পাকিস্তান-সৌদি সম্পর্ক কতটা গভীর


  • মারুফ চৌধুরী
  • ৩০ আগস্ট ২০২১, ১৪:৫৬

পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এই সম্পর্কের ভিত বেশ মজবুত। যদিও মাঝেমধ্যে দুই দেশের মধ্যে মান-অভিমানের মতো যৎসামান্য দূরত্ব তৈরি হয়েছে, পরে আবার সেই সম্পর্কে জোড়া লেগেছে। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে অভিমান হলেও কখনও সম্পর্কের মূল ভিত্তি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি হতে দেখা যায়নি। তাই, ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্ব কিংবা ভারতের সঙ্গে সৌদি আরবের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক- এসব বৈপরিত্ব দুই দেশের সম্পর্কে ভাঙন ধরাতে পারেনি। আগামিতেও পাকিস্তান-সৌদির এই সম্পর্ক ভাঙার পরিবর্তে গভীর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

আরব জাতি ও এই এলাকার লোকজনের মধ্যে যোগাযোগের সূচনা মূলত ৭১১ সালে সিন্ধুতে হয়েছিল। সে-সময় কিছু মুসলিম পরিবার একটি বাণিজ্য জাহাজে শ্রীলঙ্কা থেকে ইরাকের বসরায় ফেরার সময় রাজা দাহিরের সৈন্যরা তাদের জাহাজ লুণ্ঠন করে লোকজনকে বন্দি করে নিয়ে যায়। সে-সময় আরব জাতির শাসক হিসেবে বর্তমান ইরাকের গভর্নর ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ।

খবরটি শোনার পর তিনি রাজা দাহিরকে চিঠি পাঠিয়ে বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার অনুরোধ করেন। হিন্দু রাজা দাহির এই অনুরোধ অস্বীকার করেন। ফলে হাজ্জাজ বন্দিদের মুক্ত করার জন্য মুহাম্মদ বিন কাসিমকে ৬ হাজার সৈন্যের একটি বহর নিয়ে সিন্ধুতে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সিন্ধুতে অবতরণের পর তিনি রাজা দাহিরের বাহিনীকে পরাজিত করেন এবং বন্দিদের মুক্ত করেন। সিন্ধু জয়ের পর মোহাম্মদ বিন কাসিম মুলতান পর্যন্ত অঞ্চলকে মুসলিম ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত করেন। তখন থেকে এই অঞ্চলের লোকদের সঙ্গে আরবদের প্রথম আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ তৈরি হয় এবং এই অঞ্চলে আরব সংস্কৃতি, খাদ্য, বিজ্ঞান, কলা ও ঐতিহ্যের উল্লেখযোগ্য প্রবেশ ঘটে। বলা যায়, আজ পাকিস্তানের রাষ্ট্র-ধর্ম ইসলাম সেই যুগেরই ভিত্তিপ্রস্তর।

পাকিস্তানের সাধারণ জনগণও সৌদি আরবের প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করেন। এক গবেষণা-জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন পাকিস্তানি সৌদি আরবকে ভালো চোখে দেখেন। ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা ওআইসির অন্যতম প্রধান সদস্য দেশ পাকিস্তান ও সৌদি আরব। বিশ্লেষকরা এক কথায় পাকিস্তান-সৌদিকে নিকটতম মুসলিম মিত্র বলেই অভিহিত করেন।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাকিস্তান-সৌদির পুরোনো সম্পর্ক নতুন রূপ নেয়। দুই দেশ ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তোলে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশ বাণিজ্য, শিক্ষা, পর্যটন, তথ্য-প্রযুক্তি, যোগাযোগ এবং কৃষিতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা সম্প্রসারণের জন্য উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল বিনিময় করেছে এবং পরিকল্পনা তৈরি করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী দেশটির সঙ্গে ইসলামাবাদ বরাবরই বন্ধুত্বের সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। পবিত্র মক্কা ও মদিনা এবং সৌদি রাজপরিবারের সুরক্ষা দেওয়াসহ তাদের সেনাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে পাকিস্তান। ১৯৭০-এর দশক থেকে পাকিস্তানি সেনারা সৌদি আরবে অবস্থান করছেন এবং সৌদি সেনা এবং পাইলটদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। ১৯৬৯ সালে দক্ষিণ ইয়েমেন থেকে আসা হামলা প্রতিহত করার লক্ষ্যে সৌদি সীমান্তে দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন পাকিস্তানি সেনা-প্রকৌশলীরা। ১৯৭০ ও ৮০-র দশকে ইরান -ইরাক যুদ্ধের সময় প্রায় ২০ হাজার পাকিস্তানি সেনা সৌদি আরবে অবস্থান করছিলেন।

