এরদোয়ানের বিজয়ে কেন উল্লসিত মুসলিমবিশ্ব

- সংগৃহীত

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৬ জুন ২০২৩, ১৩:৪৯

সত্যিকার গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে কোনো দল সাধারণত একটানা খুব বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারে না। থাকলেও বিভিন্ন দলের সঙ্গে জোট করতে হয়। জার্মানির নন্দিত রাষ্ট্রনায়ক অ্যাঙ্গেলা মের্কেল থেকে শুরু করে কানাডার জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো পর্যন্ত সবার ক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য। তবে একজই শুধু ব্যতিক্রম। তিনি বিশ্ববরেণ্য মুসলিম নেতা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। টানা বিশ বছর ক্ষমতায় থাকার পর আবারও অবাধ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি নিজেকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছেন।

বিরোধপূর্ণ নাগারনো-কারাবাগ নিয়ে ২০২০ সালে মুসলিম প্রধান আজারবাইজান এবং খ্রিস্টান প্রধান আর্মেনিয়ার মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। কয়েক দশকের অচলাবস্থার অবসান ঘটিয়ে সেই যুদ্ধে অকল্পনীয়ভাবে জিতে যায় আজারবাইজান। কোনো মুসলিম প্রধান দেশের কাছে একটি খ্রিস্টান প্রধান দেশের এমন সুস্পষ্ট পরাজয় সাম্প্রতিক ইতিহাসে আর দেখা যায়নি। এই জয়ের নায়ক ছিলেন মূলত এরদোয়ান। তার দেশের বিধ্বংসী ড্রোন আর সমরাস্ত্রে বলীয়ান হয়ে যুদ্ধের গতি পাল্টে দেয় আজারবাইজান। এতে আর্মেনিয়ার পাশাপাশি পরাজয় ঘটে দেশটির মিত্র ফ্রান্স, এমনকি রাশিয়ারও।

আমের্নিয়ার যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ানের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। সেনাবাহিনীর একাংশও তাকে উৎখাতের চেষ্টা করে। তবে তিনি এখনো ক্ষমতায় আছেন। মজার ব্যাপার হলো, এরদোয়ান তৃতীয় দফায় বিজয়ী হওয়ার পর যেসব বিশ্ব নেতা তাকে প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে অভিনন্দন জানিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম নিকোল পাশিনিয়ান। পাশিনিয়ান বলেছেন, তিনি দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পূর্ণ স্বাভাবিককরণের জন্য উন্মুখ। অপরদিকে আজারবাইজানের নেতা ইলহাম আলিয়েভ তো আরো একধাপ এগিয়ে ফোন করে এরদোয়ানকে অভিনন্দন এবং তাকে বাকু সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

এরদোয়ানকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেমন অভিনন্দন জানিয়েছেন তেমনি তাকে প্রিয় বন্ধু বলে সম্বোধন করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। রুশ নেতার শত্রু ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন এরদোয়ানকে। এরদোয়ান এভাবেই তার অনন্য ভূরাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। ফলে শত্রু মিত্র নির্বিশেষে সবাই তাকে সম্মান করতে বাধ্য হয়।

তুরস্কের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের মত আর কেউ বিশ্বের কাছে তিষ্ঠা করতে পারেননি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক জোটের একমাত্র মুসলিম প্রধান দেশ তুরস্ক। ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরক বাহিনী তুরস্কের। আর এই সামরিক বাহিনীর যিনি সর্বাধিনায়ক, তার তো এমনই মর্যাদা হওয়ার কথা।

টানা তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে আধুনিক তুরস্কের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল রাষ্ট্রনায়কের মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখেছেন এরদোয়ান। উসমানীয় খেলাফত পরবর্তী তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের পর থেকে দেশের সবচেয়ে সফল রাষ্ট্রনায়ক তিনি। মোস্তফা কামাল ক্ষমতায় ছিলেন ১৫ বছর। আর এরদোয়ান ইতিমধ্যেই ২০ বছর পার করেছেন। তবে তার ক্ষমতায় আসা এবং থাকা মোটেই মসৃণ ছিল না।

