রাশিয়ার ওপর অস্ত্র নির্ভরতায় বিপাকে ভারত

- সংগৃহীত

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৭ এপ্রিল ২০২২, ১৬:৫৩

রাশিয়ার সমরাস্ত্রের ওপর নির্ভর করে বড় ধরনের বিপাকে পড়তে যাচ্ছে ভারত। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভারতকে দেয়া নির্ধারিত সময়ে অনেক অস্ত্র সরবরাহ করতে পারবে না রাশিয়া। অপরদিকে রাশিয়া সমরাস্ত্র কেনা কমিয়ে আনতে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে প্রচন্ড চাপ রয়েছে ভারতের ওপর। ভারত ধীরে ধীরে নিজেদের সমরাস্ত্র শিল্প আরো বেশি সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেটিও বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। রাশিয়ার বিকল্প হিসেবে সমমনা আরো কয়েকটি দেশের সাথে ভারত নিজেদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নিয়েছে। ভারত এমন চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছে কারণ ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি অর্ডার রাশিয়ার তরফ থেকে বাতিলও করে দেয়া হয়েছে। আগামীতে ভারত তার প্রতিরক্ষা শিল্প উন্নয়ন নিয়ে কী ভাবছে তা নিয়ে থাকছে আজকের প্রতিবেদন।


সামরিক দিক থেকে ভারত বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ। ভারতের আছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনী। চতুর্থ বৃহৎ বিমান বাহিনী এবং ৭ম সর্ববৃহৎ নৌ বাহিনী। তারপরও ভারতের সবচেয়ে বড়ো সীমাবদ্ধতা হলো ভারতের সমরাস্ত্রের মজুদ অনেকটাই আমদানী নির্ভর। বিশ্বের অস্ত্রবাজারে যত অস্ত্র আমদানি হয় তার ১১ শতাংশই আমদানি করে ভারত।
এককভাবে ভারতের হিসেব করলে দেখা যায়, ভারতের কাছে মজুদ মোট সমরাস্ত্রের ৭০ শতাংশই আমদানিকৃত অস্ত্র। এই বিশাল আমদানিকৃত অস্ত্রের ৬০ শতাংশই ভারত ক্রয় করে রাশিয়ার কাছ থেকে। কোল্ড ওয়ারের পর থেকেই রাশিয়ার ওপর ভারতের এই নির্ভরতা তৈরি হয়।
চলমান ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার সামরিক কর্মকান্ডের অনেকটাই এখন ইউক্রেনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিপুল পরিমান সমরাস্ত্র নিয়োজিত রয়েছে। ফলে, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের জন্য রাশিয়া যে অস্ত্রগুলো তৈরি করেছিল, তার অনেকগুলোই জরুরি ভিত্তিতে ইউক্রেনে পাঠাতে হচ্ছে। এটি করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের সাথে চুক্তিকরা অস্ত্র সরবরাহ করতেও রাশিয়ার দেরি হচ্ছে। একইসাথে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পের ওপর পশ্চিমা দেশগুলো একের পর এক অবরোধ আরোপ করায় আগামীতে রাশিয়ার সমরাস্ত্র সরবরাহ সক্ষমতা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা নিয়েও প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই এসব প্রশ্ন আর উদ্বেগ ভারতীয় নীতি নির্ধারকদের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। কারণ রাশিয়ার অস্ত্রের সবচেয়ে বড়ো ক্রেতা দেশ হলো ভারত। ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হলে আগামীতে রাশিয়া আদৌ চুক্তিকরা অস্ত্রগুলো পাঠাতে পারবে কিনা তা নিয়েও তৈরি হয়েছে সংশয়।


ভারত অবশ্য রাশিয়া ছাড়াও ফ্রান্স, ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকেও সমরাস্ত্র আমদনি করে। রাশিয়া থেকে সমরাস্ত্র ক্রয়কে কেন্দ্র করে এই দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্কেও টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ এবার ভারতের সমরাস্ত্র সংগ্রহের ওপর মারাতœক ঝাকুনি সৃষ্টি করেছে। শুধু নির্ধারিত সময়ে সমরাস্ত্র পাওয়ার অনিশ্চয়তা নয়, রাশিয়ার কিছু সমরাস্ত্রের উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ভারতের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে এক ধরনের ভীতির সৃষ্টি করেছে।


