ইমরানের কাছে পরাজিত পাকিস্তান আর্মি

- সংগৃহীত

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১৪ মে ২০২৩, ১৯:৪৩

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে নাটকীয়ভাবে গ্রেপ্তারের পর কারোই বুঝতে অসুবিধা হয়নি, এটা সেনাবাহিনীর কাজ। ফলে অনেকেই মনে করেছিলেন, তার মুক্ত থেকে ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনার আপাতত ইতি ঘটল। মাত্র দুদিনের মাথায় হিসাবনিকাশ পাল্টে যায়। এখন দেখা যাচ্ছে, ইমরানের আরও উত্থান ঘটেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশে ইমরানের মুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর পতনপর্ব শুরু হয়েছে। তারা এবার পিছু হটতে শুরু করেছে।

ইমরান খানকে গ্রেফতারের পর পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় শহর লাহোরে একদল লোক একটি প্রাসাদে প্রবেশ করছে। সেখানে বেশ কিছু নারীও ছিল। ৩৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, লাঠি হাতে তারা শ্লোগান দিচ্ছে এবং ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআইর দলের পতাকা বহন করছে। তারা গেট ভেঙে সেনাবাহিনীর কর্পস কমান্ডারের বাসভবনে প্রবেশ করে।

প্রাসাদটি শুধু একজন শীর্ষ সামরিক জেনারেলের বাসভবনই ছিল না, এর ঐতিহাসিক গুরুত্বও রয়েছে। এটিতে এক সময় বাস করতেন দেশটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। তার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় জিন্নাহ হাউস। এই ভবনটির একটি অংশ পরে বিক্ষোভকারীরা আগুনে পুড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানের সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই ভিডিও ভাইরাল হয়।

ইসলামাবাদের হাইকোর্ট থেকে ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পরপরই এ ঘটনা ঘটে। তার নাটকীয় গ্রেপ্তার পাকিস্তানিদের হতবাক করে। এরপরই ইমরানের সমর্থকরা রাস্তায় নেমে অবিলম্বে তার মুক্তি দাবি করেন।

একই ধরনের কয়েক ডজন ভিডিওতে দেখা যায়, পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর মালিকানাধীন স্থাপনা ও ভবনগুলোকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভকারীদের সমবেত হতে।

রাওয়ালপিন্ডির গ্যারিসন শহরের একটি ভিডিওতে একজন নারীকে পাকিস্তান সেনা সদরদপ্তরে দুর্গের মতো কমপ্লেক্সের প্রবেশদ্বারে প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে। অন্য দুজন নারী গেট খোলার জন্য ধাক্কা দিচ্ছে। অন্য একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পিটিআইর পতাকা বহনকারী শত শত দলীয় কর্মী স্কার্ফ পরে একই গেটে নামছে। তারা সেখানে উঠার চেষ্টা করছে। তারা কম্পাউন্ডে প্রবেশ করে আল্লাহু আকবর স্লোগান দিতে থাকে এবং ইমরানের মুক্তি দাবি করে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে দেশটির সামরিক বাহিনী তিনটি অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। সেনাবাহিনী তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সরাসরি দেশ শাসন করেছে এবং রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ভোগ করেছে। ইমরান খানের সমর্থকরা বলছেন, এবার তার নাটকীয় গ্রেপ্তারও সেনাবাহিনীর নির্দেশে ঘটেছে। লাহোরে সামরিক কমান্ডারের বাসভবনে হামলার সময় উপস্থিত বিক্ষোভকারী আজিজ আলজাজিরাকে বলেছিলেন, আমাদের রেডলাইন ইমরান খান। আপনি যখন দেখেন যে তার সাথে এত বর্বরতা ঘটেছে এবং যেভাবে তাকে অপহরণ করা হয়েছে, তার অবশ্যই একটি সীমা থাকা উচিত। সবকিছুর একটা সীমা আছে। আপনি যখন তা অতিক্রম করেন, তখন বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

