এখন জোট নিরপেক্ষতা আর শান্তির সময়


  • হায়দার সাইফ
  • ০৬ মে ২০২২, ০৮:১৩

যুদ্ধ মানবিক অভিজ্ঞতার একটা কুৎসিত দিক। এর সাথে জড়িত সবকিছুই ভয়ঙ্কর। যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে আগ্রাসন আর বর্বরতা। প্রতিটি অভিযানের সাথেই যেগুলোর প্রকাশ ঘটে। কোন যুদ্ধই সুনির্দিষ্ট হিসাব অনুসারে চলে না। সবখানেই বেসামরিক মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। প্রতিটি বোমা হামলার ঘটনায় সমাজের মেরুদণ্ড দিয়ে মনস্তাত্ত্বিক ঝড় বয়ে যায়। মানব ইতিহাসে যুদ্ধ দিয়ে কোন বড় সমস্যার সমাধান করা যায়নি। পৃথিবী এখন যে বড় সঙ্কটের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আলোচনা, আর শান্তির দিকে ঝুঁকতে হবে। যুদ্ধে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বৈষয়িক স্বার্থ রয়েছে। তাই শান্তির ধারণার পক্ষে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বিস্তারিত থাকছে হায়দার সাইফের প্রতিবেদনে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হলোকাস্ট আর হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে যুদ্ধের কুৎসিত চেহারা মানুষ দেখতে পেয়েছে। হিরোশিমা আর হলোকাস্ট থেকে দুটো শক্তিশালী আন্দোলনের জন্ম হয়েছে। একটি হলো শান্তি আর পারমানবিক হামলার বিপর্যয় বিরোধী আন্দোলন। অন্যটি হলো মানবজাতির বিভাজনের মধ্যে ইতি টানার আন্দোলন এবং এই সব বিভাজনের প্রশ্নে জোট নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ।

১৯৫০ সালের স্টকহোম আপিলে ৩০০ মিলিয়ন মানুষ স্বাক্ষর করেছিল। সেখানে পারমানবিক অস্ত্রকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার ডাক দেয়া হয়েছিল। পাঁচ বছর পর, আফ্রিকা ও এশিয়ার ২৯টি দেশ - যে দেশগুলো পৃথিবীর ৫৪ শতাংশ জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে, তারা ইন্দোনেশিয়ার বানডুংয়ে জড়ো হয়েছিল। সেখানে তারা যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং পারস্পরিক স্বার্থ ও সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য ১০ দফা ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছিল।

বানডুং ঘোষণার মূল বিষয় ছিল শান্তি এবং জোট নিরপেক্ষতা। আর মানব সভ্যতার উপর নিরক্ষরতা, অসুস্থতা, ক্ষুধার মতো ইতিহাসের যে বোঝা রয়েছে, সামাজিক সম্পদকে ব্যবহার করে সেগুলো পৃথিবী থেকে নির্মূল করা। যেখানে শ্রেণীকক্ষ আর হাসপাতালে অর্থ ব্যায়ের সুযোগ রয়েছে, সেখানে পারমানবিক অস্ত্রের পেছনে কেন অর্থ ব্যায় করা হবে?

ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বেরিয়ে আসা বিশ্বের অনেকগুলো নতুন দেশ বানডুং ঘোষণা থেকে উপকৃত হয়েছে। তবু, পুরনো ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর যে বিপুল ক্ষমতা, সেটা বানডুং ঘোষণাকে মানব সভ্যতার উপর প্রভাব ফেলতে দেয়নি। এর চেয়ে বরং যুদ্ধের সভ্যতাকে তারা এগিয়ে নিয়ে গেছে।

এই যুদ্ধ সভ্যতার বৈশিষ্ট্য হলো - সশস্ত্র বাহিনী গড়তে বিপুল মানব সম্পদের অপচয় হয়েছে। যে পরিমাণ ধ্বংসাত্মক অস্ত্র তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো দিয়ে শত শত গ্রহ ধ্বংস করে দেয়া যায়। তার চেয়ে বড় সমস্যা হলো, যে কোন বিবাদ মেটাতে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়েই এই সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করা।