ইউক্রেন যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে রাশিয়ার ট্যাংক ও সাজোয়া যান। তুরস্কের বেয়ারকাতার টিবি-২ ড্রোন রাশিয়ার ট্যাংক বহরকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এর আগে নাগারনো কারাবাখ যুদ্ধে এই ড্রোনের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে রাশিয়ার তৈরি বিভিন্ন ধরনের ট্যাংক। স্থল যুদ্ধে ভারত পুরোপুরি ভাবে রাশিয়ার ট্যাংকের ওপর নির্ভরশীল। যা ভারতের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে গভীর শঙ্কার সৃষ্টি করেছে।
ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ৮০ শতাংশের বেশি ট্যাঙ্কই রাশিয়া থেকে আনা বা মস্কোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি। রুশ টি-৯০ ও এর ভারতীয় সংস্করণ ‘ভীষ্ম’ মিলিয়ে ২হাজার ৭৮টি ট্যাঙ্ক রয়েছে ভারতীয় আর্মির। একই ভাবে রুশ টি-৭২ও এর ভারতীয় সংস্করণ ‘অজেয় মার্ক-২’-এর মিলিত সংখ্যা ২ হাজার ৪১০।

এ ছাড়া ভারতীয় সেনার মেকানাইজড্ ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়নগুলির ব্যবহৃত রুশ বিএমপি-২ ‘ইনফ্র্যান্ট্রি কমব্যাট ভেহিকল্’-এর সংখ্যা ২ হাজার ৫০০-র ও বেশি। ফলে সম্ভাব্য যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ট্যাঙ্ক এবং সাঁজোয়া যান নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন। কারন ড্রোন শক্তিতে ভারত খুবই দূর্বল। এখন পর্যন্ত ইসরাইলের কয়েকটি ড্রোন ছাড়া ভারতের ড্রোন সক্ষমতা নেই বললেই চলে। অপরদিকে ভারতের প্রতিপক্ষ চীনের হাতে আছে অত্যাধুনিক ড্রোন। আরেক প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের সামরিক মিত্র তুরস্ক। তুরস্কের সাথে পাকিস্তানের যৌথ ড্রোন নির্মানের পরিকল্পনা আছে।
এমন পরিস্থিতিতে গত ৭ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, ভারত আগামীতে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সমরাস্ত্র উৎপাদক দেশ হিসেবে আবির্ভুত হতে চাইছে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি তৃতীয়বারের মতো একটি তালিকাও প্রকাশ করেন তিনি।
এতে দেখা যায়, ২০২২ থেকে ২০২৭ সালের মধ্যে ভারত অন্তত ১০১টি সামরিক উপকরণ নিজ দেশেই উৎপাদন করার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। রাজনাথ সিং দাবি করেন, এই তালিকাই বার্তা দিচ্ছে, ভারত দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে স্বয়ং সম্পুর্ন অবস্থানে চলে যেতে চায়।


অনেক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক এ তালিকাকে উচ্চাভিলাষী চিন্তা বলে মনে করেন। এই তালিকা অনুযায়ী আগামী ৫ বছরের মধ্যে ভারত যেসব সমরাস্ত্র ও সমরযান উৎপাদন করতে যাচ্ছে তার মধ্যে আছে হালকা ওজনের ট্যাংক, নৌপথে কার্যকরী হেলিকপ্টার, দ্রুততম সময়ের মধ্যে আক্রমন উপযোগী বিমান, এন্টি শিপ মিসাইলের মতো সমরাস্ত্র। বোঝাই যাচ্ছে, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার প্রতিরক্ষা সেক্টরে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করছে।


গত বছরের মে মাসে, ভারত এরকমই আরেকটি তালিকা প্রকাশ করেছিল। সে তালিকাতেও ১০৮টি সামরিক উপকরণের নাম ছিল যার মধ্যে সেন্সর, সিমুলেটর, অস্ত্র, ট্যাংক ইঞ্জিন, মধ্যম পাল্লার সারফেইস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেম এবং হেলিকপ্টার, করভেট এবং এয়ারবর্ন সিস্টেম।
এই তালিকার অস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তিগুলো ভারত ২০২১ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যেই নিজ দেশে উৎপাদন করবে বলে আশাবাদি।
নিজ দেশে উৎপাদনযোগ্য সামরিক অস্ত্রের প্রথম তালিকাটি ভারত প্রকাশ করেছিল ২০২০ সালের আগস্ট মাসে। প্রথম তালিকার অস্ত্রগুলো ভারত ২০২২ সালের মধ্যেই উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এই তালিকায় খুব বেশি ভারী অস্ত্র ছিল না। তালিকায় ছিল সহজ ও হালকা সংস্করণের কিছু ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ অস্ত্র, আর্টিলারি গান, এসল্ট রাইফেল, করভেট, সোনার সিস্টেম, ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফট, লাইট কমব্যাট হেলিকপ্টার, রাডার এবং চাকানির্ভন আরমার্ড যুদ্ধযানের মতো সমরাস্ত্র।

