তালেবানের সাথে সর্ম্পক ঘনিষ্ট করছে রাশিয়া : ক্ষুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র


  • হায়দার সাইফ
  • ২৭ এপ্রিল ২০২২, ২২:০৮
আফগানিস্তানে তালেবানরা গত বছর ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোন দেশ তাদের সাথে পুরোপুরি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি। তবে তালেবান কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দশটি দেশ ইসলামিক আমীরাত অব আফগানিস্তানের নিযুক্ত ব্যক্তিদের কূটনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নিয়েছে। এদের মধ্যে চারজনকে তালেবান স্বীকৃত কূটনীতিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। গত মাসে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তালেবান কর্মকর্তা জামাল নাসির ঘারওয়ালকে শার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তিনি ৯ এপ্রিল থেকে মস্কোর আফগান দূতাবাসের দায়িত্ব নিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তের মধ্যে রাশিয়ার সাথে আফগানিস্তনের এক ধরণের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলো। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য জানিয়েছে, এই পদক্ষেপের অর্থ এই নয়, তালেবানদের রাশিয়া আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে স্বীকৃতি দেয়ার পথে এটা নিঃসন্দেহে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আফগানিস্তান এখন আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা এড়ানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে রাশিয়ার এই পদক্ষেপ একটা বড় অর্জন। এখন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, মস্কো হয়তো তালেবানদের পুরোপুরি স্বীকৃতি দেয়ার ব্যাপারে প্রথম রাজধানী হতে যাচ্ছে। যদি এটা সম্ভব হয়, তাহলে তা হবে কাবুল সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পথে একটা বড় অর্জন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি স্থায়ী সদস্যের সাথে আনুষ্ঠানিক এই সম্পর্ক স্থাপিত হলে ভবিষ্যতে আফগানিস্তানকে যথেষ্ট সাহায্য করবে। সিনিয়র বিশ্লেষক এবং নিউ লাইন্স ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসির পাওয়ার ভ্যাকিউম কর্মসূচির প্রধান, ক্যারোলিন রোজ মনে করেন, তালেবান নেতা যদি রাশিয়াতে কূটনীতিকের মর্যাদা পায়, তাহলে কাবুলের তালেবান সরকার রাশিয়ার মতো বড় শক্তির সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে যাবে। তালেবানদের চোখে এই অগ্রগতি নিঃসন্দেহে তাদেরকে অনেক বেশি বৈধতা ও আস্থা জোগাবে। তালেবানদের ব্যাপারে ক্রেমলিনের এই মনোভাব পরিবর্তনে নানা সমীকরণ আছে। এমন সময় এটা ঘটলো, যখন পশ্চিমাদের সাথে রাশিয়ার উত্তেজনা স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে নিম্ন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। ইউরোপের ফ্রন্টে যখন চরম উত্তেজনা চলছে, সে অবস্থায় বৃহত্তর মধ্য এশিয়ায় স্থিতিশীলতা ধরে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অস্থিতিশীলতার বিস্তার ঠেকানো, সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর উত্থান প্রতিহত করা এবং এ অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব মোকাবেলা করার মতো বিষয়গুলো রাশিয়ার বিবেচনায় রয়েছে। এই সব স্বার্থের কারণে আফগানিস্তানের সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে মস্কো আর বেইজিংয়ের মধ্যে নীতির দিক থেকে অনেক মিল রয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আফগানিস্তানের সাথে রাশিয়া যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করছে তার পেছনে চীনের সাথে ক্রেমলিনের সম্পর্ক বড় ভূমিকা রাখছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান পরবর্তী আফগানিস্তানে অভিন্ন স্বার্থের জায়গা থেকে বেইজিং আর মস্কো এ ক্ষেত্রে পরস্পরের অনেক কাছাকাছি অবস্থান করছে। রাশিয়ার সরকার তালেবান কূটনীতিকদেরকে মস্কোতে আফগানিস্তানের কূটনৈতিক মিশন পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে। রাশিয়ার মাধ্যমে চীনের কাছাকাছি হওয়ার জন্য এই পদক্ষেপটি তালেবানদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পদক্ষেপের কারণে চীন আফগানিস্তানকে সহায়তা ও বিনিয়োগ দেয়ার ব্যাপারেও উৎসাহিত হতে পারে। ধারণা করা যায়। আফগানিস্তানের কূটনীতিকদের মস্কোর স্বাগত জানানোর অর্থ হলো রাশিয়ার নেতারা সুস্পষ্টভাবে আফগানিস্তানের ব্যাপারে পশ্চিমের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। তালেবান শাসিত আফগানিস্তানের ব্যাপারে আমেরিকা ও ইউরোপিয় সরকারগুলোর যে নীতি, মস্কো সেটা প্রত্যাখ্যান করেছে। রাশিয়ার