ব্লুমবার্গে এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, খানের গ্রেপ্তারের জন্য কারা দায়ী তা নিয়ে প্রতিবাদকারীদের মনে কোনো সন্দেহ নেই। তারা এজন্য সুস্পষ্টভাবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছে। ইমরানকে গ্রেপ্তার করার জন্য দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরোকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি মূলত পাকিস্তানের রাজনৈতিক অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য গঠন করা হয়েছে। সাবেক সামরিক স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফের সময় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানটিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ এবং তার ভাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা হয়েছে।

সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরো, মিডিয়া এমনকি বিচারকদেরও ব্যবহার করে। ফলে অনেক পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরিবর্তে জনআকাক্সক্ষা ধারণ করে এমন শাসক চান। ইমরান খান তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ করেছেন।

ভারতের আউটলুকের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভ্যুত্থান আগে কখনও ঘটেনি, যদিও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত বেশ কয়েকজন নেতাকে জেনারেলরা ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। পিটিআই সমর্থকরা একটি নজির স্থাপন করেছে। দলটির নেতাকর্মীরা সেনাবাহিনীকে বলেছে, তারা চিরকাল দেশের রাজনৈতিক গতিধারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

মনে করা হয়, ইমরানকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়ার কারণ, তিনি সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্রমাগত কথা বলে আসছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীর সমালোচনা করে তাদের তথাকথিত সুনাম নষ্ট করেছিলেন।

গত নভেম্বরে ইমরানের প্রাণহানির চেষ্টার পর তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, শক্তিশালী গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই হামলার পেছনে ছিল। ইসলামাবাদ থেকে গ্রেপ্তারের আগে পোস্ট করা এক ভিডিওবার্তায় ইমরান জানান, এজন্য দায়ী আইএসআইয়ের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ফয়সাল নাসির।

এরপর সেনাবাহিনী আর বসে থাকতে পারেনি। ইমরানকে সমালোচনা অব্যাহত রাখার সুযোগ দিতে চাননি জেনারেলরা। তাই অন্য একটি মামলায় ইসলামাবাদ হাইকোর্টে জামিনের জন্য গেলে তাকে গ্রেপ্তার করে তার মুখ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু এবার সেনাবাহিনীর ভুল ভাঙছে। তারা দেখতে পাচ্ছে, বিচার বিভাগের বেশিরভাগই ইমরানের সঙ্গে।

পাকিস্তানে কোনো নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে গ্রেপ্তার করার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। সেনাবাহিনীর জন্য অসুবিধাজনক হওয়ায় পাকিস্তান পিপলস পার্টির জুলফিকার আলি ভুট্টো, তার মেয়ে বেনজির ভুট্টো, বেনজিরের স্বামী আসিফ আলি জারদারি থেকে শুরু করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, তার ভাই নওয়াজ শরিফসহ অনেককে বিভিন্ন সময়ে কারাবন্দি করা হয়েছে।

ইমরান খান তার ক্রিকেট প্রতিভার জন্য বেশিরভাগ পাকিস্তানির কাছে একজন নায়ক। তিনি সেই শক্তিকে তার দলের শক্ত ভিত্তিতে রূপান্তরে সক্ষম হন। তাকে গ্রেপ্তারের পর তার বেশিরভাগ সমর্থক পাকিস্তানজুড়ে সহিংস আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। তাদের বেশিরভাগই তরুণ এবং তারা তাদের নেতার জন্য মরতেও প্রস্তুত। এই ধরনের উন্মত্ত সমর্থন সম্ভবত ইমরানকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সাহস জুগিয়েছে। তিনি মনে করেন, রাস্তার শক্তি সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে পারে। একবার তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানি জেনারেলরা উন্মত্ত জনতাকে ভয় পায়। এবার তার সেই ধারণাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