প্রকৃত সামরিক শক্তি হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্প এখনো অনেকটা পিছিয়ে আছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিবেশ এবং প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জনেও দেশটির সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দুর্বলতা ও সমর্থনের অভাব। গবেষণাধর্মী কার্যক্রমে স্বল্প বাজেটের বরাদ্দ। গবেষক ও উৎপাদক কর্মীদের অদক্ষতা। মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায় অপ্রতুলতা এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনা কাঠামোর কারনে ভারতের সমরাস্ত্র শিল্প শক্ত ভিত্তির ওপর দাড়াতে পারছে না।
ভারতে সামরিক খাতে যেকোনো গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রমে ডিফেন্স রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানেইজেশন হচ্ছে একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি আভ্যন্তরীন নানা সংকটে জর্জরিত। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ডিআরডিও’র অনগ্রসরতা ভারতের সার্বিক প্রতিরক্ষা শিল্পের পশ্চাৎপদতার অন্যতম কারণ।


২০০৮ সালে রাও রামা রিপোর্ট নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে বলা হয় ডিআরডিও তার কার্যক্রমে কোনোভাবেই মেধাবিদেরকে আকৃষ্ট করতে পারছে না। যা এই সংস্থার গতিশীলতা বৃদ্ধি না হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ। এই সংস্থার ৫৭ শতাংশ বিজ্ঞানী পেশাগত অসন্তোষের জেরে চাকুরি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আর যারা নতুন করে যোগ দিচ্ছে তাদের ৮৭ শতাংশই স্বপ্ন বুকে নিয়ে ডিআরডিওতে যোগ দিচ্ছে। তাদের ধারণা এই প্রতিষ্ঠানে তাদের ক্যারিয়ার সার্বিকভাবে সমৃদ্ধ হবে। অথচ কাজে যোগ দেয়ার বছর কয়েকের মধ্যেই তাদের এই পওত্যাশা অনেকটাই হতাশায় পরিণত হয়। রাও রামার রিপোর্ট অনুযায়ী ডিআরডিও’র আরো যে সংকটগুলো আছে তার মধ্যে একটি হলো, এই সংস্থা সবসময়ই গড়পড়তা মানের লোকজনকে নিয়োগ করে।


ডিআরডিও এ পর্যন্ত অনেকগুলো বড়ো প্রকল্প হাতে নিয়েছে। কিন্তু দক্ষ মানবসম্পদ, আর্থিক ও অবকাঠামোগত সংকটের কারণে এই প্রকল্পগুলোর কোনোটিই শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
অন্যদিকে, ভারত নানা ধরনের ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক সংকটের কারণে প্রতিরক্ষা খাতে বিদেশী বিনিয়োগও আকৃষ্ট করতে পারছে না। নানা ধরনের সুরক্ষা কৌশল দিয়ে এই প্রক্রিয়াটিকে জটিল করে রাখা হয়েছে।

২০২০ সালে ভারত প্রতিরক্ষা খাতে ক্রয় সংক্রান্ত যে নীতিমালা প্রনয়ন করে তাতে বলা হয়েছে, যদি কোনো প্রকল্পে বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমান ৪১ শতাংশের বেশি হয় তাহলে ভারতের কোনো স্থানীয় প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক ক্রেতা হিসেবে বিড করতে পারবে না। অর্থাৎ ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো শুধুমাত্র সেই প্রকল্পগুলোতেই ক্রেতা হিসেবে বিড করতে পারবে যেখানে তাদের শেয়ারের পরিমান কমপক্ষে ৫১ শতাংশ বা তারও বেশি হবে। এসব কারণে বিদেশী কোম্পানীগুলো ভারতের প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়।

ভারতে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে বাড়তি সতর্কতাও কাজ করে। আর এই বাড়তি সতর্কতার প্রভাবে নানা ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি হয়। স্পর্শকাতর সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অযাচিতভাবে নানা ধরনের যাচাই বাছাই আরোপ করা হয়। ভারতে অন্য কোনো রাষ্ট্র যদি সে দেশের মতো করে কোনো সামরিক প্রযুক্তি রফতানি করতে চায় সেক্ষেত্রে আরো বেশি সংকটের মুখে তাদেরকে পড়তে হয়। এ নিয়ে নানা রকম বিধান ও আইন কার্যকর রয়েছে। যা মোটেও রফতানি সহায়ক নয়।