ইউক্রেন নিয়ে পশ্চিমের ঐক্য ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে

ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পশ্চিমাদের মধ্যে যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, সেই ঐক্য ভেঙ্গে পড়ার নানা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে - আনাদুলু

  • হায়দার সাইফ
  • ২৪ জুন ২০২২, ১৮:৫৬


ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পশ্চিমাদের মধ্যে যে ঐক্য গড়ে উঠেছে, সেই ঐক্য ভেঙ্গে পড়ার নানা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যায় বেহিসেবি বেড়ে যাওয়ায় পশ্চিমা নেতাদের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ বাড়ছে। যুদ্ধ কত দীর্ঘ হবে, তা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। কিছু কৌশলবিদ মনে করছেন, সমস্ত লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধে কোন পক্ষই জয়ী হবে না, এবং দুই পক্ষেরই যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হবে। একটা লম্বা সময় ধরে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কাও দেখতে পাচ্ছেন তারা। 
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, আর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো তাদের অবস্থান থেকে ছাড় দিতে রাজি নয়। তারা রাশিয়াকে কোনভাবেই ইউক্রেনে সফল হতে দিতে চায় না। তারা বলছে, রাশিয়া ইউক্রেনে সফল হলে এর বড় ধরণের বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হবে।
তারা এটাও স্পষ্ট করেছে যে, ইউক্রেনই সিদ্ধান্ত নেবে আদৌ তারা রাশিয়ার সাথে আলোচনায় বসবে কি না, বা বসলে সেটা কখন। কিয়েভ বলেছে, তারা আলোচনার ব্যাপারে আগ্রহী, কিন্তু তাদের কিছু সীমারেখা আছে। তাদের প্রধান শর্ত হলো, রাশিয়ার কাছে কোন ভূখন্ড তারা ছাড়বে না। তবে, ফ্রান্স, ইটালি, ও জার্মানিসহ ইউরোপের একটা অংশ চাচ্ছে, যাতে দুই পক্ষের মধ্যে একটা শান্তি চুক্তি হয়। যত দ্রুত হয়, ততই ভালো। ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো বলেছেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেন্সকি এবং তার কর্মকর্তাদেরকে রাশিয়ার সাথে এক সময় আলোচনায় বসতেই হবে।

ফ্রান্স, জার্মানি আর ইটালির সরকার প্রধানরা সম্প্রতি কিয়েভ সফর করেছেন। সেখানে তারা সবাই অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন এবং আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ করার পরামর্শ দিয়েছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের প্রতিও তারা জোর দাবি জানিয়েছেন, যাতে জেলেন্সকির সাথে তিনি শান্তি আলোচনায় বসেন। এদিকে, ইউক্রেন পশ্চিমা মিত্রদের কাছে আরও অস্ত্র চেয়েছে।

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে বেশ বড় ধরনের অগ্রগতি করেছে। লুহান্স ও ডোনেৎস্ক এলাকায় রাশিয়ান বাহিনী ধীরে হলেও এগিয়ে যাচ্ছে, এবং নতুন নতুন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। এই দুই এলাকায় রাশিয়া-পন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠি রয়েছে, যারা তাদের এলাকার স্বাধীনতা চায়। পশ্চিমারাও ইউক্রেনকে সাহায্য দেয়া অব্যাহত রেখেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি বলেছেন, তার প্রশাসন কিয়েভে আরও এক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র, আর ২২৫ মিলিয়ন ডলারের মানবিক সহায়তা পাঠাবে। কিন্তু কিয়েভ মনে করছে, তারা সময়মতো অস্ত্র পাচ্ছে না।

এখন প্রশ্ন উঠেছে, সামরিক সঙ্ঘাত যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে কতদিন ধরে এভাবে ইউক্রেনকে সামরিক সহযোগিতা দিতে পারবে পশ্চিমা দেশগুলো?
পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কিরবিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ইউক্রেনের পেছনে কতটা ব্যায় করতে রাজি আছেন বাইডেন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নিজের দেশেই মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তা মূল্য সূচক আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮দশমিক ৬ শতাংশ বেড়েছে। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরের পরে এই হার সর্বোচ্চ। ইউরোপের অবস্থাও একই রকম। এপ্রিলে ব্রিটেনে মূল্যস্ফীতির হার ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে।
কিরবি বলেন, ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যতদিন ধরে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করে যাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, মার্কিন কংগ্রেস ইউক্রেনের জন্য যে ৪০ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্যাকেজের অনুমোদন দিয়েছে, তার সামান্য একটা অংশই মাত্র এখন পর্যন্ত দেয়া হয়েছে।

কিরবি জানিয়েছেন, ৪০ বিলিয়ন ডলারের একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র ইউক্রেনকে দেয়া হয়েছে। এখনও অনেক দূর যেতে পারবো আমরা। সেটা কতদিন টিকবে? যুদ্ধই বা কতদিন টিকবে, সেটা কারোর পক্ষেই এখন বলা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আমরা ইঙ্গিত দিয়েছিলাম যে, ডোনবাসের যুদ্ধ ধীরে এগুবে। সেখানকার লড়াইটা সম্ভবত অনেক মাস ধরে চলবে। সেটাই আমরা এখন ঘটতে দেখছি। ২৪ ফেব্রুয়ারি যখন রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান শুরু হয়েছিল, তখন পশ্চিমা দেশগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।