অভ্যুত্থান আর নানামুখি ষড়যন্ত্র শক্ত হাতে মোকাবিলা করে দক্ষতার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা, দেশকে বৈশ্বিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আসীন করাসহ বিভিন্নভাবে আলোচনায় থেকেছেন এই নেতা। উচ্চমূল্যস্ফীতি কিংবা সম্প্রতি ভয়াবহ ভূমিকম্পের বিরূপ পরিস্থিতির নানা অভিযোগের মধ্যেও দ্বিতীয় দফা ভোটে এরদোয়ানকেই ফের বেছে নিয়েছেন তুর্কিরা।

তবে আগের নির্বাচনগুলোর চেয়ে এবার ইসলামপন্থি এরদোয়ানকে বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে জয়ী হতে হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী প্রতিদ্বন্দ্বী কামাল কিলিচদারোগলু জিতে যাবেন বলে পশ্চিমা গণমাধ্যমে জোর প্রচার ছিল। এমনকি পক্ষপাতদুষ্ট জনমত জরিপে বলা হয়েছিল এরদোয়ানের চেয়ে কিলিচদারোগলু ১০ পয়েন্ট ব্যবধানে এগিয়ে আছে। তবে জাতির জন্য নিবেদিত এরদোয়ান ছিলেন নির্ভার।

জয়ের পরই রাজধানী আঙ্কারাসহ দেশজুড়ে বিজয় উদযান করেন এরদোয়ান সমর্থকরা। বিপুল সংখ্যক সমর্থক জড়ো হন এরদোয়ানের আঙ্কারার বাসভবনের সামনেও। এ সময় তাঁদের উদ্দেশ্য এরদোয়ান বলেন, এই জয় গোটা জাতির। এটা গণতন্ত্রের বিজয়। তিনি বলেন, এখনই সময় নির্বাচনের সময় নিয়ে সকল বিতর্ক ও দ্বন্দ্ব বাদ দিয়ে এবং আমাদের জাতীয় লক্ষ্য ও স্বপ্নকে ঘিরে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। এ নির্বাচনে বিজয়ী সমগ্র তুরস্ক। এরদোগান বলেন, সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারের মধ্যে থাকবে মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং সাম্প্রতিক বিপর্যয়কর ভূমিকম্পের ক্ষত নিরাময় করা।

নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন একে পার্টির ইস্তাম্বুল সদর দফতরের বাইরে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। কেউ কেউ শিশুদের নিয়ে এসেছিলেন। পতাকা নেড়ে গাড়ির হর্ন বাজিয়ে এবং আতশবাজি মাধ্যমে তারা বিজয় উদযাপন করেন। পার্টির সদর দফতরের বাইরে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এরদোগান সমর্থক ডেনেল আনার্ট বলেছেন: আমি আশা করি এরদোয়ান চিরকাল বেঁচে থাকবেন। তিনি আমার বাবা, আামর দাদা, আমার চাচা। তিনি আমার সবকিছু।

এরদোয়ানের একজন সমর্থকের আকাঙ্খা , শুধু তুর্কি নয়, এরদোয়ানের বিজয়ে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের উল্লাস করা উচিত। আসলে তার কথার প্রতিধ্বনি দেখা যায় সমগ্র মুসলিম বিশ্বে। সারা বিশ্বের মুসলিমরাই তার বিজয়ে ভীষণ গর্বিত।

১৯৫৪ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের কাসিমপাশা শহরতলীতে জন্ম এরদোয়ানের। তাঁর বাবা আহমদ এরদোয়ান জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন। পাঁচ সহোদরের মধ্যে তিনি তৃতীয়। এরদোগান ১৯৯৪ সালে ইস্তাম্বুল শহরের মেয়র হন। সে সময়ই তিনি ধর্মনিরপেক্ষ আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে ইসলামী নীতির পথে হাঁটেন। কবিতায় মসজিদকে সেনা ব্যারাকের সঙ্গে তুলনা এবং মিনারগুলোকে ‘আমাদের বেয়নেট’ হিসেবে তুলে ধরায় ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে তাঁকে ৪ মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়।

