রাশিয়ার ওপর অস্ত্র নির্ভরতা কমিয়ে আনবে ভারত


  • অনলাইন ডেস্ক
  • ২০ এপ্রিল ২০২২, ১৩:৫৩

ভারত ক্রমান্বয়ে নিজেদের সমরাস্ত্র শিল্প আরো বেশি সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছে। বর্তমানে রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত অস্ত্রের ওপর ভারতের যে নির্ভরতা রয়েছে, তা কমিয়ে নিয়ে আসার লক্ষ্যেই ভারত এই কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে। একইসঙ্গে রাশিয়ার বিকল্প হিসেবে সমমনা আরো কয়েকটি দেশের সাথে ভারত নিজেদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। ভারত এভাবে চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছে কারণ চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভারতকে দেয়া প্রতিশ্রুত অনেকগুলো অস্ত্র সরবরাহ দিতেই রাশিয়া বিলম্ব করেছে। এমনকী বেশ কয়েকটি অর্ডার রাশিয়ার তরফ থেকে বাতিলও করে দেয়া হয়েছে। আগামীতে ভারত তার প্রতিরক্ষা শিল্প উন্নয়ন নিয়ে কী ভাবছে তাই জানবো আজকের প্রতিবেদনে।

সামরিক দিক থেকে ভারত বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ। ভারতের হাতে আছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনী, চতুর্থ বৃহৎ বিমান বাহিনী এবং ৭ম সর্ববৃহৎ নৌ বাহিনী। তারপরও ভারতের সবচেয়ে বড়ো সীমাবদ্ধতা হলো ভারতের সমরাস্ত্রের মজুদ অনেকটাই আমদানী নির্ভর। বিশ্বের অস্ত্রবাজারে যত অস্ত্র আমদানি হয় তার ১১ শতাংশই আমদানি করে ভারত। আর এককভাবে ভারতের হিসেব করলে দেখা যায়, ভারতের কাছে মজুদ মোট সমরাস্ত্রের ৭০ শতাংশই আমদানিকৃত অস্ত্র। এই বিশাল আমদানিকৃত অস্ত্রের ৬০ শতাংশই ভারত ক্রয় করে রাশিয়ার কাছ থেকে। কোল্ড ওয়ারের পর থেকেই রাশিয়ার ওপর ভারতের এই নির্ভরতা তৈরি হয়।

তবে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সামরিক কর্মকান্ডের অনেকটাই এখন ইউক্রেনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিপুল পরিমান সমরাস্ত্র নিয়োজিত রয়েছে। ফলে, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের জন্য রাশিয়া যে অস্ত্রগুলো তৈরি করেছিল, তার অনেকগুলোই জরুরি ভিত্তিতে ইউক্রেনে পাঠিয়ে দিতে হচ্ছে। এটি করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের সাথে চুক্তিকৃত অস্ত্রগুলো সরবরাহ করতেও রাশিয়ার বিলম্ব হচ্ছে। একইসাথে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পের ওপর পশ্চিমা দেশগুলো একের পর এক অবরোধ আরোপ করায় আগামীতে রাশিয়ার সমরাস্ত্র সরবরাহ সক্ষমতা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা নিয়েও প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এসকল প্রশ্ন আর উদ্বেগ ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের কপালেও ভাঁজ তৈরি করেছে কারণ রাশিয়ার অস্ত্রের সবচেয়ে বড়ো ক্রেতারাষ্ট্রই হলো ভারত। আগামীতে রাশিয়া আদৌ আর চুক্তিকৃত অস্ত্রগুলো পাঠাতে পারবে কিনা তা নিয়েও তৈরি হয়েছে সংশয়।

