ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে কতটা লাভবান হচ্ছে তুরস্ক

- সংগৃহীত

  • মুনতাসীর মুনীর
  • ১৬ এপ্রিল ২০২২, ১৫:২৮

রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাতে পারে বিষয়টি বেশ আগেই অনুমান করতে পেরেছিলো ইউক্রেন। কারন ইউক্রেনের ডোনবাস অঞ্চলে দীর্ঘদিন থেকে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর যুদ্ধ চলছিলো। এর আগে ক্রিমিয়া দখল করে রাশিয়া। বিশাল সামরিক শক্তির অধিকারী রাশিয়াকে মোকাবেলার জন্য ইউক্রেন যেসব দেশ থেকে সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করে তার মধ্যে তুরস্ক ছিলো অন্যতম। তবে ইউক্রেনের আশা ছিলো রাশিয়া যদি ইউক্রেনে অভিযান শুরু করে তাহলে ন্যাটো জোট তাদের পাশে দাড়াবে। যদিও বাস্তবে তেমনটি হয়নি। ইউক্রেনের বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রনে নেয়ার পর ন্যাটো সক্রিয় হয়েছে। এখস ইউক্রেনকে নানা ভাবে সামরিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। ন্যটো এখন বলছে রাশিয়ার সাথে এই যুদ্ধ হবে দীর্ঘ। এমনকি কয়েক বছর পর্যন্ত চলতে পারে এই যুদ্ধ। এই যুদ্ধের লক্ষ্য হলো রাশিয়াকে দূর্বল করে ফেলা।
ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার এই যুদ্ধে ভিন্নরকম অবস্থান নিয়েছে তুরস্ক। দেশটি একদিকে ইউক্রেনকে ড্রোনসহ সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করছে। অপরদিকে রাশিয়ার কাছ থেকে গ্যাস কিনছে। ক্রেমলিনের সাথে সুসর্ম্পক বজায় রেখে চলছে। পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার ওপর যে অবরোধ আরোপ করেছে তাতে শামিল হয়নি তুরস্ক। বরং দুপক্ষের মধ্যে শান্তি আলোচনা মধ্যস্থততা করছে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর আগ থেকে তুরস্ক কিয়েভের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশে পরিনত হয়। যাতে দেশটি ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছে।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে রাশিয়ার হামলার শঙ্কার মধ্যে এ বছরের প্রথম দিকে তুরস্ক থেকে সামরিক সরঞ্জাম আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়িয়েছিল ইউক্রেন। ৬ এপ্রিল তুর্কি এক্সপোর্টার্স অ্যাসেম্বলি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
তুরস্কের রপ্তানি প্রতিবেদনে জানা গেছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাস জানুয়ারি– থেকে মার্চ পর্যন্ত ইউক্রেনে প্রায় ৫ কোটি ৯৮ লাখ ডলারের সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি করেছে তুরস্ক। ২০২১ সালের একই সময়ে এই রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৯ লাখ ডলার। তবে তুরস্ক থেকে ইউক্রেনে কী ধরনের অস্ত্র রপ্তানি করা হয়েছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা হয়নি প্রতিবেদনে।
তুরস্কের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক আরদা মেভলুতো মনে করেন, সমরাস্ত্র বাণিজ্যে তুরস্কের অন্যতম সহযোগী দেশে পরিণত হয়েছে ইউক্রেন। রুশ বাহিনীর হামলা ঠেকাতে ইউক্রেন ইতিমধ্যে তুরস্কের তৈরি বেরাকতার-টিবি২ ড্রোন ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ বাহিনী হামলা চালানোর আগেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান কিয়েভ সফর করেন। এ সময় নতুন করে বেরেকতার-টিবি২ ড্রোন কেনা ও তুরস্কের নৌবাহিনীর তৈরি যুদ্ধজাহাজের জন্য চাহিদাপত্র দেয় ইউক্রেন। এ ছাড়া দেশেই বেরেকতার-টিবি২ ড্রোন তৈরির জন্য তুরস্কের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করে ইউক্রেন সরকার।
আরদা মেভলুতো মনে করেন , ফেব্রুয়ারি মাসে চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার পর এসব ড্রোন ও বিভিন্ন অস্ত্র ইউক্রেনে রপ্তানি করা হয়। যা রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনের সেনাদের অন্যতম রসদ। এ ছাড়া ইউক্রেনের সঙ্গে বেশ কিছু ছোট চুক্তি করেছে তুরস্ক। এর মধ্যে যোগাযোগ ও টার্গেটিং সিস্টেম রয়েছে।
