চীনে সাধারণ মানুষের উপর নজরদারি ব্যবস্থা

চীনের পতাকা- সংগৃহীত -

  • রিপোর্ট :: হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৬ জানুয়ারি ২০২০, ১০:৪৭

কমিউনিস্ট দেশগুলোকে এক সময় বলা হতো 'লৌহ যবনিকার দেশ'। কারণ, ওসব দেশের দরজা থাকতো নিশ্ছিদ্রভাবে বন্ধ। দরজার ওপাশে কী ঘটছে তা জানার উপায় ছিল না পৃথিবীর কারোই। তারপরও নানা ফাঁক গলে যেটুকু খবর বেরিয়ে আসতো তা এককথায়, ভয়ঙ্কর।

কমিউনিজমের সেই রমরমা আজ আর নেই। যে দেশে কমিউনিজমের উৎপত্তি, সেই সোভিয়েত ইউনিয়নই আজ ভেঙে টুকরো-টুকরো। এখন চীন আর কিউবাই কেবল কমিউনিজমের ছেঁড়া পতাকা উড্ডীন রেখেছে। সেই কমিউনিজমও নামেমাত্র। আসলে বাজার অর্থনীতির উত্তরীয় গায়ে জড়িয়ে ঢুকে পড়েছে পুঁজিবাদ।


তবে একটা জায়গায় এখনো কঠোরভাবে স্থির আছে কমিউনিস্ট চীন। সেটা হলো নাগরিকদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ। সম্প্রতি তারই অংশ হিসেবে পাতাল রেলের যাত্রীদের তল্লাশি ব্যবস্থায় প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে চীন সরকার। দেশটিতে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ পাতাল রেলে চলাচল করে। তাদের সবাইকে এই ব্যবস্থার মাঝ দিয়েই যেতে হবে।


নিয়মটি পছন্দ হয়নি অনেকের। তারা বলছেন, এমনিতেই দেশে অসংখ্য নিয়ম-কানুনের শৃঙ্খল, তার অপর আবার প্রযুক্তি ব্যবহার! এতে যাত্রীদের প্রাইভেসিই বিঘ্নিত করা হবে শুধু। এ পর্যায়ে শোনা যাক কার্টুন ডিজাইনার লি ঈনিং-এর কথা। এক শীতের সকালে বেইজিং-এর উপকণ্ঠে একটি সাবওয়ে স্টেশন অভিমুখী ফুটওভার ব্রিজের ওপর লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। লাইন নড়ছেই না। লি-র অস্থির লাগছে। অস্থিরতা কাটাতে তিনি জ্যাকেটের পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে নিউজ ব্রাউজিং করতে থাকলেন।


কাছেই নিরাপত্তারক্ষীরা মেটাল ডিটেক্টরের মাঝ দিয়ে যাত্রীদের ঠেলে দিচ্ছে লোকজনে ঠাঁসা স্টেশনের দিকে। আর কারো সাথে যদি থাকে লাগেজ, হ্যান্ডব্যাগ, ব্যাকপ্যাক কিংবা অন্যকিছু, তা তুলে দেয়া হচ্ছে কনভেয়র বেল্টে। এক্স-রে মেশিন পার হয়ে সেগুলো মালিকের হাতে পৌঁছবে।


এতসব কাণ্ড শেষে স্টেশনের দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতে লি-র লেগে যায় প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ মিনিট। অথচ পথটির দুরত্ব মাত্র ৬৫ ফুট বা সাড়ে পাঁচ গজের মতো। লি-কে এর পরও আরো দুই ঘণ্টা পথ যেতে হবে। তাই ক্ষোভ চেপে রাখতে না-পেরে তিনি বলেন, এটা একেবারেই সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। এত লোকের সময় এভাবে নষ্ট করার যুক্তিটা কী? 


চীনের পাতাল রেল হচ্ছে বিশ্বের সবচাইতে ব্যস্ত রেলপথ। শুধু বেইজিং-শাংহাই রুটেই প্রতিদিন গড়ে এক কোটির বেশি যাত্রী চলাচল করে, যা কিনা লন্ডনের টিউব রেলের তিন গুণ এবং নিউ ইয়র্কের দ্বিগুণ। চীনের অন্যান্য বড় নগরেও পাতাল রেলে লাখ লাখ মানুষ প্রতিদিন যাতায়াত করে থাকে। 


যে পথে এত লোকের চলাচল, সেখানে নিরাপত্তার এতো কড়াকড়ি, শীতের সকালে কাঁপতে কাঁপতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ও সময় নষ্ট হওয়া - এসব মেনে নিতে চান না লি-র মতো অনেকেই। যাত্রীদের অসন্তোষের কথা জানতে পেরে কর্তৃপক্ষ বলেছে, এ সমস্যার আংশিক সমাধান হতে পারে সাবওয়েতে ফেসিয়াল রিকগনিশন সিস্টেম ব্যবহার করা। এতেও কেউ খুশি, কেউ নাখোশ। যারা নারাজ তাদের যুক্তি হচ্ছে, এতে তাদের প্রাইভেসি ক্ষুন্ন হবে।