পাকিস্তান আর্মি যুদ্ধে পরাজিত হলেও এর আগে রাজনীতির খেলায় কখনও হারেনি। ৭৫ বছর ধরে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে দেশটির শাসনক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করছে তারা। তবে এবার সেই অবস্থার খুব সম্ভবত পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। জননন্দিত নেতা ইমরান খানের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমে পরাজিত হতে যাচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে সোভিয়েত ও আমেরিকান বাহিনীকে পরাজিত করেছে। রাশিয়ার কেজিবি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএকেও নাস্তানাবুদ করেছে তারা। নিজ দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশটির প্রধানমন্ত্রীদের নিয়োগ, বরখাস্ত করা, জেল কিংবা নির্বাসন পাঠানো, এমনকি হত্যাও করতে পারে। কিন্তু প্রবল ক্ষমতাধর সেই বাহিনী ইমরান খানের কাছে পরাজয়ের আশঙ্কায় ভুগছে।

মনে করা হচ্ছে, ইমরান খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন। ইমরান খানের এই শক্তিশালী অবস্থান উপমহাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত ।

বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক অধ্যয়ন বিভাগের গবেষক উমর করিম মিডল ইস্ট আইয়ে এক নিবন্ধে বলছেন, শেষ পর্যন্ত ইমরান খান সামরিক বাহিনীকে হটিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেন। গবেষক উমর করিম লিখেছেন, ইমরান খানকে পদ থেকে অপসারণের পরও তিনি রাজনৈতিক দৃশ্যপট ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেছেন। ইমরান সফলভাবে তার জনপ্রিয়তার ব্র্যান্ডকে অস্ত্রে পরিণত করেছেন। তিনি জাতীয় সার্বভৌমত্বের নীতি এবং পশ্চিমা-বিরোধী বক্তব্যের ওপর বেশি নির্ভর করে কয়েক মাস ধরে দেশটির সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করে টিকে আছেন। পাকিস্তানে এমনটা আগে কখনও দেখা যায়নি।

প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সরকার দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে বা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করতে ব্যর্থ হয়েছে। এটা ইমরান খানের রাজনৈতিক পুঁজিতে পরিণত হয়েছে। শাহবাজ শরীফ সরকার এখন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এসব ঘটান প্রবাহ ইমরান খানকে আরও জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।

পাকিস্তানের নেতারা এর আগেও রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। তবে তারা এই বাহিনীকে দুর্বল করতে সফল হয়নি। সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ইমরান খান এখন যা করছেন, তার আগে জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং নওয়াজ শরিফও তাই করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হননি। কারণ, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কোনো নেতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে রাজনীতিতে তার মৃত্যুকথা রচিত হয়। তবে জুলফিকার আলী ভুট্টো , বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরীফ বা অন্য কোনো পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ ইমরান খানের মত এতো জনপ্রিয় ছিলেন না।

ইন্ডিয়া টুডেতে পাকিস্তানের প্রভাবশালী কূটনীতিক হোসেইন হাক্কানি বলছেন, এবারের ঘটনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার কোরের মধ্যেও বিভক্তির জল্পনা চলছে। সামরিক পরিবারের মধ্যে ইমরান খানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে।

গত তিন দশক ধরে সেনা পরিবারগুলো দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনীতিবিদদের ঘৃণা করে আসছিলেন। তাদের বেশিরভাগই অতি সরল দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে, যে পাকিস্তানের একমাত্র সমস্যা হল রাজনীতিবিদরা। তারা বিশ্বাসঘাতক। তবে তাদের দৃষ্টিতে ইমরান খান তেমন নন। সামরিক বাহিনীর অনেকের কাছে তিনিই একমাত্র গ্রহণযোগ্য বেসামরিক নেতা। ইমরানের দলে রয়েছে সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া উল হকের ছেলে, পাকিস্তানের প্রথম অভ্যুত্থানকারী ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের নাতি এবং জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সমস্ত বড় বেসামরিক সহযোগীরা।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবার সত্যিই কঠিন পরীক্ষায় পড়েছে। এই পরীক্ষায় তারা পেশাদারিত্বের প্রমাণ দিলে দেশটিতে গণতন্ত্র বিকাশের পথ উন্মোচিত হবে। ইমরানকে রাজনীতির মাঠ থেকে সরিয়ে দেওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব। এই বাস্তবতা মেনে নেওয়াই এই বাহিনীর জন্য হবে কল্যাণকর।