পাকিস্তানে ক্ষমতার পালাবদল বিশ্বে কি প্রভাব ফেলবে?

-

  • হায়দার সাইফ
  • ১৬ এপ্রিল ২০২২, ১৬:১৬

অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইমরান খানকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন বিরোধী দলীয় নেতা শাহবাজ শরীফের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হতে পারে। ক্ষমতায় এসে ইমরান খান পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন। বলা হয়ে থাকে, পাকিস্তানের ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনী দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতি নিয়ন্ত্রণ করে। তবে, সেখানেও ভূমিকা ছিল ইমরান খানের। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ হয়ে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে লড়তে তিনি স্পষ্টভাবে অনীহা জানিয়েছিলেন। চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর পাশাপাশি রাশিয়ারও কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ইমরান খান। কিন্তু তার সাম্প্রতিক মস্কো সফরে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হয়। ইমরান খান সরে যাওয়ার পর পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের উপর কি ধরণের প্রভাব পড়তে পারে, তাই নিয়ে দেখুন হায়দার সাইফের প্রতিবেদন।


পাকিস্তানের পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব পাসের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হলো ইমরান খানকে। তিন বছর সাত মাস ক্ষমতায় থাকার পর ইমরান খানকে এই অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি হতে হলো। এখন পাকিস্তানে নতুন সরকার গঠিত হবে। বিরোধী দলীয় নেতা শাহবাজ শরীফের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হতে পারে।
২২০ মিলিয়নেরও বেশি জনসংখ্যার দেশ পাকিস্তানের ভৌগলিক অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের পশ্চিমে রয়েছে আফগানিস্তান, উত্তর- পূর্বে চীন, আর পূর্বে রয়েছে ভারত। সব মিলিয়ে পাকিস্তানের ভৌগলিক অবস্থানের কৌশলগত গুরুত্ব অনেক।


২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইমরান খান ক্রমেই আমেরিকা-বিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন। চীনের আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার আকাঙ্খা জানিয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি তিনি রাশিয়ারও কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি ইমরান খান রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সাথে মস্কোতে বৈঠক করেন। ওই দিনই ইউক্রেনে অভিযান শুরু করে রাশিয়া।
সাধারণত পাকিস্তানের ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনী দেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতি নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। কিন্তু ইমরান খানের জোরালো অবস্থানের কারণে বেশ কিছু দেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়েছিল।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের সাথে আফগানিস্তানের ইসলামপন্থী তালেবানদের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। এখন তালেবানরা আবার ক্ষমতায় এসেছে। আফগানিস্তানে এখন তীব্র অর্থনৈতিক ও মানবিক সঙ্কট বিরাজ করছে। তাদের অর্থের সঙ্কট রয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। এই পরিস্থিতিতে বলা যায় কাতার আফগানিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিদেশী অংশীদার। এক সময় এই মর্যাদার জায়গায় ছিলো পাকিস্তান।


তালেবান আর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা সম্প্রতি বেড়ে গেছে। দুই দেশের সীমান্তের কাছে হামলায় বেশ কয়েকজন সেনা হারিয়েছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। পাকিস্তান চায় তালেবানরা যাতে আফগানিস্তানে অবস্থানরত চরমপন্থী গ্রুপগুলোকে দমনের ব্যাপারে আরও সক্রিয় হয়। কারণ তা করা না হলে পাকিস্তানের ভেতরে তারা সহিংসতা ছড়িয়ে দেবে। তবে, এরই মধ্যে পাকিস্তানে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার লক্ষণ দেখা গেছে।


মানবাধিকার ইস্যুতে তালেবানদের ব্যাপারে কঠোর সমালোচনা করেছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ইমরান খান এই ইস্যুতে কখনও তালেবানদের সেভাবে সমালোচনা করেননি।
চীনের ব্যাপারেও ইমরান খানের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। পাকিস্তানের উন্নয়নে এবং বিশ্বমঞ্চে চীনের ইতিবাচক ভূমিকার কথা খান সব সময় উল্লেখ করেছেন। ৬০ বিলিয়ন ডলারের চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর চীন আর পাকিস্তানকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। এই প্রকল্পের ধারণা যখন সামনে আসে, এবং কাজ শুরু হয়, তখন পাকিস্তানে ভিন্ন দুটো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় ছিল। সম্ভাব্য নতুন সরকারে এই দুই দলেরই অংশগ্রহণ থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


পাকিস্তানের তিন বারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের ছোট ভাই শাহবাজ শরীফ নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। দেশের পূর্বাঞ্চলীয় পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালিন সময়ে শাহবাজ শরীফ সরাসরি চীনের সাথে চুক্তি করেছিলেন। রাজনৈতিক সিস্টেমের বাইরে গিয়ে বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প নিয়ে কাজ করার অতীত অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। সে ক্ষেত্রে তার ক্ষমতায় আসাকে বেইজিং ইতিবাচক ভাবেই নেবে বলে ধারণা করা যায়।