২০১৮ সাল পর্যন্ত পাওয়া চীনের সরকারি হিসেবমতে, শুধু রাজধানী বেইজিং-এর ৮৮২ সাবওয়ে চেকপয়েন্টে প্রায় ৩০ হাজার নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন আছে। এদের পেছনে প্রতি বছর বেইজিং পৌর সরকারের ব্যয় হয় ১৭০ কোটি ইউয়ান অর্থাৎ নগরীর প্রতি নাগরিকের মাথাপিছু ১২৫ ইউয়ান।


নিরাপত্তা তল্লাশির সময় নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে যাত্রীদের খিটিমিটিও কম হয় না। ২০১৬ সালে বেইজিং ঈভনিং নিউজ পত্রিকার এক জরিপে দেখা যায়, ওই সময় যাত্রী-রক্ষী বচসা আগের তুলনায় চার গুণ বেড়ে গেছে। বেইজিং রেল ট্রাফিক কন্ট্রোলের এক কর্মকর্তা বলেন, এত যাত্রী! আমাদের ওপর ভীষণ চাপ পড়ে। ফেসিয়াল রিকগনিশন সিস্টেম এ সমস্যার একটা কার্যকর সমাধান হতে পারে।


গত নভেম্বর মাসে চীনের আরো অনেক নগরীর সাথে সাথে রাজধানী বেইজিং-এও পরীক্ষামূলকভাবে ফেসিয়াল রিকগনিশন সিস্টেম চালু করা হয়েছে। এবং এ নিয়ে শুরু হয়েছে অভিযোগ। প্রাইভেসি বিঘ্নিত হওয়ার বিষয়টি ছাড়াও বলা হচ্ছে, নিয়মটি চালুর আগে কোনোরকম গণশুনানির ব্যবস্থা করা হয়নি। আর বলা হচ্ছে, চীনের এত ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থার পরও কি এর কোনো দরকার ছিল?


চীনের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক লাও দংইয়াং-ই প্রথম বুদ্ধিজীবী, যিনি এ বিষয়ে প্রথম মুখ খুললেন। গত নভেম্বরে তিনি তাঁর ব্লগে লিখেন, নিরাপত্তাব্যবস্থার পেছনে বেশি, আরো বেশি ব্যয় দেখে আমার মাথা গুলিয়ে গেছে। আমার মনে হচ্ছে আমরা যেন নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার শিকারে পরিণত হয়েছি।


চীনে পাতাল রেল চালুর সূচনা হয় ১৯৬০ সালে, তবে এর একটি বড় অংশ অর্থাৎ তিন হাজার আট শ' কিলোমিটার মেট্রো লাইন চালু হয় গত দশকে। আর মেট্রো রেলে নিরাপত্তার কড়াকড়ি শুরু হয় ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকের আগে। এটা ঠিক, অলিম্পিকের আগে পৃথিবীর সব দেশই নিরাপত্তা জোরদার করে, গেমস শেষে তা আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায়। কিন্তু চীন তার ব্যতিক্রম। ২০১৪ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং দেশের সিকিউরিটি মনিটরিং সিস্টেম আরো শক্তিশালী করার ঘোষণা দেন। তার দু'বছর পর দেশটি কাউন্টার টেররিজম আইন-২০১৬ পাস করে। এরই অংশ হিসেবেই পাতাল রেলে যাতায়াতে এই কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা।


সরকারের এ পদক্ষেপের পক্ষে কলম ধরেছেন পিপলস পাবলিক সিকিউরিটি ইউনিভার্সিটি অব চায়না-র এক সহযোগী অধ্যাপক ফেং ওয়েই। তিনি গত বছর আগস্টে জার্নাল অব হুপেই ইউনিভারসিটি অব পুলিস-এ লিখেছেন, ''এর প্রথম যুক্তি হলো সন্ত্রাসবাদী হামলা ঠেকানো। চীন এখন এক সামাজিক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। অন্যান্য দেশের চাইতে এর ঝুঁকি অনেক গুরুতর ও জটিল।''


