ওয়াগনার নিয়ে জটিলতায় রাশিয়া

ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন - সংগৃহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ১২ মে ২০২৩, ১৮:০৫

ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধাদের সংগঠন ওয়াগনার গ্রুপ বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির কবলে পড়েছে। বিশেষ করে পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ শহর বাখমুত দখলের লড়াইয়ে ইউক্রেনের সেনাদের হামলায় হতাহত হয়েছে অনেক ওয়াগনার যোদ্ধা। গত কিছুদিনের লড়াইয়ে বাখমুতসহ কয়েকটি এলাকায় ওয়াগনারের ৯ হাজার যোদ্ধা নিহত ও আহত হয়েছে বহু যোদ্ধা। এদের অধিকাংশকেই রাশিয়ার বিভিন্ন কারাগার থেকে বের করে প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধে পাঠানো হয়। কিন্তু মস্কো ওয়াগনার যোদ্ধাদেরকে প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ না করায় তারা প্রাণ দিয়েছে সম্মুখ যুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রিক্রুট করা যোদ্ধাদের ৬৫ শতাংশই হারিয়েছে। ফলে ওয়াগনারের লোকবল সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। একই সাথে দেখা দিয়েছে সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদসহ প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জামের সংকট।

যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, ইউক্রেন যুদ্ধে ওয়াগনার গ্রুপের ৩০ হাজার যোদ্ধা হতাহত হয়েছে। এদের মধ্যে যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে নিহত হয়েছে ৯ হাজার। যোদ্ধার এই ঘাটতি পূরণে সম্প্রতি রাশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন শহরে সেনা নিয়োগ কেন্দ্র খুলেছে ওয়াগনার।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধে এ পর্যন্ত রাশিয়ার আনুমানিক এক লাখ ৯০ হাজার থেকে ২ লাখ ২৩ হাজার সেনা হতাহত হয়েছে। এদের মধ্যে নিহত হয়েছে ৩৫ হাজার ৫শ থেকে ৪৩ হাজারের মতো। বাকি সেনারা আহত হয়েছে। অন্যদিকে, ইউক্রেনের হতাহত সেনার সংখ্যা ১ লাখ ২৪ হাজার ৫০০ থেকে ১ লাখ ৩১ হাজার। এদের মধ্যে নিহত সেনার সংখ্যা ১৫ হাজার ৫০০ থেকে ১৭ হাজার ৫০০ এর মধ্যে। বাকিরা আহত হয়েছে।

পশ্চিমা গোয়েন্দা সূত্রগুলোর মতে, বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধের ময়দানে ওয়াগনার গ্রুপের মোট যোদ্ধার ৯০ শতাংশই সংগ্রহ করা হয়েছে রাশিয়ার বিভিন্ন কারাগার থেকে। তাদেরকে দণ্ড থেকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি অথবা বেতনের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন শুরুর সময় থেকেই এই নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। কিন্তু এসব যোদ্ধাদেরকে প্রয়োজনীয় সমরাস্ত্র, গোলাবারুদ ও আনুষঙ্গিক উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করে আসছেন ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন। ফলে মস্কোর সাথে ওয়াগনারের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে।

গ্রুপটির প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিনের দাবি, নথিতে সইয়ের পরও প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ দিচ্ছে না মস্কো। এতে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় ডোনেৎস্কের গুরুত্বপূর্ণ শহর বাখমুতে ঝুঁকিতে পড়েছে তার বাহিনী। একই সঙ্গে দ্রুত অস্ত্র দেওয়া না হলে যুদ্ধের সামনের সারি ভেঙে পড়ার আশঙ্কার কথাও জানান তিনি। ওয়াগনার যোদ্ধারা ইউক্রেনীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে মরনপণ লড়াই করলেও রুশ সেনারা কেবল মুখ বাঁচানোর লড়াই করছে বলেও অভিযোগ করেন প্রিগোজিন।

