শার্ম এল-শেখ : জেলেপল্লী থেকে পর্যটনকেন্দ্র

জেলেপল্লীই মিশর নামের দেশটির জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র - সংগৃহীত

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১৫ নভেম্বর ২০১৯, ১৫:৪০


বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে আজকাল আমাদের দেশেও অনেকেই মিশরের শার্ম এল-শেখ নামটি জানেন। অনেকে একে শার্ম এল-শায়েখ নামেও ডেকে থাকে। তা যা-ই হোক, এই শার্ম এল-শেখ ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত কেবলই একটি জেলেপল্লীর বেশিকিছু ছিল না। আর এককালের সেই জেলেপল্লীই আজ মিশর নামের দেশটির সবচাইতে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলোর অন্যতম। 


মিশরের সিনাই উপদ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জানুব সিনা গভর্নরেটে শার্ম এল-শেখের অবস্থান। ১৯৭২ সালে মিশরের এ এলাকাটি দখল করে নেয় ইসরাইল এবং ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তাদের দখলেই ছিল। তারাই একে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে শুরু করে। হয়তো তারা ভাবতেও পারেনি যে একদিন মিশরের এই এলাকা মিশরকেই ফেরত দিতে হবে। ১৯৮২ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির অধীনে শার্ম এল-শেখ ফিরে পায় মিশর। তারাও শার্ম এল-শেখকে উন্নয়নের কাজ চালিয়ে যায়, যার কারণে এলাকাটি আজকের গৌরবময় অবস্থানে আসতে পেরেছে। নইলে কী এমন ছিল শার্ম এল-শেখ?

আসলেই ঐতিহাসিক কাল থেকেই শার্ম এল-শেখ তার বৈরী আবহাওয়ার কারণে ছিল প্রায় জনবসতিহীন। এলাকাটিতে গ্রীষ্মে তালুফাটানো গরম থাকে,  শীত এলে তা হয়ে যায় আরামদায়ক উষ্ণ। তবে আধুনিককালে এসে ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে  শার্ম এল-শেখ। কারণ, আকাবা উপসাগরে প্রবেশের ১৪ মাইল লম্বা সরু পথটি  শার্ম এল-শেখের ভেতর দিয়েই গেছে।


শার্ম এল-শেখের গুরুত্ব, তাকে নিয়ে মিশর-ইসরাইল দ্বন্দ্ব ইত্যাদি আরো অনেক কাহিনী আছে। তবে সেসব কথা আজ নয়, আজ আমরা বলবো পর্যটনকেন্দ্র  শার্ম এল-শেখের কথা।

ইসরাইলের শুরু করা এবং মিশরের চালিয়ে যাওয়া উন্নয়নকাজের ফলে আজ এলাকাটির চেহারা দাঁড়িয়েছে এমন যে, এখন কেউ  শার্ম এল-শেখে গেলেই তার চোখে পড়বে অনেক লাক্সারি রিসোর্ট, সৈকতে সারি সারি রেস্তোরাঁ ও নাইট ক্লাব। ওই উপকূলের স্বচ্ছ পানি আর ব্যাপক প্রবাল প্রাচীর  শার্ম এল-শেখকে পরিণত করেছে স্নরকেলিং ও স্কুবা ডাইভিং-এর জনপ্রিয় স্থানে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় যেমন, তেমনি এর বিলাসবহুল আবাসনব্যবস্থার কারণেও  শার্ম এল-শেখ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শা ন্তি সম্মেলনের আকর্ষণীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়। তা দেখে  শার্ম এল-শেখকে সিটি অব পীস বা শান্তি নগরী নামে বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করে ইউনেস্কো।


বুঝতেই পারছেন, শার্ম এল-শেখে রয়েছে সমুদ্র উপকূল আর সে কারণেই বুঝি বা এলাকাটি হয়ে গেছে মিসরের সবরকম জলক্রীড়ার প্রাপ্তিস্থান। যে জলক্রীড়ার নামই আপনি নিন না কেন,  শার্ম এল-শেখে তার দেখা পাবেনই! আর কী, ফ্লিপারজোড়া পায়ে গলিয়ে প্রবালপ্রাচীরের ধারে নেমে পড়ুন সমুদ্রজলে। 

লোহিত সাগরের এখানটায় পানির তলা জাহাজভাঙ্গা লোহালক্কড়ে ভর্তি, তবে এখানেই আবার আছে পৃথিবীর সবচাইতে বিচিত্র কিছু সামুদ্রিক প্রাণী। এখানে আপনি করতে পারেন কাইট সার্ফিং, ওয়াটার স্কিইং ও উইন্ডসার্ফিং। সাঁতার ভালো পারেন না বলে দুশ্চিন্তা হচ্ছে? ভাবছেন, আহা রে, সমুদ্রের তলার জগতটা বুঝি আর দেখা হলো না! ভাবনার কিছু নেই।  শার্ম এল-শেখে আপনার মতো পর্যটকদের জন্য সবসময় তৈরি হয়ে আছে তলায় স্বচ্ছ গ্লাস লাগানো অসংখ্য নৌকা, যার সাহায্যে পানিতে না-নেমেও আপনি দেখতে পাবেন পানির নিচের জগৎ।