ভারত অবশ্য রাশিয়া ছাড়াও ফ্রান্স, ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকেও সমরাস্ত্র আমদনি করে। রাশিয়া থেকে সমরাস্ত্র ক্রয়কে কেন্দ্র করে এই দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্কেও একটি টানাপোড়েন তৈরির আশংকাও দেখা যাচ্ছে। গত ৭ এপ্রিল একটি অনুষ্ঠানে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেন, ভারত আগামীতে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সমরাস্ত্র উৎপাদক দেশ হিসেবে আবির্ভুত হতে চাইছে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি তৃতীয়বারের মতো একটি তালিকাও প্রকাশ করেন। এতে দেখা যায়, ২০২২ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে ভারত অন্তত ১০১টি সামরিক উপকরণ নিজ দেশেই উৎপাদন করার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। রাজনাথ সিং দাবি করেন, এই তালিকাই বার্তা দিচ্ছে যে, ভারত দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে স্বয়ং সম্পুর্ন অবস্থানে চলে যেতে চায়। অনেকেই এরই মধ্যে এ তালিকাকে উচ্চাভিলাষী বলে অভিহিত করেছেন। এই তালিকা অনুযায়ী আগামী ৫ বছরের মধ্যে ভারত যেসব সমরাস্ত্র ও সমরযান উৎপাদন করতে যাচ্ছে তার মথ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হালকা ওজনের ট্যাংক, নৌপথে কার্যকরী হেলিকপ্টার, দ্রুততম সময়ের মধ্যে আক্রমন উপযোগী বিমান, এন্টি শিপ মিসাইল প্রভৃতি। বোঝাই যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার এখন প্রতিরক্ষা সেক্টরে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করছে।

গত বছরের মে মাসে, ভারত এরকমই আরেকটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। ঐ তালিকাতেও ১০৮টি সামরিক উপকরণের নাম ছিল যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সেন্সর, সিমুলেটর, অস্ত্র, ট্যাংক ইঞ্জিন, মধ্যম পাল্লার সারফেইস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেম এবং হেলিকপ্টার, করভেট এবং এয়ারবর্ন সিস্টেম। এই তালিকার অস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তিগুলো ভারত ২০২১ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যেই নিজ দেশে উৎপাদন করবে বলে জানা গেছে। নিজ দেশে উৎপাদনযোগ্য সামরিক অস্ত্রের প্রথম তালিকাটি ভারত প্রকাশ করেছিল ২০২০ সালের আগস্ট মাসে। প্রথম তালিকার অস্ত্রগুলো ভারত ২০২২ সালের মধ্যেই উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এই তালিকায় খুব বেশি ভারী অস্ত্র ছিল না। বরং তালিকায় ছিল সহজ ও হালকা সংস্করণের কিছু ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ অস্ত্র, বিশেষ করে আর্টিলারি গান, এসল্ট রাইফেল, করভেট, সোনার সিস্টেম, ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফট, লাইট কমব্যাট হেলিকপ্টার, রাডার এবং চাকানির্ভর আরমর্ড যুদ্ধযান প্রভৃতি।

প্রকৃত সামরিক শক্তি হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্প এখনো অনেকটা পিছিয়ে আছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিবেশ এবং প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জনেও দেশটির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এক্ষেত্রে বিশ্লেষকরা ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা ও সমর্থনের অভাব, গবেষণাধর্মী কার্যক্রমে স্বল্প বাজেটের বরাদ্দ, গবেষক ও উৎপাদক কর্মীদের অদক্ষতা, মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায় অপ্রতুলতা এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনা কাঠামোকেই দায়ী করেছেন। ভারতে সামরিক খাতে যেকোনো গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমে ডিফেন্স রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানেইজেশন বা ডিআরডিওকেই রাষ্ট্রীয় একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটি আভ্যন্তরীন নানা সংকটে জর্জরিত। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ডিআরডিও’র অনগ্রসরতা ভারতের সার্বিক প্রতিরক্ষা শিল্পের পশ্চাৎপদতার অন্যতম কারণ।