সম্প্রতি পৃথক ভিডিও এবং পোস্টে ওয়াগানার সেনাদের জন্য বিভিন্ন দাবির কথা জানান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন। গোলাবারুদ না দেওয়াকে ‘সাধারণ আমলাতন্ত্র বা বিশ্বাসঘাতকতা’ বলেও অভিহিত করেছেন প্রিগোজিন। গোলাবারুদ সরবরাহ না করার অভিযোগ উত্থাপনের পর ওয়াগনার গ্রুপের প্রতিনিধিকে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সদরদপ্তরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে মস্কো। প্রিগোজিন সম্প্রতি এক টেলিগ্রামে জানান, তার প্রতিনিধিকে রুশ সামরিক সদর দপ্তরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।

ইউক্রেনে কয়েক হাজার সেনা রয়েছে ওয়াগনার গ্রুপের। এদের অনেকেই সাজাপ্রাাপ্ত আসামি। যুদ্ধ শুরুর পর তাদেরকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে সরাসরি যুদ্ধে পাঠায় রাশিয়া। এই বাহিনীর যোদ্ধারাই পরে মস্কোর হামলার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। টানা কয়েক মাস ধরে পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্কের গুরুত্বপূর্ণ শহর বাখমুত দখলে লড়াই করে যাচ্ছে তারা। কিন্তু এখন অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ নিয়ে ওয়াগনার এবং মস্কোর মধ্যে সম্পর্ক ক্রমশই হয়ে উঠছে উত্তেজনাপূর্ণ ।

প্রিগোজিন বলেন, গত ২২ ফেব্রুয়ারি গোলাবারুদ সরবরাহের নথিতে সই করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ গোলাবারুদই পাঠানো হয়নি। তার দাবি, এটি ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে। এর আগে পোস্ট করা এক ভিডিওতে প্রিগোজিনকে বলতে দেখা যায়, ইউক্রেনে যুদ্ধে রাশিয়া হেরে গেলে এর জন্য তাদেরকে দায়ী করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে তার যোদ্ধারা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার সম্প্রতি জানিয়েছে, ইউক্রেনীয় বাহিনী পূর্ব বাখমুতে রুশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ অব্যাহত রেখে তাদের বড় ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

প্রিগোজিন অভিযোগ করে বলেন, রুশ কর্তৃপক্ষ তার যোদ্ধাদের বখাটে হিসেবে চিহ্নিত করে এবং এ কারেণই গোলাবারুদ দিচ্ছে না। শুধু গোলাবারুদই নয়, অস্ত্রও দিচ্ছে না। তাছাড়া কারাবন্দিদের মুক্ত করে লোকবলের ঘাটতিও পূরণ করছে না। তার সেনা ছাড়া রাশিয়ার ফ্রন্টলাইন ভেঙে পড়বে বলেও দাবি করেন তিনি।

এর আগে প্রিগোজিন অভিযোগ করেছিলেন, প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং চিফ অব দ্য জেনারেল স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভ তার সৈন্যদের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন। এছাড়া আহত সেনাদের চিকিৎসা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব ওয়াগনার বাহিনীর শক্তিকে কমিয়ে দিয়েছে অনেকটাই। বাখমুতে মারাত্মক ক্ষতির কথা স্বীকার করে এক পর্যায়ে ওয়াগনার যোদ্ধাদের লাশের সারির ভয়ঙ্কর ছবিও পোস্ট করেছিলেন প্রিগোজিন।

যোদ্ধার ঘাটতি পূরণে রাশিয়ার ৪২টি শহরে নিয়োগ কেন্দ্র খুলছে গ্রুপটি। বাহিনীর প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন জানিয়েছেন, তিনি বাখমুতের যুদ্ধে বড় ক্ষতি পূরণ করতে নতুন করে যোদ্ধা নিয়োগ করতে চান। সম্প্রতি এক অডিও বার্তায় প্রিগোজিন বলেন, কেন্দ্রগুলোতে গিয়ে নতুন যোদ্ধারা তালিকাভুক্ত হচ্ছে। তবে তিনি সেই সংখ্যা উল্লেখ করেননি।

তিনি আরও বলেন, রুশ সেনাবাহিনী থেকে গোলাবারুদ সরবরাহের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। ২০২৩ সালে উৎপাদিত গোলাবারুদ তাদের দেওয়া হয়েছে জানালেও গোলাবারুদ সংকট এখনো উদ্বেগের বিষয় বলে উল্লেখ করেন তিনি। তবে ইউক্রেনীয় বাহিনীর প্রবল প্রতিরোধ সত্ত্বেও ওয়াগনার সেনারা এগিয়ে যাবে বলে দাবি করেন প্রিগোজিন। তিনি তার বাহিনীর জন্য কেবলমাত্র রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল না থেকে তুরস্ক, মালি, লিবিয়া ও সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সমরাস্ত্র সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন। ওয়াগনার যোদ্ধারা সক্রিয় রয়েছে এসব দেশে।

