহর গুণছেন। আশায় আছেন, একদিন লস অ্যাঞ্জেলস জেগে উঠবে আগের মতো।

ঘুমিয়ে আছে বৃটেনের রাজধানী লন্ডন। শহরটির ছবি এখন থমকে যাওয়ার মতো। এক নজরে দেখলে মনে হতে পারে পৃথিবীর প্রাচীন কোনো শহর এটি। একসময় লোকের বসতি ছিলো। এখন এই শহর পরিত্যক্ত, ভ’তুড়ে।

খুব দরকারে কেউ সড়কে বের হলে তাদের গা শিউড়ে উঠছে। বৃটেনের প্রিন্স, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর লন্ডনবাসী সন্ত্রস্ত। আগের লন্ডনের সঙ্গে গত কয়েক সপ্তাহের শহরটির আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এখন পাখির চোখে দেখলে শহরটিকে ভ’তদের রাজধানী বলেই মনে হবে।

আরেক ব্যস্ততম শহর টোকিও। জাপান সা¤্রাজ্যের এই রাজধানী ব্যস্ত ছিলো অলিম্পিক আয়োজন নিয়ে। প্রযুক্তির ভেলকি দেখিয়ে কি করে গোটা বিশ্বকে চমকে দেওয়া যায়, সেই প্রস্তুতি পাকাপাকি ছিলো টোকিওর। কিন্তু এর মধ্যে শুরু হয়ে যায় বৈশ্বিক মহামারি। তবুও জাপান অপেক্ষায় ছিলো, অলিম্পিক আয়োজনের কাজ এগিয়ে নিচ্ছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে হয় তাদের।

এক বছর পিছিয়ে দেওয়া হয় ‘টোকিও অলিম্পিক’। এতে আশাহত হন ঘনবসতির এই শহরের বাসিন্দারা। কিন্তু বৈশ্বিক পরিস্থিতি মেনে নিতেই হবে। এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার দিকে মন দেয় জাপান সরকার। তবে টোকিওর ব্যস্ততা আর মানুষের কোলাহল কমাতে ব্যর্থ হয়। শেষে শহরটিতে নেমে আসে ঘন তুষার। সরকারের আহ্বানে সাড়া না দিলেও তুষারপাতে ঘরে সেঁধিয়ে যায় টোকিওবাসী।

করোনার আক্রমণে মাথা ঝুঁকে এসেছে ফ্রান্সের। দেশটির রাজধানী প্যারিসের অবস্থা সূচনীয়। শিল্পের রাজধানী বলা হয় এই শহরকে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকদের কোলাহলে মুখরিত ছিলো প্যারিস। কিন্তু এখন, পর্যটক যাওয়া তো দূরের কথা, প্যারিসের বাসিন্দারাই সাহস করছেন না সড়কে নামতে।

প্যারিসজুড়ে এখন চলছে যুদ্ধ, করোনার বিরুদ্ধে লড়াই। এই লড়াইয়ের প্রথম কাতারে আছেন চিকিৎসকরা। যুদ্ধের লড়াকু সৈনিকদের সম্মান জানাতে গত ২৭ মার্চ আইফেল টাওয়ার সেজেছিলো একটু ভিন্নভাবে। টাওয়ারজুড়ে দেখানো হয়েছিলো একটি শব্দ ‘মার্সি’। ফ্র্যাঞ্চ ভাষার এই শব্দটির বাংলা অর্থ ‘আপনাকে ধন্যবাদ।’ ধন্যবাদ দেওয়ার পদ্ধতিটা একেক শহরে একেকরকম। কোনো শহরে নির্দিষ্ট সময়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে দেখা গেছে বাসিন্দাদের।