তাঁর মতে, দেশে যেহেতু সম্পদবৈষম্য বাড়ছে এবং অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাসের কারণে চাকরি হারাচ্ছে অনেকে, তাই ক্ষুব্ধ মানুষের হামলার শিকার হতে পারে পাতাল রেল।
নিরাপত্তা জোরদারের পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে চীন সরকার ২০১৪ সালের ১ মার্চ ইউনান প্রদেশের কুনমিং রেল স্টেশনে হামলার উদাহরণ দেয়। ওই হামলায় একদল দুর্বৃত্ত কয়েক ডজন মানুষকে ছুরিকাঘাতে হত্যা এবং প্রায় এক শ' জনকে আহত করে। সেদিন চীনা পুলিশের গুলীতে নিহত হয় চার হামলাকারী। সরকার এ হামলার জন্য সিনচিয়াং প্রদেশের স্বাধীনতাকামী মুসলিমদের দায়ী করে এবং সেখানকার প্রায় ১০ লাখ মুসলিমকে বন্দিশিবিরে আটক করে। এ ঘটনা বিশ্ব মিডিয়ায় ফলাও করে প্রকাশিত হয়।


সিনচিয়াং প্রদেশের মুসলিমরা ছাড়াও চীন নিরাপত্তা হুমকির আশঙ্কা করে তাইওয়ানী ও তিব্বতী স্বাধীনতাকামীদের কাছ থেকে। সন্ত্রাসবাদী হামলাকারীদের কাছে পাতাল রেল খুবই আকর্ষণীয়। কারণ, একটিমাত্র বিস্ফোরণেই মাটির তলায় আটকা পড়বে হাজার হাজার মানুষ আর তাদের উদ্ধারের অভিযানটি হবে খুবই জটিল। 


চীনের একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ৯/১১এর পর বিমানবন্দর নিরাপত্তাব্যবস্থার নাটকীয় উন্নতি ঘটেছে, যার ফলে বিমানে হামলা দুরূহ হয়ে গেছে। কাজেই সন্ত্রাসবাদীরা সহজ লক্ষ্যস্থল হিসেবে ট্রেন ও সাবওয়েকে বেছে নেবে - এটাই স্বাভাবিক। সেখানেই তারা বেশি ক্ষতি এবং আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারবে। কড়া নিরাপত্তার কারণে সাধারণ মানুষের প্রাইভেসি কিছুটা ক্ষুন্ন হবে, তাদের কিছু সময় নষ্ট হবে, কিছু ভোগান্তিও হবে - সবই ঠিক। কিন্তু বড় কোনো বিপর্যয় এড়াতে সামান্য অসুবিধা তো মেনে নিতেই হবে!


এসব যুক্তিতে চীন তার পাতাল রেলের নিরাপত্তাকে আধুনিকায়ন করছে। তারা  যাত্রীদের চিনে রাখতে বসিয়েছে ফেসিয়াল রিকগনিশন, সারভেইল্যান্স ও এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) প্রযুক্তি। তবে এসব প্রক্তির সম্ভাব্য অপব্যবহার নিয়েও উদ্বেগের শেষ নেই। বেইজিং-এর এক আইনজীবী বলেন, ফেসিয়াল রিকগনিশনকে যখন বড় ডেটাবেসের সাথে যুক্ত করে দেয়া হবে তখনই ব্যাপারটা হবে ভয়ঙ্কর। কারণ, তখন একজন ব্যক্তির বায়োলজিক্যাল, বিহেভিয়ার‍্যাল অ্যান্ড ট্র্যানজেকশন ইনফরমেশন সবই তো তখন সরকারের গোচরে চলে যাবে। প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলতে মানুষের আর কী রইল? সব তো ফাঁস হয়ে গেল।


লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, এটা একদল-শাসিত দেশের বৈশিষ্ট্য। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তারা লেনিন-প্রবর্তিত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকেই জোরদার করছে।
এসব ব্যবস্থা প্রচলন ও চালু রাখার জন্যে হাজার হাজার কোটি ইউয়ান দরকার চীনের। কিন্তু তাতেও ভ্রূক্ষেপ নেই দেশটির। টাকা কোনো বড় সমস্যা হবে না। ব্যক্তির নিরাপত্তা রক্ষার নামে তারা সব করেই যাবে। সারা বিশ্বে বিতর্কিত ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তিও চালু করবে দেশটি।


এ নিয়ে কী ভাবছে চীনারা? জানতে চলুন ফিরে যাই সেই কার্টুন ডিজাইনার লি-র কাছে, যার কথা আমরা শুরুতেই বলেছি। তীব্র তাচ্ছিল্যে তিনি বলেন, আমাদের সব তথ্য তো নানা রকম অ্যাপ্লিকেশনের সাহায্যে প্রতি মিনিটেই ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় কী বলছি, কখন সাবওয়ে স্টেশনে ঢুকছি আর কখন বের হচ্ছি, কখন অফিসে ঢুকছি, কী খাচ্ছি, কি দেখছি, সবই তো! এর বেশি আর কী করবে? করুক!