১৯৭৭ সালে বাদশাহ ফয়সালের সম্মানে পাকিস্তানের প্রধান শহর লায়লপুরের নামকরণ করা হয় ফয়সালাবাদ। ১৯৮২ থেকে ৮৭ সালের মধ্যে সৌদি আরবে প্রায় ২০ হাজার সেনা মোতায়েন করে পাকিস্তান। ১৯৯১ সালে পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়ও অভ্যন্তরীণ চাপ উপেক্ষা করে সেনা পাঠায় ইসলামাবাদ। ২০০৬ সালে সৌদি আরবের বাদশাহ আবদুল্লাহ পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান নিশান-ই-পাকিস্তানে ভূষিত হন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান ঘোষণা করে, তারা ‘প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ মিশন’-এ সৌদি আরবে সেনা পাঠাবেন। সৌদি আরবের সামরিক বাহিনীতে প্রায় ৭০ হাজার পাকিস্তানি সেনা কর্মরত রয়েছেন বলে জানা গেছে।

একইভাবে সৌদি আরবও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী। নানারকম উপহার সামগ্রী এবং বিপদে-আপদে পাকিস্তানকে ক্রেডিট সুবিধা দিয়ে থাকে সৌদি আরব। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের শক্তিশালী সমর্থক ছিল সৌদি আরব। কাশ্মীর বিরোধেও পাকিস্তানের অবস্থানকে সমর্থন করে রিয়াদ এবং ভারত-পাকিস্তান শান্তি প্রক্রিয়ায় ভারতের অবস্থানের বিরোধিতা করে। সত্তরের দশকে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া-উল-হকের ‘ইসলামীকরণ’ কর্মসূচির প্রধান সমর্থক ছিল সৌদি আরব।

অনুমান করা হয় যে, সৌদি আরব গোপনে পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা কর্মসূচিতে অর্থায়ন করে এবং ইরান, ইরাক ও ইসরায়েলের হাতে থাকা গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সম্ভাব্য হুমকি মোকাবিলায় পাকিস্তান থেকে পারমাণবিক অস্ত্র কেনে। এছাড়াও, সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে তালেবান এবং আফগান মুজাহিদিনের আর্থিক ও রাজনৈতিক সহায়তার দিক থেকে পাকিস্তানের কাতারে সামিল ছিল সৌদি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাশাপাশি সৌদি আরব ও পাকিস্তানই আফগানিস্তানে প্রথমবার তালেবান শাসনকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। পাকিস্তানকে ব্যাপক ধর্মীয় ও শিক্ষাগত সহায়তা প্রদান করে সৌদি আরব। বাদশাহ ফয়সালের নামানুসারে ইসলামাবাদের ফয়সাল মসজিদের নামকরণ করা হয়।

পাকিস্তানজুড়ে মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণে প্রধান অবদান রাখছে সৌদি। ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮০০ থেকে বেড়ে ২৭ হাজার হয় এবং এগুলো পরিচালিত হয় সৌদি আরবের অর্থায়নে।

১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের পারমাণবিক পরীক্ষায় প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে সমর্থন দিয়েছিল সৌদি। পরমাণু পরীক্ষার পর পাকিস্তানকে সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য অভিনন্দনও জানিয়েছিল রিয়াদ। তখন সৌদি আরব প্রতিদিন বিনামূল্যে ৫০ হাজার ব্যারেল তেল সরবরাহের প্রতিশ্রুতিও দেয়, যাতে পাকিস্তান সম্ভাব্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করতে পারে। ২০১৬ সালে, পাকিস্তান অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিজ বা পিওএফ সৌদি আরবে ৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের রপ্তানি অর্ডার পায়।

এছাড়াও পাকিস্তান পেট্রোলিয়ামের সবচেয়ে বড় উৎস সৌদি আরব। সৌদি প্রবাসী পাকিস্তানিদের কাছ থেকে আসা রেমিট্যান্সও পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস।

