রাশিয়ার তেল কিনেও কিভাবে মার্কিন বন্ধু হয়ে আছে ভারত


  • হায়দার সাইফ
  • ২৭ এপ্রিল ২০২২, ২১:৫৯
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর শুধু রাশিয়া নয়, বরং তার মিত্রদের বিরুদ্ধেও সরব হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্ররা। কিন্তু রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনার পরও পশ্চিমাদের এই তোপের কবলে পড়তে হয়নি ভারতকে। ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার সমালোচনা না করেও পশ্চিমাদের মিত্র হিসেবে টিকে আছে ভারত। এর মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেছেন। দিল্লি সফর করেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে, ইউক্রেন ইস্যুতে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখায় দিল্লি সফর করে ভারতকে ধন্যবাদ দিয়েছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। চীনের মোকাবেলায় ভারতের সহায়তা দরকার বলেই মূলত দিল্লির আচরণকে দাঁত কামড়ে সহ্য করতে হচ্ছে পশ্চিমাদের। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেন সঙ্কটটিকে কাজে লাগিয়ে ভারত বরং আরও মজবুত হয়েছে। বিস্তারিত থাকছে হায়দার সাইফের প্রতিবেদনে। মাত্র কয়েক সপ্তাহেই কত কিছু বদলাতে পারে। রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নানা সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল ভারতকে। ইউক্রেনে মস্কোর অভিযানের সমালোচনা করতে অস্বীকার করেছিল ভারত। নিষেধাজ্ঞার কারণে ক্রেমলিন যখন অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, তখন তার কাছ থেকে কম দামে তেল কিনেছে দিল্লি। হোয়াইট হাউজ সে সময় তাদের অসন্তোষের বিষয়টি স্পষ্ট করেছিল। নয়াদিল্লির অবস্থানকে তারা 'নড়বড়ে' আখ্যা দিয়ে বলেছিল, তাদের আচরণে যুক্তরাষ্ট্র হতাশ। এরপর হঠাৎ করেই পশ্চিমের সুর বদলে গেলো। বাইডেন যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে চলতি মাসে সাক্ষাত করলেন, তখন আবার কূটনীতির ড্রাম বাজতে শুরু করলো। দুই দেশের জনগণের মধ্য কি গভীর সংযোগ, এবং দুই দেশের যে অভিন্ন মূল্যবোধ - সেগুলো নিয়ে কথাবার্তা শুরু হলো। এরপর ব্রিটিশ নেতা বোরিস জনসন দিল্লি গেলেন। সেখানে তিনি বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করলেন, ছবির জন্য পোজ দিলেন। রাশিয়া ইস্যুতে সব ধরণের ভিন্নমতের মধ্যেই এই সব কিছু ঘটে গেলো। ভারতের অবস্থান ইউক্রেন প্রশ্নে এখনও আগের জায়গাতেই আছে। এখনও তারা রাশিয়ার সস্তা তেল কিনছে। রয়টার্স জানিয়েছে, পুরো ২০২১ সালে তারা যে পরিমাণ তেল কিনেছিল, শুধু ২০২২ সালের শুরুর কয়েক মাসেই নয়াদিল্লি সে পরিমান তেল কিনেছে। মস্কোর অভিযান নিয়েও তারা মুখ বন্ধ রেখেছে। জাতিসংঘে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল থেকে রাশিয়াকে সরানোর জন্য ৭ এপ্রিল যে ভোট হয়েছিল, সেখানেও অংশ নেয়নি ভারত। বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক কূটনীতির ক্ষেত্রে বলা যায় পশ্চিমাদেরকে একটা শিক্ষা দিলো ভারত । রাশিয়ার চেয়েও চীনকে বিশ্ব শান্তির জন্য বড় হুমকি মনে করে যুক্তরাষ্ট্র। আর সেই চীনের মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান মিত্র হলো ভারত। সে কারণে ভারতের পদক্ষেপগুলোকে পশ্চিমাদেরকে দাঁত কামড়ে সহ্য করতে হচ্ছে। কিংস কলেজ লন্ডনের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক হার্শ ভি পান্থ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে যে, ভারতকে তাদের নতুন অংশীদারের মতো তোষণ করতে হবে। কিন্তু ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? চীনের সামরিক শক্তির সম্প্রসারণ নিয়ে নয়াদিল্লি আর ওয়াশিংটন উভয়েরই অস্বস্তি বাড়ছে। স্থল ও জলসীমায় বিভিন্ন ভূখন্ডের উপর চীনের দাবি। ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর তাদের অর্থনৈতিক প্রভাবের কারণে তারা উদ্বিগ্ন। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অধীনে চীনের সামরিক বাহিনী অনেক শক্তিশালী হয়েছে। পিপলস লিবারেশান আর্মি নেভি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় নৌবাহিনী। তাদের বিমান বাহিনীতে রয়েছে অত্যাধুনিক স্টেলথ জঙ্গি বিমান, আর তাদের পারমানবিক অস্ত্রের ভান্ডারও বড় হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পাশাপাশি জাপান আর অস্ট্রেলিয়াকে সাথে নিয়ে চীনের মোকাবেলা করতে চায়। চার দেশ মিলে সেজন্য তারা কোয়াড গড়ে তুলেছে। অন্যদিকে, চীনের ব্যাপারে ভারতের নিজেরও উদ্বেগ রয়েছে। হিমালয় অঞ্চলের সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে অচলাবস্থা চলছে। গত কয়েক বছরে সেখানে কয়েক ডজন সেনা প্রাণ হারিয়েছে। হিমালয় অঞ্চল থেকে নিয়ে আরও বহু জায়গায় ভারতের বাহিনীকে সুসজ্জিত করা হয়েছে মূলত রাশিয়ান অস্ত্র দিয়ে। যা ওয়াশিংটন অস্বীকার করতে পারে না। বাইডেন-মোদি বৈঠকের পর চীনা আগ্রাসনের ব্যাপারে দুই পক্ষই তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লয়েড অস্টিন সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, চীন এই অঞ্চলে এবং পুরো বিশ্ব ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতের সামনে নতুন সুযোগ রয়েছে, যেখানে তারা তাদের সামরিক বাহিনীর আভিযানিক সীমাকে আরও বাড়াতে পারবে। ভারতের তক্ষশীলা ইন্সটিটিউটের চায়না স্টাডিজের ফেলো মনোজ কেওয়ালরামানি মনে করেন , ইউক্রেন নিয়ে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের যতই ভিন্নমত থাক, দুই দেশ পরস্পরের অবস্থানের ব্যাপারে একটা বোঝাপড়ায় এসেছে। এ থেকে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্র কেন ইউক্রেন প্রশ্নে চীনের নিরবতার কড়া সমালোচনা করলেও ভারতের নিরবতা নিয়ে তারা কার্যত চুপ করে আছে। বাইরে থেকে দেখলে ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে ভারত আর চীনের অবস্থান অনেকটাই একই রকম। উভয়েই নিজেদেরকে নিরপেক্ষ অবস্থানে রেখেছে। জোরালো কোন বিরোধীতা করেনি। উভয়েই শান্তির আহ্বান জানিয়েছে। এবং রাশিয়ার অভিযানের নিন্দা জানাতে অস্বীকার করেছে। দুই দেশেরই রাশিয়ার সাথে স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক রয়েছে এবং তারা কেউই সেটা নষ্ট করতে চায় না। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আর রাশিয়ার নেতা ভøাদিমির পুতিন ফেব্রুয়ারিতে ঘোষণা দিয়েছেন যে, তাদের দুই দেশের সম্পর্কের কোন সীমা পরিসীমা নেই। কিছু হিসেব মতে, ভারত তার সামরিক সরঞ্জামের ৫০ শতাংশের বেশি নিয়ে থাকে রাশিয়ার কাছ থেকে। ভারত ও চীনের অবস্থানের মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। চীন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করেছে এবং সঙ্ঘাতের জন্য যুক্তরাষ্ট্র আর ন্যাটোকে বারবার দোষারোপ করেছে। রাশিয়ার সাথে একমত পোষণ করে তারা বলেছে, ন্যাটো পূর্ব দিকে আরও সম্প্রসারণের চেষ্টা করেছে বলেই এই যুদ্ধ লেগেছে। একই সাথে চীনের রাষ্ট্রীয় মিডিয়াগুলোও রাশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে তথ্য প্রচার করে যাচ্ছে। অন্যদিকে ভারত ন্যাটোর সমালোচনা করা থেকে বিরত থেকেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পার্থক্য কমিয়ে আনতে চেয়েছে। যুদ্ধের অগ্রগতির সাথে সাথে ভারতের অবস্থানের কিছু সুক্ষ্ম পরিবর্তনও হয়েছে। মোদি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেন্সকির সাথে কথা বলেছেন। চীনের নেতারা কখনও সেটা করেননি। তাছাড়া রাশিয়ার কথিত যুদ্ধাপরাধের ব্যাপারেও ভারত আগের চেয়ে কঠোর ভাষায় কথা বলেছে। চলতি মাসে জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত বুচা এলাকায় বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার বিষয়টিকে 'গভীরভাবে উদ্বেগজনক' আখ্যা দিয়ে এর নিন্দা জানান এবং এ ঘটনার তদন্ত দাবি করেন। অন্যদিকে, চীনা রাষ্ট্রদূত ঝাং জুন মৃত্যুর ঘটনাকে 'গভীর উদ্বেগজনক' বললেও, সুনির্দিষ্টভাবে কোন পক্ষকে দোষারোপ করেননি। তিনি বরং কারোর উপর 'ভিত্তিহীন অভিযোগ' না করার জন্য সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, বাইডেন-মোদির বৈঠকের পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন স্বীকার করেছেন যে, ভারত ইউক্রেনে বেসামরিক নাগরিক হত্যার বিষয়ে নিন্দা জানিয়েছে। ইউক্রেনের মানুষের সহায়তায় তারা মানবিক সহায়তা দিয়েছে। এই সব বিভিন্ন বিষয় মিলিয়ে ভারত এমন জায়গায় অবস্থান করছে, যেখানে সব পক্ষকেই এখন ভারতকে তোষণ করতে হচ্ছে। মস্কো এখনও তার জায়গাতেই আছে। ভারতকে তারা সস্তায় তেল দিতে চায়। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ চলতি মাসে দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকও করেছেন। ভারত যে ইউক্রেন যুদ্ধকে একতরফাভাবে দেখেনি, সে জন্য তিনি দিল্লিীকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন। পশ্চিমারাও তাদের জায়গা থেকে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ২০১৪ সালে মোদি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ভারত-মার্কিন বাণিজ্যের পরিমাণ ১১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে রাশিয়ার সাথে ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ হলো ৮ বিলিয়ন ডলার। একই সাথে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ভারত মার্কিন সামরিক সরঞ্জামেরও বড় গ্রাহক হয়েছে। বাইডেনের সাথে যদিও বৈঠক হয়েছে মোদির, তবু একটা অস্বস্তির জায়গা রয়ে গেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারতের প্রতি দাবি জানিয়েছেন যাতে ভারত রাশিয়ান তেলের ব্যবহার না বাড়ায়। অন্য জায়গা থেকে ভারতকে তেল সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। ভারত তার চাহিদার ৮০ শতাংশ তেলই আমদানি করে, এবং এর মধ্যে মাত্র তিন শতাংশ আমদানি করে রাশিয়ার কাছ থেকে। এটা বলা যায় যে, ভারত দুই পক্ষের মধ্যে একটা ভারসাম্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এই সঙ্কটের কারণে ভারত আরও শক্তিশালী হয়েছে। ভারতের এই অর্জনকে সাধুবাদ দিতেই হবে।