এই পদক্ষেপের কারণে পশ্চিমাদের বাইরের বিভিন্ন দেশের সরকার উদ্বুদ্ধ হতে পারে, এবং তারা আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে বৈধতা দেয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান পরবর্তী আফগানিস্তানে যে সরকার দেশ চালাচ্ছে, তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা চালাচ্ছে রাশিয়া। এর মাধ্যমে কাবুলের সাথে যৌথভাবে মস্কো এমন সব পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করবে, যার মাধ্যমে এই অঞ্চলে ওয়াশিংটনের সম্ভাব্য পরিকল্পনার মোকাবেলা করা যায়। যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব খর্ব করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া মস্কোতে আফগানিস্তানের দূতাবাসের উপর তালেবানদের নিয়ন্ত্রণ দেয়ার মাধ্যমে রাশিয়া তার মিত্র ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে ইসলামি চরমপন্থার প্রসার বন্ধ করতে চায় বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। অবৈধ মাদক বাণিজ্য ঠেকানোও রাশিয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য। বহু বছর ধরে আফগানিস্তানের হেরোইন সঙ্কটের কারণে রাশিয়াতে বড় ধরণের সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়ে আসছে। সে কারণে মস্কোর কর্মকর্তারা মনে করছেন, তালেবানরা যেহেতু আফগানিস্তানে হেরোইনের উৎপাদন নিষিদ্ধের প্রতিশ্রতি দিয়েছে, সে কারণে কাবুলের সরকারের সাথে সম্পর্কের উন্নতি করা গেলে সেটা রাশিয়ার মাদক সমস্যা মোকাবেলা করতেও বড় ধরণের সাহায্য করবে। আফগানিস্তানের সাথে মস্কোর কূটনৈতিক সম্পর্কের অগ্রগতির এই তাৎপর্য থাকলেও সেটাকে রাশিয়ান পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে খুব বেশি বড় করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ রাশিয়াকে এখন ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে বেশি নজর দিতে হচ্ছে। আর সে কারণেই ক্রেমলিন আফগানিস্তানের দিকে আরও গভীরভাবে নজর দিতে পারছে না। কাবুলকে মস্কো যে পরিমাণ সরাসরি সহায়তা দিতে পারতো, এখন সেটা দেয়ার কথা তারা ভাবতে পারছে না। অবশ্য অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মরে করেন মস্কো কূটনৈতিক ক্ষেত্রে যা করেছে তা কাবুলের উপর রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে খুব বড় কোন পদক্ষেপ নয় । তাদের মতে, ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান এবং সেখানে ভূখন্ডের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য রাশিয়ার সামরিক প্রচেষ্টার কারণে ক্রেমলিনের উপর যথেষ্ট চাপ রয়েছে। সে কারণে আফগানিস্তানে তালেবান নেতৃত্বাধীন সরকারের ব্যাপারে রাশিয়ার পদক্ষেপকে খুব বড় করে দেখার সুযোগ রয়েছে। মস্কোতে আফগানিস্তান দূতাবাসে তালেবান কূটনীতিকদের রাশিয়ার স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্তের নিন্দা জানিয়েছে ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, রাশিয়া এবং অন্যান্য অ-পশ্চিমা দেশগুলো কাবুলে তালেবানদের শাসনকে বৈধতা দেয়ার জন্য যে সব পদক্ষেপ নিচ্ছে তা পশ্চিমাদের প্রচেষ্টার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ, পশ্চিমারা আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন সরকারের উপর চাপ দিয়ে যাচ্ছে, যাতে তারা তাদের নীতিমালায় পরিবর্তন আনে। ওয়াশিংটনের উদ্বেগ হলো রাশিয়া তালেবানদের আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার মাত্রাকে কমিয়ে আনবে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান পরবর্তী আফগানিস্তানে মস্কোর প্রভাব বেড়ে যাবে। ফলে তালেবান সরবার দেশের মধ্যে এবং বৃহত্তর মধ্য এশিয়ায় সব সময় মস্কোর স্বার্থের পক্ষে কাজ করে যাবে। ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়া যেহেতু পরস্পরের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, সে কারণে আরেকটি ইস্যু বিবেচনা থেকে হারিয়ে গেছে। তা হলো, আফগানিস্তানে ওয়াশিংটন আর মস্কোর বেশ কিছু অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। আফগানিস্তানের সবচেয়ে বিপদজনক ও চরমপন্থী শক্তি হলো ইসলামিক স্টেট-কে বা আইএস খোরাসান। এই গ্রুপকে তালেবানরাও বড় ধরণের হুমকি মনে করে। যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়া কেউই চায় না এই গ্রুপটি তাদের দেশে অনুপ্রবেশ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করুক। এখন যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়ার মধ্যে চরম বৈরি সম্পর্ক বিরাজ করছে, সে কারণে মানুষের পক্ষে এখন এটা কল্পনা করা খুবই কঠিন , রাশিয়ার সাথে কাবুলের সম্পর্কের থেকে যুক্তরাষ্ট্রও শেষ বিচারে কিছু লাভবান হবে।