সৌদি আরব ওআইসির জম্মু ও কাশ্মীর গ্রুপের সদস্য। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক অনেক পুরোনো হলেও জম্মু-কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে এই সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি হয়। ২০১৮ সালের শেষের দিকে ইসলামাবাদকে ৩০০ কোটি ডলার ঋণ ও ৩২০ কোটি ডলারের ‘অয়েল ক্রেডিট’ সুবিধা দিয়েছিল রিয়াদ। কিন্তু কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে ওআইসির সমালোচলনা করায় পাকিস্তানকে চাপে রাখার জন্য ঋণের বিপুল অর্থ দ্রুত ফেরত চেয়ে বসে সৌদি সরকার। পাকিস্তানও মাথা নোয়ায়নি। চীনের কাছ থেকে ধার করে ২০০ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে।

এর আগে ২০১৫ সালে ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সেনা পাঠাতে পাকিস্তান অস্বীকৃতি জানালে ক্ষুব্ধ হয়েছিল সৌদি সরকার। ২০১৭ সালে কাতার ও আরব দেশগুলোর বিরোধের সময়ও ফুঁসেছিল রিয়াদ। ইসলামাবাদ সে যাত্রায় নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছিল। রিয়াদ এই রাগ কমিয়েছে উপসাগরীয় অঞ্চলে পাকিস্তানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে শক্ত অবস্থানের সুযোগ করে দিয়ে।

মান-অভিমানের পথ-পরিক্রমায় এই বছর মে মাসে ইমরান খান সৌদি ক্রাউন প্রিন্স সালমানের আমন্ত্রণে সৌদি আরব সফর করেন। মার্চে ইমরান খানকে ফোন করেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। এরপর বিন সালমানকে চিঠি লেখেন ইমরান খান। চিঠিতে বিন সালমানকে ‘ভাই’ সম্বোধন করেন তিনি। এই সফরে দুই দেশের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য একটি ‘সুপ্রিম কোঅর্ডিনেশন কাউন্সিল’ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়া, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, কৌশলগত অংশীদারিত্ব, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জ্বালানি, পরিবেশ ও মিডিয়া অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

এর আগে মুহাম্মদ বিন সালমান ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান সফর করেছিলেন। পাকিস্তান, ভারত এবং চীনে ক্রাউন প্রিন্সের যাত্রার প্রথম বিরতি ছিল পাকিস্তান। এই সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল গোয়াদারে ১০ বিলিয়ন ডলারের একটি শোধনাগার ও পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স স্থাপনের চুক্তি স্বাক্ষর করা। এই সফরে ইমরান খানের অনুরোধে সৌদিতে দুই হাজারেরও বেশি পাকিস্তানি কারাবন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। ক্রাউন প্রিন্স বলেন, আমরা পাকিস্তানকে ‘না’ করতে পারি না। এক টুইট বার্তায় ইমরান খান বলেন, সৌদি আরবে প্রায় ২৫ লাখ পাকিস্তানি কাজ করেন। তাদেরকে নিজের লোক হিসেবে দেখার আহ্বান জানানোর প্রেক্ষিতে ক্রাউন প্রিন্স বলেন, সৌদিতে আমাকে পাকিস্তানের দূত হিসেবে বিবেচনা করুন। তার এই কথায় তিনি পাকিস্তানের সব মানুষের মন জয় করে নিয়েছিলেন। সেই সফরে পাকিস্তানের সঙ্গে সৌদির দুই হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার পেছনে বিভিন্ন লাভও আছে সৌদির। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, প্রয়োজন পড়লে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের মধুর সম্পর্ক রিয়াদের কাজে আসবে। যুক্তরাষ্ট্র সৌদির তেলের ওপর নির্ভরতা কমালে সেই ঘাটতি শতভাগ পুষিয়ে দিতে পারে চীন। এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি থেকে অনাকাক্সিক্ষত মার্কিন প্রভাব খর্ব করার প্রয়োজন পড়লে ইরান-সৌদির শত্রুতামূলক অবস্থানকে বন্ধুত্বে রূপান্তর করতে হবে। এতে মধ্যস্থতা করতে পারে বেইজিং। তখন পাকিস্তানের প্রয়োজনীয়তাকে জোরেশোরে কাজে লাগাবে সৌদি আরব।

কিছু মান-অভিমানের পর সৌদি-পাকিস্তান সম্পর্ক আবার ইতিহাসের উষ্ণরেখা ধরে চলছে। এই সম্পর্ক উষ্ণ হতে বাধ্য। কারণ, দুই জাতির বিশ্বাস ও চিন্তার গন্তব্য এক, আর সেটি হলো- পবিত্র কাবা।