ভারতের ওপর কেন ক্ষুব্ধ যুক্তরাষ্ট্র?

- সংগৃহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ১৭ এপ্রিল ২০২২, ১৭:০৬

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের ব্যাপারে ভারতের মস্কোপন্থি অবস্থান নিয়ে পশ্চিমাদের চাপে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিশেষ করে ভারত সরকার যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশে^র নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে রাশিয়ার কাছ থেকে বিপুল পরিমান জ¦ালানী তেল কেনায় ক্ষুব্ধ যুক্তরাষ্ট্র। এই তেলের মূল্য মার্কিন ডলারের পরিবর্তে ভারতীয় মুদ্রা রুপি ও রুশ মুদ্রা রুবলে বিনিময় করার মেদি সরকারের সিদ্ধান্ত বাইডেন প্রশাসনের ক্ষোভ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। রাশিয়ার সাথে তেল কেনা নিয়ে কেন ভারতের ওপর ক্ষুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র এবং এর প্রভাব কী হতে পারে তা নিয়ে থাকছে আজকের প্রতিবেদন ।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ১১ এপ্রিল ভার্চুয়াল বৈঠক করেন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুই নেতা চলমান দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা এবং দক্ষিণ এশিয়া, ইন্দো-প্যাসিফিক ও বৈশ্বিক ইস্যু নিয়ে মতবিনিময় করেন। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠিত চীনবিরোধী চার দেশের জোট কোয়াড এর সদস্য ভারত। এর আগে গত মার্চে কোয়াড এর নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে মোদির সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল বাইডেনের।
এই বৈঠকের আগেই ধারনা করা হয়েছিলো রাশিয়ার কাছ থেকে ভারতের তেল ও অস্ত্র কেনার পরিণতি নিয়ে বাইডেন মোদিকে সতর্ক করতে পারেন। বাইডেন-মোদির এই ভার্চুয়াল বৈঠকের পর চতুর্থ দফার ভারত-যুক্তরাষ্ট্র টু প্লাস টু সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে ওয়াশিংটনে।
এই সংলাপে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং তাদের মার্কিন প্রতিপক্ষ পররাষ্ট্র মন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লয়েড অষ্টিনের সঙ্গে মুখোমুখি বসবেন। কিন্তু সংলাপ শুরুর আগে ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে ভারতের প্রতি নানা সতর্কবার্তা উচ্চারণ করা হচ্ছে।


ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসনের জন্য রাশিয়ার সমালোচনা করেনি ভারত। রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞায়ও এখন পর্যন্ত দিল্লি যোগ দেয়নি। উল্টো রাশিয়ার কাছ থেকে তেল ও অস্ত্র কেনা অব্যাহত রেখেছে দেশটি।


রাশিয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্র আমদানিকারক দেশ ভারত। এখন আবার বিপুল পরিমান জ¦ালানী তেল আমদানি করছে ভারত। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা ভালোভাবে নিচ্ছে না। এশিয়ায় চীনের বিরোধী শক্তি হিসেবে ভারতকে বিবেচনা করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। চীনকে মোকাবেলায় ভারতক নিয়ে চারদেশীয় জোটও গঠন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে ভারত রাশিয়ার পক্ষ নেয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ। এই ক্ষেভেরই বহিপ্রকাশ ঘটছে মার্কিন কর্মকর্তাদের বক্তব্যে। তারা এসব বক্তব্যের মাধ্যমে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করে দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।


জাতিসংঘে রাশিয়ার বিরুদ্ধে উত্থাপিত নিন্দা প্রস্তাবে ভারত একাধিক বার ভোটদানে বিরত ছিল যা যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষুব্ধ করেছে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রে পক্ষ থেকে ভারতকে সতর্কবার্তা দেয়া হচ্ছে বারবার। বলা হচ্ছে এজন্য ভারতকে পরিনতি ভোগ করতে হবে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শীর্ষ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ব্রায়ান ডেজে গত ৭ এপ্রিল বলেছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে অস্বীকার করেছে ভারত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য মিত্র দেশ এ নিষেধাজ্ঞার মিছিলে শামিল হয়েছে।
ব্রায়ান ডিজ বলেন ভারত সরকারের প্রতি আমাদের বার্তা হচ্ছে, রাশিয়ার দিকে ভারতের কৌশলগত জোটবদ্ধতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিণতি ও খেসারত হবে ব্যাপক এবং দীর্ঘ মেয়াদী। ইউক্রেন আক্রমণের পর নিশ্চিতভাবে কিছু ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে আমরা চীন এবং ভারত উভয়ের সিদ্ধান্তে হতাশ হয়েছি।

যুক্তরাষ্ট্রের উপ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা দালীপ সিংয়ের ভারতে সফরের পরই এ সতর্কতা জানায় হোয়াইট হাউস। দালীপ সিং ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার পর হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি এ নিয়ে কথা বলেছেন। এই সফরে দালীপ তার ভারতীয় প্রতিপক্ষকে বলেছেন, রাশিয়ার জ্বালানি ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করা বা বাড়ানো ভারতের স্বার্থে করা হচ্ছে তা ওয়াশিংটন বিশ্বাস করে না।
এর আগে বাইডেন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন মস্কোর ওপর চাপ বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন ভারত যদি রাশিয়ার তেল আমদানির পরিমাণ বাড়ায় তাহলে তা নয়াদিল্লিকে ‘বড় ধরনের ঝুঁকির’ মুখে ঠেলে দিতে পারে।


রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করার পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে অন্য ক্রেতারা রুশ তেল কেনা থেকে পিছু হটে। কিন্তু বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ তেল আমদানিকারক ও ভোক্তা দেশ ভারতের খনিজ তেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো ঝুকে পড়ছে রাশিয়ার দিকে। ব্যাপক মূল্য হ্রাসের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাৎক্ষণিক টেন্ডারের মাধ্যমে রাশিয়ার কাছ থেকে বাড়তি তেল কেনা শুরু করে। ভারত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময়ে রাশিয়া থেকে অন্তত এক কোটি ৩০ লাখ ব্যারেল তেল কিনেছে। অথচ পুরো ২০২১ সালে তারা রাশিয়া থেকে তেল কিনেছিল ১ কোটি ৬০ লাখ ব্যারেলেরও কম।


ভারত তার মোট চাহিদার ৮০ ভাগ তেল আমদানি করে। এর মধ্যে ২ থেকে ৩ ভাগ তেল তারা কেনে রাশিয়ার কাছ থেকে। ভারতের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভারত সরকার চায় নিজ দেশে তেলের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে। এর আগে ইরান ও ভেনিজুয়েলার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে ভারত তা মেনে চলেছে। কিন্তু রাশিয়ার বেলায় মানছেনা। আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে কম দামে ভারতের কাছে রাশিয়া তেল বিক্রির প্রস্তাব দিলে নয়াদিল্লি তা গ্রহণ করে।
ভারতের সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভারত আমদানি করা রুশ পণ্যের মূল্য পরিশোধ মার্কিন ডলারের পরিবর্তে রুপি ও রুবলের মাধ্যমে করার বিষয়টি নিয়েও কাজ করে যাচ্ছেন। মার্কিন ডলারকে এড়িয়ে রুপি-রুবলে লেনদেনের এই ভারতীয় সিদ্ধান্তেও ক্ষুব্ধ যুক্তরাষ্ট্র।
হোয়াইট হাউসে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ রাশিয়ার উপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তা সব দেশের মেনে চলা উচিত। এ সময় সাংবাদিকরা রাশিয়া থেকে ভারত কম দামে তেল কিনছে বলে জেন সাকির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জবাবে তিনি বলেন, এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে গিয়ে ভারত যদি রাশিয়া থেকে কম দামে তেল আমদানি করে তাহলে তারা ইতিহাসের ভুল পক্ষে অবস্থান নেবে। তিনি বলেন, ইউক্রেন ইস্যুতে ভারত কোথায় অবস্থান নিতে চায় সে সম্পর্কে তাদেরকে ভেবে দেখার পরামর্শ দেব।
বর্তমান সময় সম্পর্কে যখন ইতিহাস লেখা হবে তখন রাশিয়া ও রুশ নেতাদেরকে সমর্থন করার কথা লেখা হবে, ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে রাশিয়ার বিপর্যয়কর আগ্রাসনের প্রতি ভারতের সমর্থন ছিল।


বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এধরণের হুশিয়ারি ভারতকে কিছুটা হলেও চিন্তিত করেছে। এখন ভারত অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির সরকার এখন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। রুশ আগ্রাসনে বেসামরিক প্রাণহাণিতে দু:খ প্রকাশ করার পাশাপাশি মস্কোকে জাতিংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার আহবান জানাচ্ছে। একই সাথে ইউক্রেনের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও ভৌগলিক অখন্ডতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য রাশিয়ার প্রতি আহবান জানাচ্ছে ভারত। ইউক্রেনের বুচা শহরে রুশ বাহিনীর গণহত্যার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ভারতের পার্লামেন্টে বক্তব্য দিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। এর মাধ্যমে বাইডেন প্রশাসনকে কতটুকু সন্তষ্ট করা যাবে তা নিয়ে সন্দিহান ভারতেরই অনেক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক।


ইউক্রেন সংকটের এই সময়ে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের কোন রাষ্ট্রদূত নেই। বাইডেন প্রশাসন এরিক গারসেত্তিকে ভারতে নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনোনয়ন দিলেও তা এখনো সিনেটের অনুমোদন পায়নি। ফলে বাইডেন প্রশাসনকে ভারতের জন্য আরেকজনকে মনোনয়ন দিতে হতে পারে।
ভারতের মতো একটি বড় ক্রেতা দেশ ও পুরনো মিত্রকে নিজের পক্ষে ধরে রাখতে পারাটা রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের জন্য একটি বড় সাফল্য। এ বিষয়টি বাইডেন প্রশাসনকে যথেষ্ট নাড়া দিয়েছে। বিষয়টি তাদের জন্য প্রেষ্টিজ ইস্যু হয়ে উঠেছে।
রাশিয়া থেকে কেনা তেলের মূল্য মার্কিন ডলারের পরিবর্তে রুপি-রুবলে পরিশোধ করার ভারতীয় সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রকে চরমভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বন্দ্বের কারণে রাশিয়া থেকে তেল-গ্যাস আমদানি বাড়িয়েছে চীন। রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে চীন মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে অকার্যকর করার চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতের সিদ্ধান্তে ওয়াশিংটন বড় ধরনের হোচট খেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে এশিয়ায় চীনের উত্থানের বিরুদ্ধে পাল্টা শক্তি হিসেবে গড় তোলার যে চেষ্টা করেছিল। এখন তারা দেখেছে মিত্র হিসাবে ভারত মোটেও বিশ্বস্ত নয়। ভারত যে রাশিয়ার পক্ষে দাড়াবে তা সম্ভবত বাইডেন প্রশাসনের ধারণার বাইরে ছিল। ভারতের এই অবস্থান রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নিষেধাজ্ঞাকে অনেকটাই নড়বড়ে করে দিয়েছে। এখন বাইডেন প্রশাসন ভারতের বিরুদ্ধে ধিরণের পদক্ষেপ গ্রহন করে সেদিকেই দৃষ্টি রাখছেন পর্যবেক্ষকরা।