এবার চলুন শার্ম এল-শেখের আরেক আকর্ষণ রাস মোহামেদ ন্যাশনাল পার্ক ঘুরে আসা যাক। সিনাই উপদ্বীপের একেবারে দক্ষিণে অবস্থিত এই ন্যাচার রিজার্ভটি ৪৮০ বর্গকিলোমিটারজুড়ে বিস্তৃত। এখানে পা রাখামাত্রই আপনি মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না, যখন দেখবেন এর মরুভূমিগুলো, যেখানে মানুষের পায়ের ছাপ বলতে গেলে পড়েইনি। আপনাকে আরো মোহিত করবে এর সাদা বালির সৈকতগুলো এবং নানা জলক্রীড়ার ব্যবস্থা। এখনকার পানির নিচে যেমন আছে প্রায় এক হাজার প্রজাতির মাছ, তেমনি পানির ওপরে ও নিচে দেখবেন অনেক জাতের কচ্ছপ; গুটি গুটি পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষকে ওরা একটুও ভয় পায় না।

এবার যাওয়া যাক না'আমা উপসাগরে। একে বলা হয় শার্ম এল-শেখের সব আনন্দ-বিনোদনের কেন্দ্র। মজা করতে চান, সৈকতে শুয়ে-বসে একটি দিন কাটিয়ে দিতে চান - সব আপনার হাতের নাগালেই, শুধু টাকা খরচের মন থাকলেই হবে।

আপনার সাথে যদি শিশু-কিশোররা থাকে, তাহলে আপনার অ্যাউয়া ব্লু (Blue)ওয়াটার পার্কে না গেলেই নয়। হাদাবায় অবস্থিত এই ওয়াটার প্যারাডাইস বা জলক্রীড়ার স্বর্গটি আপনাকে পুরো একটি দিন আননদ-বিনোদনে ভুলিয়ে রাখবে। এখানে আছে ৪৪টি ওয়াটার স্লাইড ও গেম এবং নয়টি পুল। কামিকাজে ও ব্ল্যাক হোলের মতো স্লাইডগুলো আপনার পিলে চমকে দেবে। ১২-এর কম বয়সীদের জন্য রয়েছে আলাদা স্লাইড।  

খেলাধুলার জগত ছেড়ে এবার চলুন দেখতে যাই আল-মুস্তাফা মসজিদ। অনন্য স্টাইল এবং ভেতরে-বাইরে মনকাড়া স্থাপত্য এই মসজিদকে দিয়েছে বিস্ময়কর আকর্ষণ।মসজিদ দেখা শেষে যাওয়া যেতে পারে কপটিক খ্রিস্টানদের হেভেনলি ক্যাথেড্রাল বা গির্জায়। আল-মুস্তাফা মসজিদের কাছেই হে এল নূর এলাকায় অবস্থিত গির্জাটির ভেতর-বাইরের দেয়ালে চিত্রিত বাইবেলের কাহিনীভিত্তিক ফ্রেসকো একে দিয়েছে এমন অনন্যতা যে, ২০১০ সালে এক জরিপে এটি বিশ্বের সবচাইতে আকর্ষণীয় ১০টি গির্জার একটি বলে স্বীকৃতি পায়।

ওখান থেকে ঘুরতে ঘুরতে চলে যেতে পারেন ওল্ড টাউনে। স্থানীয় লোকজন একে অবশ্য ওল্ড মার্কেটই বলে থাকে। এলাকাটি সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ও উচ্ছল একটি জায়গা -  বর্ণিল, কোলাহলমুখর ও সুগন্ধে ভরপুর। এটি স্থানীয় লোকজনের খুবই প্রিয় স্থান। তারা এখানে শুধু কেনাকাটা করতেই আসে না, আসে জায়গাটির মৌতাত উপভোগ করতেও।

এ বাজারের প্রধান পণ্য হলো নানা ধরনের ভেষজ ও মশলা। ওল্ড মার্কেটের দোকানে দোকানে এসব পণ্য বোঝাই আর দোকানীরাও অতিশয় ভদ্র। ক্রেতাদের এসব পণ্যের গুণাগুণ ও ব্যবহারবিধি বুঝিয়ে বলতে তারা একটুও বিরক্ত হয় না।

কেনাকাটা শেষ, আবার চাই একটু বিনোদন। চলুন যাই ডলফিনেলায়। নাম শুনেই হতো আন্দাজ করতে পারছেন ব্যাপারটা কী। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, ডলফিনের সাথে খেলা। এখানে আপনি ডলফিনের সাথে সাঁতার কাটতে আর তাদের পিঠে চড়তে পারবেন। এ এক অনুপম অভিজ্ঞতা।

 আমরা শার্ম এল-শেখ ভ্রমণের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। তবে আপনাকে বলি, শার্ম এল-শেখের মরুভূমিতে রাতের আকাশ ও তারার মেলা না দেখে আপনি কিছুতেই শার্ম এল-শেখ ছেড়ে যাবেন না। ওখানে গেলে আপনি প্রথমেই ঐতিহ্যবাহী বেদুঈন আতিথেয়তার স্বাদ পাবেন। ওখনে আপনার সন্ধ্যাটা শুরু হবে একটি মিশরীয় তাঁবুতে মোমবাতির আলোয় জম্পেশ খানাপিনার মধ্য দিয়ে। সূর্য একেবারে ডুবে গেলে, চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলে এবং আকাশে একটি-দু'টি তারা ফুটে উঠতে শুরু করলে আপনার গাইড আপনাকে নিয়ে যাবে অনেকগুলো টেলিস্কোপ রাখা আছে এমন এক জায়গায়। সেই টেলিস্কোপে চোখ রেখে আপনি দেখবেন রাতের আকাশে তারার মেলা। সে এক অভাবিত দৃশ্য, অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।