দ্বিমুখী নীতি নিয়ে এগোচ্ছেন বাইডেন


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৮ অক্টোবর ২০২১, ১৭:০৪

৭৮ বছর বয়সী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দায়িত্বে আসার আগে বড় দুটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতি দুটি হলো- যুক্তরাষ্ট্রকে শাসন করার পদ্ধতিতে পরিবর্তন নিয়ে আসা এবং দেশের বাইরে কৌশল পরিবর্তন করে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা। তবে, এখনও পর্যন্ত তাতে খুব বেশি অগ্রগতি চোখে পড়েনি। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এ দুই উদ্দেশ্য ও প্রতিশ্রুতি মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। প্রথম ৯ মাসে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান চারটি আধিপত্যবাদী খাত তেল, প্রযুক্তি, ঔষধশিল্প ও সামরিক খাতে অনেকটাই হোঁচট খেয়েছেন। বিশেষ করে, আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার বাইডেনের সফলতার সম্ভবনাকে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে।

মার্কিন কংগ্রেসম্যান রে খাননার মতে, ৬০-এর দশকে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন ‘গ্রেট সোসাইটি’ গঠনের জন্য যে ঐতিহাসিক সংস্কারের ডাক দিয়েছিলেন, এত বছর পরে এসে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সমাজ কাঠামো ও সামাজিক চিন্তা পরিগঠনে পরিবর্তন নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। মহামারি পরবর্তী সময়ে মার্কিন নাগরিকদের জীবনমান উন্নত করার জন্য বাইডেন জোরেশোরে কাজ করছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কাঠামোগুলোর সংস্কার, জলবায়ু পরিবর্তনের অংশ হিসেবে জাতীয় অর্থনীতিকে ক্রমাগতভাবে সবুজ অর্থনীতিতে রূপান্তর এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতেও তিনি অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

কংগ্রেসের কাছ থেকে ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো নির্মাণ বিল এবং ৩ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের সামাজিক নিরাপত্তা বিলটি ছাড় করিয়ে নেওয়াই এখন বাইডেনের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিলটির ক্ষেত্রে বাইডেন চেষ্টা করছেন যাতে কংগ্রেসকে বাইপাস করে ধণাঢ্য ব্যক্তিদের ওপর বাড়তি করারোপের মাধ্যমে খরচটি তুলে আনা যায়।

প্রতিটি বিলের ক্ষেত্রেই বাইডেন প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান তো বটেই, এমনকি নিজ দল ডেমোক্র্যাটদের কাছ থেকেও বিরোধিতার মুখে পড়েছেন। এ বিল দুটি একটি অপরটির পরিপূরক। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বিলটি পাস না হলে অবকাঠামো খাতের বিলটিও কার্যকর করা সম্ভব হবে না।

মার্কিন অর্থনীতির সামনে আরও বেশ কিছু সংকট রয়েছে। মুল্যস্ফীতি ও মুদ্রার মান কমে যাওয়া- অর্থনীতিবীদরা নিকট ভবিষ্যতে দুটিরই আশঙ্কা করছেন। ঋণ প্রদান ও ঋণ আদায় নিয়েও নানা ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বাধ্য হয়ে মার্কিন ফেডারেল প্রশাসনকে আরেকটি শাটডাউনের কথাও বিবেচনা করতে হতে পারে।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাইডেন জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির তুলনায় বরং বৈশ্বিক কৌশলকেই বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশণে ভাষণ দেওয়ার সময়ও তিনি এমনটাই ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ ভাষণে তিনি দাবি করেছেন, মানবতার ভবিষ্যত নির্ভর করছে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর। তিনি আরও দাবি করেছেন, এ দশকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এর ওপরই ভবিষ্যত পৃথিবীর কাঠামো অনেকটাই নির্ভর করবে। বাইডেন বলেছেন, অতীত থেকে চলে আসা যুদ্ধকে অব্যহত রাখার পরিবর্তে আমাদের হাতে এখনও যে সম্পদ রয়ে গেছে, সেগুলো ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ব্যবহার করা দরকার।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে তার দেশ নতুন অনেকগুলো দেশের সাথে জোট গঠন করেছে। আবার কিছু দেশের সাথে অংশীদারিত্বমূলক সম্পর্ক রচনা করেছে। যার মূল উদ্দেশ্যই হলো নিরাপত্তা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা। বাইডেন তার ভাষণে আলাদা করে ন্যাটো ও ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন, কোয়াড, আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং আসিয়ানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার বিষয়টি পরিষ্কার করেন।

বিশেষ করে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি আগ্রহের বিষয়টিও তিনি তুলে ধরেন। তিনি দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতি থেকে সরে এসেছে এবং তারা আবার জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। পাশাপাশি, প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতেও যুক্তরাষ্ট্র ফিরছে এবং আবারও যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে বলেও তিনি নিশ্চিত করেছেন।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার দেশকে সুরক্ষার বিষয়টিতেও কোনো ছাড় দেননি। তবে তিনি বলেছেন, সামরিক বাহিনীকে আমরা আমাদের লাস্ট অপশন হিসেবে প্রয়োগ করব। প্রথমেই আমরা সামরিক কৌশলের দিকে যাব না। আর পৃথিবীর তাবৎ সমস্যা সমাধানেই আমরা সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করতে চাই না। এককথায় বলতে গেলে নতুন যে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কথা বাইডেনের মুখে শোনা যাচ্ছে, তা বিগত কয়েক যুগের মার্কিন রণনীতির তুলনায় একেবারেই আলাদা। তবে, বাইডেনের কথাগুলো যতটা শুনতে ভালো মনে হয়, কিন্তু বাস্তবায়নের বিষয়টি ততটাই কঠিন মনে হচ্ছে।