দিন যত যাচ্ছে, পশ্চিমা নেতারা ততই জনগণের চাপের মুখে পড়ছে। যুদ্ধের কারণে সরবরাহ চেইন ব্যাহত হওয়ায় এবং রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় খাবার ও জ্বালানির দাম বেড়ে গেছে। এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ভোক্তাদের উপর।


পশ্চিমা দেশগুলোর কর্মকর্তারা যে সঙ্কটের মধ্যে পড়েছেন, সেটাকে সংক্ষেপে তুলে ধরেছেন আরবিসি ক্যাপিটাল মার্কেটের বৈশ্বিক ভোক্তা কৌশল ও এম.ই.এন.এ গবেষণা বিভাগের প্রধান হেলিমা ক্রফট। তিনি বলেছেন, পশ্চিমা নেতারা ইউক্রেনকে সহায়তা করতে চান। আবার দেশের ভেতরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাধ্যবাধকতা তাদের উপরে রয়েছে। এই দুইয়ের মধ্যে তারা ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছেন। কিন্তু যে প্রশ্নটি এখানে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তহলো, এ জন্য কতটা মূল্য দিতে তারা প্রস্তুত?
এই বিভাজনের একটা ভৌগলিক মাত্রাও দেখতে পাচ্ছেন ক্রফট। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, আর পূর্ব ইউরোপিয় দেশগুলোর নেতাদের মনোভাব হলো, ইউক্রেনিয়ানরাই ঠিক করবে কোনটা তাদের জন্য ন্যায্য। ইউক্রেনের ভৌগলিক অখন্ডতা রক্ষার ব্যাপারে তারা দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। কিন্তু মহাদেশীয় ইউরোপ এবং উন্নয়নশীল বহু দেশের নেতারা চাচ্ছেন যাতে ইউক্রেন রাশিয়ার সাথে একটা বোঝাপড়ায় যায়। এমন একটা সমঝোতা, যেখানে পুতিন তার সম্মান ধরে রেখে পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবেন।
ক্রফট জানান, তিনি বেশ কিছু বৈঠক ও পলিসি ফোরামে অংশ নিয়েছেন, যেখানে তিনি অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে এই সুস্পষ্ট বিভাজন দেখেছেন। একদল ইউক্রেনকে আরও জোরালোভাবে সামরিক সহায়তা দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। অন্য দল ইউক্রেনকে কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও আলোচনার টেবিলে বসার পরামর্শ দিচ্ছে। কারণ হিসেবে তারা ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কথা বলছেন, যেটা নিয়ন্ত্রণ করা দিন দিন অসম্ভব হয়ে পড়ছে।

পুরো ইউরোপ জুড়ে চালানো এক জরিপের ফল সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানেও দেখা গেছে, ইউক্রেনকে ঘিরে পশ্চিমাদের মধ্যে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, সেখানে চির ধরতে শুরু করেছে। জরিপটি চালিয়েছে থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশান্স। তারা দেখতে পেয়েছেন, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য যে মূল্য দিতে হচ্ছে, এবং যেভাবে পারমানবিক যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়ছে, সেটা নিয়ে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। ২৮ এপ্রিল থেকে ১১ মে ইউরোপিয় ইউনিয়নের নয়টি দেশের আট হাজারের বেশি মানুষের মধ্যে ওই জরিপ চালানো হয়।


জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৩৫ শতাংশ চান, যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধ শেষ হোক। এজন্য ইউক্রেনকে যদি তাদের কিছু ভূখন্ড রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দিতেও হয়, তবু সেটা দেয়া উচিত। ২২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন, তারা দেখতে চান যে রাশিয়া তার শাস্তি পেয়েছে। এ জন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলেও তাদের আপত্তি নেই। পাশাপাশি বহু সংখ্যক মানুষ বলেছে, তাদের সরকার জনগণের জীবনযাত্রার ব্যায় বৃদ্ধির ইস্যুর চেয়ে যুদ্ধকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। এটি নিয়ে তারা অসন্তুষ্ট। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই মনে করছেন, যুদ্ধ যত দ্রুত সম্ভব শেষ হওয়া দরকার। কারণ এই যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে ইউরোপিয় ইউনিয়ন।
জরিপের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, নাটকীয় কোন পরিবর্তন না হলে, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত না করার পক্ষে অধিকাংশ ইউরোপিয়রা। শুধুমাত্র পোল্যান্ড, জার্মানি, সুইডেন, আর ফিনল্যান্ডে, বেশির ভাগ মানুষ চাচ্ছে যাতে ইউক্রেনের জন্য সামরিক সহযোগিতা আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়।