১৯৫০ এর দশক থেকে এই সব উচ্চাকাঙ্ক্ষী শক্তিগুলোর যুদ্ধক্ষেত্র কখনই ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকাতে ছিল না। তাদের যুদ্ধক্ষেত্র ছিল সবসময় আফ্রিকা, এশিয়া, এবং ল্যাটিন আমেরিকা। এই সব অঞ্চলে পুরনো ঔপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে এই ধারণা ছড়ানো হয়েছে যে, মানব জীবনের মূল্য খুব বেশি নয় এবং একে বেশি গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন নেই।

মানব জাতির মধ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে বিভেদ সৃষ্টি করা হয়েছে, সেই বিভেদের সূত্র মতে ইয়েমেনে যুদ্ধ হলে সেটা স্বাভাবিক বিষয়, কিন্তু ইউক্রেনে যুদ্ধ হলে সেটা ভয়াবহ। আমাদের বর্তমান সময়টা এভাবেই সংজ্ঞায়িত হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ৪০টার মতো ছোট বড় যুদ্ধ চলছে। এই সবগুলো যুদ্ধ শেষ করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। শুধু ইউরোপে যেটা হচ্ছে, সেটা বন্ধ করলেই চলবে না।

ইউক্রেনের পতাকাকে পুরো পশ্চিমে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইয়েমেনের পতাকা, সাহরাওয়ি পতাকা, বা সোমালি পতাকার কি রং, সেটা কি পশ্চিমের কেউ বলতে পারবে?

এখন আমাদের সামনে যে সব নিশ্চয়তার কথা বলা হচ্ছে, এগুলো যেন বাস্তবতা থেকে অনেক অনেক দূরে। ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ একদিকে চলছে। অন্যদিকে, এই অবাক করা দৃষ্টিভঙ্গি ছড়ানো হচ্ছে যে, আলোচনা এখানে অর্থহীন। বুদ্ধিমান ও মানবিকতা সম্পন্ন মানুষেরা যখন বলছে যে, অবশ্যই আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটাতে হবে, তখনও এই ক্ষতিকর দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।

আলোচনার ইচ্ছা থাকলে একটা অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দিয়ে আলোচনার পরিবেশ কেন তৈরি করা হচ্ছে না? সব পক্ষের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলেই কেবল আলোচনা সম্ভব। আরেকটা বিষয় সব পক্ষকেই বোঝার মানসিকতা রাখতে হবে যে, একটা সামরিক সঙ্ঘাতের মধ্যে সব পক্ষেরই কিছু যুক্তিসঙ্গত দাবি থাকে।

যারা ইউক্রেন যুদ্ধকে শুধুমাত্র রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের একটা হঠকারিতা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে, তারা যুদ্ধটাকে একটা স্থায়ী রূপ দিতে চায়। ইউক্রেনের জন্য নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি রাশিয়ার নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতিও গুরুত্বপূর্ণ। উভয় পক্ষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে সব পক্ষকেই শেষ পর্যন্ত গুরুত্বের সাথে আবার আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিতে ফিরে যেতে হবে।

মুখে মুখে শুধু চাইলেই শান্তি আসবে না। বিশ্বের যে সব কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠান থেকে চিন্তা ও ধারণার প্রসার ঘটে, সেখানে এই শান্তির ধারণার পক্ষে লড়াই করতে হবে।

ক্ষমতায় যে সব রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে, তারা যুদ্ধ থেকে লাভবান হয়। সুতরাং তারা অস্ত্র ব্যবসায়িদের পক্ষ হয়ে কাজ করে যায়। এই অস্ত্র ব্যবসায়ীরা সব সময়ই বেশি বেশি যুদ্ধ চায়। যুদ্ধ বন্ধ হোক, সেটা তারা চায় না।

এই নীল স্যুট টাই পরা আমলাদের উপর বিশ্বের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেয়া যাবে না। জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রশ্নে তারা আমাদেরকে হতাশ করেছে। মহামারী মোকাবেলার প্রশ্নে তারা ব্যর্থ হয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও তারা কিছুই করতে পারছে না। আমাদেরকে শান্তি এবং জোট নিরপেক্ষতার পুরনো চেতনাকে ফিরিয়ে আনতে হবে, এবং এগুলোকে একটা গণ আন্দোলনের রূপ দিতে হবে। এটাই এই গ্রহের জন্য সর্বশেষ আশার স্থল।