বাইডেন বিবেচনা করছেন, যেভাবে এতদিন দুর্বল দেশগুলোর ওপর শক্তিশালী দেশগুলো ছড়ি ঘুরিয়েছে, তা আর অব্যাহত রাখা যাবে না। পাশাপাশি, বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আঞ্চলিক কৌশলে পরিবর্তন সাধন, অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করা, প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বীদের হেয় করা বা অপপ্রচার চালানোর মতো পুরনো চিন্তাধারাও এখন অনেকটাই গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। অন্য কোনো দেশ যদি এসব কৌশল অনুসরণও করে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তা করা আর যৌক্তিক হবে কিনা- তা নিয়েও বাইডেন ভাবতে শুরু করেছেন।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন মনে করেন যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে যদি নিম্নমানের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয় কিংবা প্রকল্প বাস্তবায়নে যদি দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয় তাহলে সে দেশগুলোর জন্য পরবর্তীতে আরও বেশি সংকটের জন্ম দেবে। এক্ষেত্রে বাইডেন চীনের চলমান বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পকে বিবেচনায় নিয়েছেন।

চীন এই একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বেশ কয়েকটি দেশে যে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করেছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো অনেকটাই পিছিয়ে। বাইডেনের জন্য আরেকটি বড়ো চ্যালেঞ্জ হলো ইসরায়েল। এতদিন যেভাবে প্রকাশ্যে ও যেনতেনভাবে যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সমর্থন দিয়ে গেছে, তা অব্যাহত থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়বে।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন নিজেও দ্বিজাতিভিত্তিক সমাধানের পক্ষে সবসময় বলে এসেছেন। তাই ইসরায়েলকে নগ্নভাবে সমর্থন করার নৈতিক সুযোগ তার নেই। বরং তাকে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ইসরায়েল একটি ইহুদি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে টিকে থাকতে পারে। আবার একইসঙ্গে ফিলিস্তিনও একটি কার্যকর, সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।

কিন্তু এখনও পর্যন্ত বাইডেন ইসরায়েল নীতিতে তার পূর্বসরীদের পদক্ষেপ অনুসরণ করে যাওয়ায় তার দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক চিন্তাধারাটা অনেকটাই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন জাতিসংঘে তার দেওয়া ভাষণে ইরানকে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হওয়া থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। ইরান যদি শর্ত মানে, তাহলে ইরানের সাথে তিনি গ্রহণযোগ্য চুক্তিতে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

কিন্তু এক্ষেত্রে বাইডেনকে আগে স্বীকার করতে হবে যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একপেশেভাবে ইরান চুক্তি থেকে বের হয়ে ভুল করেছেন। পাশাপাশি, নিঃশর্তভাবে ইরানের সাথে চুক্তিতে যাওয়া এবং অবরোধ তুলে নেওয়ার বিষয়টিও বাইডেনের জন্য আগামীতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিতে পারে।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন স্বীকার করেছেন, কর্তৃত্বপরায়ণ মানসিকতার কারণে পরাশক্তিগুলো বিশ্বে গণতন্ত্রের অনুশীলনকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। গণতন্ত্র এখন শুধুমাত্র দুর্নীতিবিরোধী জনশক্তি, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিকদের মুখে। বেলারুশ, মিয়ানমার, সিরিয়া, কিউবা ও ভেনিজুয়েলায় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের মুখের ভাষা আর পোস্টারের শ্লোগান ছাড়া আর কোথাও নেই।

কিন্তু বাইডেন এ ক্ষেত্রেও নিরপেক্ষ থাকতে পারেননি। তিনি তিউনিসিয়া, মিসর, সৌদি আরব ও ফিলিপাইনে যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দনীয় শাসকদের হাতে গণতন্ত্রের নিষ্পেষণের বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছেন। বিশ্লেষকরা বাইডেনের এ আচরণকে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হিসেবেই অভিহিত করেছেন।

চীনের ক্ষেত্রেও বাইডেনের আচরণ পরিষ্কার নয়। একদিকে, জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও মহামারি নিয়ন্ত্রণে তিনি চীনের সহযোগিতা কামনা করেছেন। আবার তাইওয়ান, হংকং ও জিনজিয়াং ইস্যুতে তিনি চীনকে কোণঠাসা করতে চেয়েছেন। এভাবে একইসাথে দুটি বিপরীতধর্মী আচরণ করে আদৌ কি কোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব?

প্রেসিডেন্ট বাইডেন জাতিসংঘের ভাষণে আরও স্বীকার করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রসহ কোনো দেশের গণতন্ত্রই সঠিক ও নিখুঁত নয়। তাই যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্র পরিচালনায় ও বৈশ্বিক নেতৃত্বদানকারী কৌশলে যে সামঞ্জস্যহীনতা ও দ্বিচারিতা রয়েছে, তার একটি সমাধান দেওয়া তার জন্য খুবই জরুরি।

এটি পরিষ্কার যে, মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি প্রয়োগের কৌশল ব্যর্থ হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে বাইডেন এখন এতসব নীতির কথা বলছেন। তবে, বাইডেনের এ কৌশল বাস্তবায়নও সহজ কিছু নয়। যদি এসব সুন্দর নীতিকথা তিনি বাস্তবায়ন করতে চান, তাহলে সবার সাথে সমঝোতা করার মানসিকতা নিয়ে আলোচনায় বসতে হবে। ছোট দেশগুলোর কথা শুনতে হবে। প্রতিপক্ষকে সুযোগ দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এর কোনোটিই সহজ নয়।