উন্নত দেশগুলোতেও এমন মৃত্যুর মিছিলে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে মানুষ। ভাইরাস রুখতে কখন কোন সিদ্ধান্ত নিতে হবে সেটাও ঠিক করতে পারছেন না নীতিনির্ধারকরা। তবে এ বছর ভাইরাসের প্রকোপের মধ্যেই এসেছিলো ‘আর্থ আওয়ার’। প্রতি বছর একটি ঘণ্টা আলো নিভিয়ে পৃথিবীকে সম্মান জানানো হয়। প্রতীকি এই সম্মানের মাধ্যমে পৃথিবীর পরিবেশ ঠিক রাখার আহ্বান জানানো হয়।
এ বছর ঘটা করেই ‘আর্থ আওয়ার’ পালন করেছে মস্কো। গত ২৮ মার্চ শহরের ক্রেমলিন, সেন্ট ব্যাসিলস ক্যাথেড্রাল এবং পার্লামেন্ট ভবনসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভবনের আলো এক ঘণ্টার জন্য নিভে গিয়েছিলো।

ওই অন্ধকার সময়টুকু ছিলো গোটা পৃথিবীর মানুষের জন্য শিক্ষা। মানুষ যদি প্রকৃতিকে সম্মান জানাতে না শেখে, প্রকৃতিও মানুষকে শ্রদ্ধা করবে না। প্রতিশোধ নেবে। ইতোমধ্যে নিচ্ছে। ক্ষুব্ধ প্রকৃতির এই প্রতিশোধ এখন ছড়াচ্ছে দাবানলের মতো।
প্রতিশোধের শিকার ইতালি। দেশটিতে মানবিক বিপর্যয় এতোটাই যে সেটা কারো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। সেখানকার প্রতিদিনের মৃত্যুর সংখ্যা গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো।

মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। কিন্তু ঠিকঠাকভাবে শেষকৃত্য করার সুযোগ হচ্ছে না। বড় বড় শহরগুলোর গির্জা ভরে উঠছে লাশের সারিতে।
দেশটির সিরিয়াত শহরের এক গির্জা সেন্ট জোসেফ। এর পুরোহিত ডন মার্সেলো। প্রতিদিন অনেক করোনার আক্রমণে মৃতদের কফিন সামলাতে হয় তাকে। কফিনগুলো গির্জায় আসে। রাখা হয় শীতল মার্বেলের মেঝেতে। তিনি মৃতদের আশীর্বাদ করেন। শেষকৃত্যের আয়োজন করেন।

ইতালির এই চিত্র দেখে আতঙ্কিত গোটা বিশ্ব। কিন্তু করোনাকে ঠেকানো যাচ্ছে না। এই মহামারি থেকে রক্ষা পেতে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে জনসমাগমের স্থানগুলো। গত ২৮ মার্চের কিছু ছবিতে দেখা গেছে মহামারি আতঙ্কে সুমসাম নীরবতা নেমে এসেছে নেদারল্যান্ডসের শহর রটারড্যামে। নির্জন শহরের অলি-গলি আর বিপণিবিতানগুলো।

নির্জনতা এখন সঙ্গী হয়েছে কোলাহলের শহর ইস্তানবুলের। তুরস্কের সবচেয়ে বেশি জনবহুল শহর এটি। ওখানে এক হয়েছে দুই মহাদেশ। এই শহরকে বলা হয় সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতির হৃদয়। কিন্তু ওই হৃদয়ের পুরোটাই এখন খাঁ খাঁ করছে।
গত ২৩ মার্চ আনাদুলো এজেন্সির পাঠানো ছবিতে দেখা গেছে ইস্তানবুলের ফাঁকা সড়ক। বড় বড় মোড়ের করুণ অবস্থা। তাকসিম স্কোয়ার, গালতা টাওয়ারের আশপাশেও লোক দেখা যায়নি। অথচ কয়েকদিন আগেও ওইসব এলাকায় লোকে গিজ গিজ করতো। এখন লোক যাচ্ছে না উসকুদারেও। গোটা এলাকাটাকে গ্রাস করে নিয়েছে নিস্তব্ধতা।

তুরস্ক প্রথম করোনায় আক্রান্ত হয় ১১ মার্চ। তখন থেকেই মানুষকে আহ্বান করা হয় ঘরে থাকতে। পর্যটক আকর্ষক উপক’লীয় এলাকাগুলোতে মানুষের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। ঘোষণার পর পরই ওলিউডেনিজ সমুদ্র সৈকত রিসোর্ট এবং মারমারিক উপক’লীয় অঞ্চলসহ অনেক পর্যটক আকর্ষক স্থান জনশূন্য হয়ে যায়।