আগের ইসলামী দল নিষিদ্ধ হওয়ার পর একে পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এরদোয়ান। এরপর ২০০২ সালের নির্বাচনে ব্যাপক ভোটে জয়ী হয়ে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। তাঁর দল ১৯৮৪ সালের পর প্রথমবার তুরস্কের ইতিহাসে একক কোনো দল হিসেবে এবং পরপর ৪ বার সংসদীয় নির্বাচনে জয়ী হয়। এই সময়কালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সাল থেকে টানা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। দীর্ঘ এই নেতৃত্বে ২০১৬ সালের জুলাইয়ে সুসংগঠিত সেনা অভ্যুত্থান প্রতিহত করতে হয়েছে এরদোয়ানকে।

এরদোয়ানের শাসনে তুরস্ক একটি বিরাট সামরিক শক্তি হিসেবে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের যুদ্ধে এরদোয়ান একজন সুনিপুণ খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ইতিমধ্যেই তিনি দেশটির অভ্যন্তরীণ, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং বৈদেশিক নীতি পুননির্মাণ করেছেন। এবারের বিজয় তার অজেয় তার চিত্রকে আরও শক্তিশালী করেছে। এ কারনে প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, এবারের নির্বাচন রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বকে শক্তিশালী করতে এবং একটি স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করার ক্ষেত্রে এরদোগানের প্রচেষ্টার জন্য তুর্কি জনগণের সমর্থনের স্পষ্ট প্রমাণ দিয়েছে।

সিএনএনের সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে এরদোয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে তার সম্পর্ককে বিশেষ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, পশ্চিমা সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি ন্যাটোতে সুইডেনের যোগদানে সম্মতি দেবেন না। এরপরও এরদোয়ানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী উলফ ক্রিস্টারসন। তিনি বলেছেন, আমাদের সাধারণ নিরাপত্তা ভবিষ্যতের অগ্রাধিকার।

রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করার পর থেকে, তুরস্ক শক্তিশালী মধ্যস্ততাকারী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ব্ল্যাক সি গ্রেইন করিডোর ইনিশিযয়েটভ নামে পরিচিত একটি চুক্তির মধ্যস্ততা করতে সাহায্য করেন এরদোয়ান। যা ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনে আটকে থাকা লক্ষ লক্ষ টন গম রপ্তানির সুযোগ করে দেয়। এটা বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা সংকট এড়াতে সহায়তা করে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার একদিন আগে চুক্তিটি আরও দুই মাসের জন্য বাড়ানো হয়।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এরদোয়ানকে বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। জেলেনস্কি বলেন, আমরা আমাদের দেশের সুবিধার জন্য কৌশলগত অংশীদারিত্বকে আরও জোরদার করার পাশাপাশি ইউরোপের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য সহযোগিতা জোরদার করবো।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গে এরদোয়ানের সম্পর্ক ভালো নয়। ম্যাক্রোও বলেছেন, ফ্রান্স ও তুরস্ক এগিয়ে যেতে থাকবে। ফ্রান্স এবং তুরস্কের সামনে অনেক বিশাল চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ইউরোপে শান্তি ফিরে আনা , ইউরো-আটলান্টিক জোটের ভবিষ্যত, ভূমধ্যসাগর সহ নানা ইস্যুতে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়ে ম্যাক্রো বলেন, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের পুনঃনির্বাচনে আমি অভিনন্দন জানাই। এবারের বিজয় এরদোয়ানের দায়িত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

এরদোয়ানের শুভাকাংখীদের প্রত্যাশা, তিনি তুরস্ককে আরো বেশি ঐক্যবদ্ধ করবেন। তাদের আশা, পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততা যথাসম্ভব ঘুচিয়ে তুরস্ককে একটি ঈর্ষণীয় বিশ্বশক্তিতে পরিণত করবেন।