২০০৮ সালে রাও রামা রিপোর্ট নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে বলা হয় ডিআরডিও তার কার্যক্রমে কোনোভাবেই মেধাবিদেরকে আকৃষ্ট করতে পারছে না- যা এই সংস্থার গতিশীলতা বৃদ্ধি না হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ। এই সংস্থার ৫৭ শতাংশ বিজ্ঞানী পেশাগত অসন্তোষের জেরে চাকুরি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আর যারা নতুন করে যোগ দিচ্ছে তাদের ৮৭ শতাংশই স্বপ্ন বুকে নিয়ে ডিআরডিওতে যোগ দিচ্ছে। তাদের ধারণা এই প্রতিষ্ঠানে তাদের ক্যারিয়ার সার্বিকভাবে সমৃদ্ধ হবে। অথচ কাজে যোগ দেয়ার বছর কয়েকের মধ্যেই তাদের এই প্রত্যাশা অনেকটাই হতাশায় পরিণত হচ্ছে। রাও রামার রিপোর্ট অনুযায়ী ডিআরডিও’র আরো যে সংকটগুলো আছে তার মধ্যে একটি হলো, এই সংস্থাটি সবসময়ই গড়পড়তা মানের লোকজনকে নিয়োগ করে। আর প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ প্রক্রিয়াও খুবই মন্থর। ডিআরডিও এ পর্যন্ত অনেকগুলো বড়ো বড়ো প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু দক্ষ মানবসম্পদ, আর্থিক ও অবকাঠামোগত সংকটের কারণে এই প্রকল্পগুলোর কোনোটিই শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। আর যে কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে সেগুলোর বাস্তবায়নেও সংশ্লিষ্ট দক্ষ কর্মীদের সম্পৃক্ত করা হয়নি। ফলে, প্রকল্পগুলো থেকে প্রত্যাশিত মাত্রায় সফলতা পাওয়া যায়নি।

অন্যদিকে, ভারত নানা ধরনের ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক সংকটের কারণে প্রতিরক্ষা খাতে বিদেশী বিনিয়োগও আকৃষ্ট করতে পারছে না। নানা ধরনের সুরক্ষা কৌশল দিয়ে এই প্রক্রিয়াটিকে জটিল করে রাখা হয়েছে। যেমন ২০২০ সালে ভারত প্রতিরক্ষা খাতে ক্রয় সংক্রান্ত যে নীতিমালা প্রনয়ন করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, যদি কোনো প্রকল্পে বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমান ৪১ শতাংশের বেশি হয় তাহলে ভারতের কোনো স্থানীয় প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে প্রাথমিক ক্রেতা হিসেবে বিড করতে পারবে না। অর্থাৎ ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শুধুমাত্র সেই প্রকল্পগুলোতেই ক্রেতা হিসেবে বিড করতে পারবে যেখানে তাদের শেয়ারের পরিমান কমপক্ষে ৫১ শতাংশ বা তারও বেশি হবে। এসব কারণে বিদেশী কোম্পানীগুলো ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ পাচ্ছে না।

তাছাড়া ভারতে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে বাড়তি সতর্কতাও কাজ করে। আর এই বাড়তি সতর্কতার প্রভাবে নানা ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার উদ্ভব হয়। বিশেষ করে স্পর্শকাতর সামরিক প্রযুক্তিগুলোর ক্ষেত্রে অযাচিতভাবে নানা ধরনের যাচাই বাছাই আরোপ করা হয়। আবার ভারতের অন্য কোনো রাষ্ট্র যদি তার মতো করে কোনো সামরিক প্রযুক্তি রফতানি করতে চায় সেক্ষেত্রে আরো বেশি সংকটের মুখে তাদেরকে পড়তে হয়। দেখা যায়, কেন্দ্রীয় বিধি নিষেধের বাইরে প্রতিটি রাজ্যের আবার নিজস্ব কিছু রক্ষনশীল বিধান ও আইন কার্যকর রয়েছে। এই সব কারণেই ভারতের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা কাঠামো গড়ার প্রক্রিয়াগুলো বারবার হোচট খায়। ভারতের নিজস্ব সামরিক শক্তি বৃদ্ধি বা স্থানীয়ভাবে অস্ত্র তৈরি কোনো উচ্চাভিলাষী উদ্যোগ নয়। তবে একে বাস্তবায়ন করতে হলে আগে দেশটিকে রাজনৈতিক, মানবিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতাগুলো অতিক্রম করতে হবে। তাহলেই দেশটি আমদানিকারক দেশের স্ট্যাটাস থেকে বের হয়ে সমরাস্ত্র উৎপাদক দেশ হিসেবে বিশ্ব বাজারে আবির্ভুত হতে পারবে।