এমনকি আনতালিয়ার পর্যটন কেন্দ্রেও যেতে সাহস করেন না কেউ। দেশটির সৈকত এবং শহরগুলোতে এখন টহল দিচ্ছে পুলিশ। কেউ দরকার ছাড়া ঘুরাফেরা করলে তাকে বাড়ি পঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পথচারির পথ রোধ করে সতর্ক করা হচ্ছে। দেশটির সরকার ৬৫ বছরের বেশি বয়সিদের এবং যারা দীর্ঘস্থায়ী রোগে আক্রান্ত, তাদেরকে বাইরে বের হতে নিষেধ করেছে। এইসব কারণে আনতালিয়ার সড়কে লোকের চলাচল নেই বললেই চলে।

করোনার বিস্তার ঠেকাতে জরুরি অবস্থা জারি করে সেনেগাল। এতে ফাঁকা হয়ে যায় রাজধানী ডাকারের সড়কগুলো। জরুরি অবস্থার পর কারফিউ জারি করা হয় দেশটিতে। সেখানে বিক্ষোভ, সভা, সমাবেশসহ যে কোনো জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়। সেইসঙ্গে মানুষকে ঘরে থাকতে আহ্বান করা হয়। দেশটিতে আক্রান্তর সংখ্যা বেড়েই চলছে।
করোনা ঠেকাতে কঠোর ভ’মিকা নিয়েছে স্পেন। দেশটির সীমান্ত আটকে দেওয়া হয়। সীমান্ত এলাকা ইরুনে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। পয়লা মার্চ থেকেই ফ্রান্স ও পর্তুগালের সাথে স্থলসীমায় কড়া পুলিশি তল্লাশি বসানো হয়েছিলো। কিন্তু ভাইরাসের প্রকোপ আটকানো যায়নি। স্পেনে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আতঙ্কজনক।

গোটা পৃথিবী এখন একযুগে বাঁচতে চাইছে আতঙ্ক থেকে। লড়ছে জীবাণুর বিরুদ্ধে। শহরগুলো মানুষ শূন্য কিন্তু চলছে নানা ধরনের পরিচ্ছন্নতার কাজ। সরকারি উদ্যেগে নেয়া হয়েছে নি¤œআয়ের মানুষের খাবার সরবরাহের কাজ
ফাঁকা সড়কে জীবাণুনাশক ছড়িয়ে ভাইরাসের বিরুদ্ধ যুদ্ধ করছে আজারবাইজানের রাজধানী বাকু। গত ২৮ মার্চ শহরটির জনসমাগমের এলাকাগুলোকে জীবাণুমুক্ত করতে দেখা যায়। করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকেই দেশটির পথ-ঘাট ফাঁকা হয়ে যাওয়ার পর পৌরকর্মীরা সাফাইয়ের কাজে নেমেছেন।

শহর সাফাই হচ্ছে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলেও। প্রতিটি অলি-গলি ও মোড় থেকে জীবাণু ধ্বংস করা হচ্ছে সেখানে।
করোনার প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর কিরগিজিস্তানের বিশকেকের সড়কগুলোও ফাঁকা হয়ে যায়। সরকার ও পৌরসভার নির্দেশে ফাঁকা সড়কে জীবাণুনাশক ছড়ানো হয়।

গ্রীসের রাজধানী অ্যাথেন্স এর সড়কে নেই যানবাহন কিম্বা মানুষের চলাচল। গত ২৮ মার্চের ছবিতে দেখা গেছে গুরুত্বপূর্ণ এই শহরটি খাঁ খাঁ করছে। অলি-গলি ও গলির ধারের মোড় জনশূন্য। বিরান পড়ে আছে পর্যটন এলাকাগুলোও।
যারা ঝুঁকির মুখেও সড়কে নামছেন, তাদের মুখে থাকছে মুখোশ। ঐতিহাসিক নগরী জেরুজালেম হয়ে পড়েছে পর্যটকশূন্য শহর। প্রাচীন এই শহরটিতে দেখা যাচ্ছে কোভিড নাইনটিন থেকে বাঁচতে বাসিন্দাদের মুখে মুখে মুখোশ।