গত জানুয়ারিতে ইউক্রেন তুরস্কের কাছে ১৬টি বেরেকতার-টিবি২ ড্রোন অর্ডার করে। এর আগে দেশটি তুরস্কের কাছ থেকে ২০টি এই ড্রোন কিনেছিল। গত বছর ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় ডোনবাসে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে ইউক্রেনের সেনাদের যুদ্ধে এসব ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল।
টিবি২ ড্রোনটি তুরস্কের বেসরকারি প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বেরেকতার উৎপাদন করে। তুরস্কের ড্রোন উৎপাদনকারী দুটি বিখ্যাত কোম্পানির মধ্যে বেরেকতার অন্যতম। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা সেলচুক বেরেকতার প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের জামাতা।
অপরটি হলো টার্কিশ অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রি উৎপাদিত ড্রোন আঙ্কা। তুরস্কের এসব ড্রোন পশ্চিমা দেশগুলোয় উৎপাদিত ড্রোনের চেয়ে তুলনামূলক সস্তা। কিন্তু নির্দিষ্ট স্থাপনা, উচ্চতা থেকে সঠিকভাবে যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে হামলা চালাতে এটি সক্ষম।
সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় টিবি২ ড্রোনটি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ইউক্রেনে। রুশ সেনাদের হামলা ঠেকাতে ড্রোনটি ব্যবহারে বেশ সফল হয়েছে ইউক্রেনের বাহিনী। এ ছাড়া ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ ড্রোন অবিশ্বাস্যরকম জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
কয়েক বছর ধরেই বিশ্বরাজনীতিতে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছেন।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ইউক্রেনে রুশ বাহিনী হামলা চালানোর পর থেকে এরদোয়ানের পক্ষে ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। যদিও ইউক্রেনের সঙ্গে অস্ত্র বাণিজ্য বাড়ালেও রাশিয়ার সঙ্গে সম্ভাব বজায় রেখে চলেছেন তিনি। দেশটির এমন কূটনৈতিক তৎপরতায় হতাশ পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্যরা।
তুরস্কের যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ফারহেতিন আলতুন বলেন, ন্যাটো মিত্রদের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নিয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজনীতির কারণে সামরিক বাণিজ্যে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়েছে তুরস্ক। দেশটির বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও উদ্ভাবনে এগিয়ে যাচ্ছে।
সোভিয়েত আমল থেকে ইউক্রেন সমরাস্ত্র উৎপাদন করে আসছে। ইউক্রেনের সাথে তুরস্কের প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সর্ম্পকে তুরস্কও লাভবান হয়েছে। শুধু যে তুরস্কের ড্রোন বা সমরাস্ত্র বিক্রি করে তুরস্ক লাভবান হয়েছে এমন নয়। ইউক্রেন থেকে নানা ধরনের সমরাস্ত্র তৈরির প্রযুক্তিগত সহযোগিতাও পেয়েছে তুরস্ক। যা তুরস্কের সমরাস্ত্র উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করেছে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধে সামরিক ও কৌশলগত দিক দিয়ে তুরস্ক বেশ লাভবান হয়েছে। ইউক্রেনকে পশ্চিমা সহায়তার ক্ষেত্রে তুরস্ককে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই। আবার রাশিয়ার সাথে দেশটি ভালো সর্ম্পক বজায় রেখে চলছে। পশ্চিমা বিশ্ব এতে নাখোশ হলেও ইউক্রেনকে তুরস্কের সামরিক সহায়তার গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারছে না। বেশ কিছুদিন থেকে পশ্চিমা মিডিয়ায় তুর্কি ড্রোনের গুনগান গাওয়া হচ্ছে। এর ফলে তুরস্কের এই ড্রোনের বাজার আরো সম্প্রসারিত হচ্ছে।