ওয়াগনার যোদ্ধারা বাখমুতের নিয়ন্ত্রণ নিতে প্রচন্ড হামলা চালালেও ৮ মাসেরও বেশি সময় ধরে ইউক্রেনীয় বাহিনীর প্রতিরোধের কারণে পুরো শহরটি দখল করতে পারেনি তারা। ওয়াগনার যোদ্ধাদের সাথে রাশিয়াও সেখানে তাদের প্রশিক্ষিত সেরা ইউনিটগুলো মোতায়েন করেছে।

যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, বখমুত এরই মধ্য মৃত্যুকূপে পরিনত হয়েছে। দেশটির সর্বশেষ গোয়েন্দা আপডেটে বলা হয়েছে, পূর্ব বাখমুতের বেশিরভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে ওয়াগনার গ্রুপ। আর শহরের পশ্চিমের অংশের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। তারা ধ্বংস করেছে বাখমুতকা নদীর প্রধান সেতুগুলোও।

‘মিডল ইস্ট আই’ জানিয়েছে, বাখমুতের যুদ্ধে রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি ও প্রানহানি বেড়েই চলেছে। আর এর ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে ওয়াগনার গ্রুপ ও রুশ সেনাদের মধ্যে সম্পর্কেরও অবনতি হচ্ছে দিন দিন। রুশ বাহিনী ওয়াগনারের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠছে এবং গ্রুপটির সাহায্যের আবেদনে সাড়া দিচ্ছে না। এব্যাপারে একটি সূত্র বলছে, ওয়াগনার গ্রুপের লজিষ্টিক সমস্যা যুদ্ধে ইউক্রেনের সেনাদের চেয়ে রুশ সেনাদের অধিক মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠেছে।

ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর একটি সূত্র মিডল ইস্ট আইকে জানিয়েছে, ওয়াগনারের অধিকাংশ যোদ্ধাই এখন আর লড়াইয়ে অংশ নিতে সক্ষম নয়। এদের অধিকাংশই নিহত অথবা আহত হয়েছে বাখমুতের যুদ্ধে। আহতদের অনেকের পক্ষেই আর যুদ্ধের ময়দানে ফিরে আসা সম্ভব হবে না।

লজিষ্টিক সমস্যার সমাধান না করে বরং আরো বেশি যোদ্ধা সংগ্রহের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন ওয়াগনার প্রধান। তবে এখন আর তিনি রাশিয়ার কারাগারগুলো থেকে যোদ্ধা সংগ্রহ করতে পারছেন না। রুশ হাইকমান্ডের সাথে তার মতবিরোধ তীব্র হয়ে উঠার কারণে তিনি কারাগারগুলোতে আর প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছেন না। এছাড়া রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় সারাদেশে নতুন সেনা নিয়োগের উদ্যোগ নেয়ায় ওয়াগনার গ্রুপের পক্ষে কারাগারের বাইরে থেকে লোকজন নিয়োগ বা সংগ্রহ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।

ওয়াগনার প্রধান রাশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের স্থানীয় আদিবাসীদের দিকে নজর দিয়েছেন। তবে এই অঞ্চল তেকে ওয়াগনার এ পর্যন্ত কতগুলো যোদ্ধা সংগ্রহ করতে পেরেছে সে ব্যাপারে কোন সুস্পষ্ট তথ্য দিতে পারেনি রাশিয়ার সরকারি সূত্রগুলো। ওয়াগনার গ্রুপের পক্ষ থেকেও এ সম্পর্কে কোন কথা বলা হচ্ছে না।

ব্রিটিশ গোয়েন্দা সূত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ওয়াগনার গ্রুপের সাথে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বন্দ্বের কারণে এখন মন্ত্রনালয় ওয়াগনারের বিকল্প কোন কুখ্যাত বেসরকারি যোদ্ধা গ্রুপের সন্ধান করছে।