আজকের জোট নিরপেক্ষতার আন্দোলনে প্রাণ সঞ্চারের জন্য অতীতে ফিরে যাওয়াটা হবে একটা আবেগ-নির্ভর সিদ্ধান্ত। বর্তমান সময়ের মধ্যে যে সব বৈপরিত্য রয়েছে, সেগুলোর কারণে আফ্রিকা, এশিয়া, এবং ল্যাটিন আমেরিকার পুরনো জোট নিরপেক্ষ দেশগুলোর মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এই সব অধিকাংশ দেশি রাশিয়াকে নিন্দা জানানোর প্রস্তাবে ভোট দেয়নি। তারা যে, ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধকে সমর্থন দিচ্ছে, তা নয়। বরং রাশিয়াকে বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দিলে যে বিপর্যয় আসতে পারে, সেই আশঙ্কা থেকে তারা রাশিয়ার বিপক্ষে ভোট দেয়া থেকে বিরত থেকেছে।

শীতল যুদ্ধকালিন সময়ে বিশ্বে যে দুই মেরুর ব্যবস্থা ছিল, সেখান থেকে এখন বেরিয়ে আসতে হবে। আর সে কারণেই চীনের শি জিনপিং থেকে নিয়ে ভারতের নরেন্দ্র মোদি, দক্ষিণ আফ্রিকার সিরিল রামাফোসা-সহ বিশ্বের অনেক দেশের নেতারাই 'শীতল যুদ্ধের মানসিকতা' থেকে বেরিয়ে আসার ডাক দিয়েছেন। যদিও এই নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে অনেক বৈপরীত্য রয়েছে, তবু তারা একসাথে এই ডাক দিয়েছেন।

তারা এরই মধ্যে নতুন একটি জোট নিরপেক্ষ প্ল্যাটফর্মের দিকে হাঁটতে শুরু করেছেন। ইতিহাসের এই সব বাস্তব পদক্ষেপই আমাদেরকে জোট নিরপেক্ষতা ও শান্তির পুরনো ধারণাগুলো নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে বাধ্য করে।

যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্ররা যদি চীন আর রাশিয়াকে পুরোপুরি ঘিরে ফেলে, তাহলে পরিণতি কি হবে, সেটা নিয়ে কেউই কল্পনা করতে চায় না। এমনকি জার্মানি ও জাপানের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশও এটা স্বীকার করেছে যে, চীন আর রাশিয়াকে যদি চারদিকে লোহার পর্দার আড়ালে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়, তাহলে তাদের নিজের দেশেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

যুদ্ধ আর নিষেধাজ্ঞার কারণে এরই মধ্যে হন্ডুরাস, পাকিস্তান, পেরু, আর শ্রীলঙ্কায় মারাত্মক রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। আরও অনেক দেশে ধীরে ধীরে খাদ্য ও জ্বালানির দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। গরিব দেশগুলোর উপর যুদ্ধের প্রভাব হয় সবচেয়ে ভয়াবহ। যুদ্ধের পেছনে অর্থ ব্যায়ের কারণে মানুষের চেতনা মরে যাচ্ছে। সেই সাথে যুদ্ধ মানুষের সাধারণ দুর্ভোগ তো বাড়াচ্ছেই।

যারা যুদ্ধ তৈরি করছে, তাদেরও এক ধরণের আদর্শ আছে। কিন্তু যুদ্ধ দিয়ে কখনও মানব সভ্যতার বড় বড় সমস্যাগুলোর সমাধান হয়নি। অন্যদিকে, জোট নিরপেক্ষতা আর শান্তির যে ধারণা, সেটা অনেক বাস্তবসম্মত। যে শিশুরা খাবার চায়, শিখতে চায়, খেলতে চায়, আর স্বপ্ন দেখতে চায়, তাদের চাহিদা কেবল এই শান্তির ধারণা কাঠামোর ভেতর দিয়েই পূরণ করা সম্ভব।