পাকিস্তানের পূর্বে রয়েছে ভারত। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে পারমানবিক শক্তিধর ভারতের সাথে তিনটি যুদ্ধ হয়েছে পাকিস্তানের। এর মধ্যে দুটিই হয়েছে মুসলিম অধ্যুষিত বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চল নিয়ে। অস্ত্রবিরতির কারণে কাশ্মীর সীমান্তে উত্তেজনা এখন ২০২১ সালের পরে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে এখনও বহু ইস্যুতে অবিশ্বাস রয়ে গেছে। সে কারণে বহু বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে কোন আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক আলোচনা হয়নি। তাছাড়া, ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর হামলার কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কঠোর সমালোচনা করেছিলেন ইমরান খান।


ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উপর নজর রাখেন ভারতের রাজনৈতিক ভাষ্যকার করণ থাপার। তিনি মনে করেন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ইসলামাবাদের নতুন সরকারের উপর চাপ দিতে পারে যাতে কাশ্মীরের সফল অস্ত্রবিরতিকে তারা আরও সামনে এগিয়ে নেয়।


পাকিস্তানের ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল কমর জাভেদ বাজওয়া সম্প্রতি বলেছেন, ভারত রাজি থাকলে তার দেশ কাশ্মীর ইস্যুতে সামনে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত আছে।
ভারতের সাথে যুদ্ধ এড়িয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টির ব্যাপারে নওয়াজ শরীফ সরকারের কিছু ভূমিকা আছে। নতুন সরকারের কাছে ভারত তাই এ ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা আশা করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে তেমন বিশেষ কোন গুরুত্ব পাবে না। কারণ ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে তিনি এখন ব্যস্ত। তাই পাকিস্তানে বড় ধরণের কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হলে বা ভারতের সাথে উত্তেজনা না বাড়লে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত এ দিকে সেভাবে নজর দেবে না।


দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সাবেক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবিন র‌্যাফেল মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এখন অন্য বহু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু রয়েছে। ফলে পাকিস্তান নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামানোর সময় ও ইচ্ছা নেই ওয়াশিংটনের। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যেহেতু পর্দার আড়ালে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতির নিয়ন্ত্রণ করছে, তাই সরকার পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরণের উদ্বেগের কোন কারণ নেই।


সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন লিসা কার্টিস। তিনি মনে করেন, পাকিস্তানের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্র বিবেচনা করে, সেগুলো হলো আফগানিস্তান, ভারত, এবং পারমানবিক অস্ত্র। এ সব ইস্যুতে নীতির ব্যাপারে আসল সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। সে কারণে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কি ঘটনা ঘটছে, সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অপ্রাসঙ্গিক।


লিসা কার্টিস মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইমরান খানের মস্কো সফর ছিল একটা বড় ধরণের বিপর্যয়ের মতো। ইসলামাবাদের নতুন সরকার অন্তত এটা মেরামতের জন্য ভূমিকা রাখার সুযোগ পাবে।

বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কটের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ি করেছেন ইমরান খান। তিনি বলেছেন, তার সাম্প্রতিক মস্কো সফরের কারণে ওয়াশিংটন তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। ওয়াশিংটন অবশ্য এ ধরণের অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে।


ইমরান খানের এই বক্তব্য পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে বলে ধারনা করা হয়। পাকিস্তানের মানুষ নানা কারনে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ক্ষুদ্ধ। পাকিস্তানের বহু মানুষ ইমরানের খানের এই বক্তব্য সত্য বলে মনে করে। অনাস্থা ভোটে হেরে যাওয়ার একদিন পর তার পক্ষে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। তারা শ্লোগান দেয় বিদেশি শক্তি ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে।


পাকিস্তানে ইমরান খানের বিরোধীরা যদি সরকার গঠন করে সে সরকারের মেয়াদ হবে সংক্ষিপ্ত। পরস্পর বিপরীত মুখী দল নিয়ে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। ফলে সে সরকারের মধ্যে নানা ধরনের বিরোধ দেখা দেবে। এছাড়া পার্লামেন্টে ইমরানের দলের সদস্য সংখ্যা কম নয়। তারা সরকারকে চাপে রাখার চেষ্টা করবেন। ইমরান খান পাকিস্তানের জনগনের মন ভালোই বুঝতে পারেন। তিনি ক্ষমতাচ্যুত হলেও এই মুহর্তে পাকিস্তানে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসাবে রয়ে গেছেন। ফলে সেনাবাহিনী তাকে উপেক্ষা করতে পারবে না।