মার্কিন ও ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের পর আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করেছে তালেবান। এরইমধ্যে তারা দেশটির বেশিরভাগ এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। তালেবানের পুনরায় ক্ষমতা দখলের পর পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলো।
তাজিকিস্তানে সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন বা এসসিও-র এবারের সম্মেলনের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল আফগানিস্তান পরিস্থিতি। সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের সদস্য দেশগুলোর বেশ কয়েকটির সাথে আছে আফগানিস্তানের সীমান্ত। মধ্য-এশিয়ার চারটি দেশের পাশাপাশি সংগঠনটিতে আছে রাশিয়া ও চীনের মতো দুই পরাশক্তি। চিরবৈরী দুই প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান এবং ভারতও এসসিও-র সদস্য। আফগানিস্তান, ইরান, বেলারুশ ও মঙ্গোলিয়া সংগঠনটিতে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা লাভ করেছে।
এসসিও-র সদস্য দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আফগান কন্টাক্ট গ্রুপের দুই দিনব্যাপী বৈঠক হয়। বৈঠকের পর সদস্য দেশগুলোর এক যৌথ বিবৃতিতে আফগান সংঘাতে জড়িত সব পক্ষকে সহিংসতা পরিহার করার আহবান জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে এমন কিছু না করারও আহবান জানানো হয়েছে, যাতে আফগানিস্তানের প্রতিবেশী এসসিওভুক্ত দেশগুলোর সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ‘একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ, ঐক্যবদ্ধ, শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ দেশ’ হিসেবে আফগানিস্তানের গড়ে ওঠার প্রতিও তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘আমরা এসসিও-র এই অবস্থান নিশ্চিত করতে চাই যে, আফগানিস্তানে চলমান সংঘাতের রাজনৈতিক সমাধান ও একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শান্তি প্রক্রিয়ার কোনো বিকল্প নেই। শান্তি আলোচনাই হচ্ছে একমাত্র সমাধান।’ একইসঙ্গে তারা সন্ত্রাসবাদ ও মাদকসংশ্লিষ্ট অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এসসিও-র পক্ষ থেকে আফগানিস্তানকে সহযোগিতা করারও প্রতিশ্রুতি দেন।
চীন ও রাশিয়া তালেবানের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করতে চায়, আফগানিস্তানে জিহাদি তৎপরতাকে কোনোভাবেই ডালপালা ছড়াতে দেওয়া যাবে না। দেশ দুটির শেষ কথা হচ্ছে- এখানে উৎপাদনশীল বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। পাশাপাশি আফগানিস্তানকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যুক্ত করতে হবে। এবং পরবর্তীতে দেশটি ইউরেশিয়া ইকোনমিক ইউনিয়নেও যুক্ত হবে।
আফগান শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে এসসিও দীর্ঘদিন ধরে যে আলোচনা করছে, তার বাস্তবায়ন করার সুযোগ সংগঠনটির সামনে এসেছে। এসসিও-র পরিকল্পনা হচ্ছে- এশীয় সমাধানই আফগানিস্তানে সংঘাত অবসানের একমাত্র পথ।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই তার আফগান প্রতিপক্ষ মোহাম্মদ হানিফ আতমারের কাছে বন্ধুপ্রতীম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চীনের হস্তক্ষেপ না করার নীতি তুলে ধরেন। এ-সময় তিনি আফগান সংকট সমাধানে তিন দফার অগ্রাধিকারভিত্তিক একটি মৌলিক রোডম্যাপ আতমারের কাছে তুলে ধরেন।
চীনের দেওয়া তিন দফার মধ্য আছে- সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধ বন্ধের জন্য জাতীয় ঐকমত্য ও স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে প্রকৃত আন্তঃআফগান আলোচনা শুরু করা। বেইজিং এই আলোচনা বা সংলাপ অনুষ্ঠানে সহায়তা করবে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। অর্থাৎ, আল কায়েদা, আইসিস-খোরাসান ও ইস্টার্ন তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট বা ইটিআইএম-এর মতো সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করা। আফগানিস্তান যাতে আবারও উগ্রপন্থী গোষ্ঠিগুলোর অভয়ারণ্যে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সব সন্ত্রাসী গ্রুপের সাথে তালেবানকে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, হানিফ আতমার ওয়াং ই-র এই তিন দফার সাথে সম্পূর্ণ একমত হয়েছেন। তিনি ইটিআইএম-এর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর বিষয়ে বেইজিংয়ের সাথে সমন্বিতভাবে কাজ করার কথাও জানান চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের দূত জমির কাবুলভ একটি আফগান পরিকল্পনা তৈরি করেছেন। রাশিয়ার পরিকল্পনার প্রধান দিক হচ্ছে আগামী ২-৩ বছরের জন্য একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের লক্ষ্যে আফগান সরকার ও তালেবান আলোচনা শুরু করবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে- আন্তঃআফগান আলোচনা শুরুর পর পরই তালেবানের ওপর থেকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পদক্ষেপ নিতে হবে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলে তালেবান একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
তালেবান সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের রোডম্যাপ মেনে নিতে প্রস্তুত রয়েছে বলে আভাস পাওয়া গেছে। তালেবানের মুখপাত্র সোহাইল শাহীন সম্প্রতি জোর দিয়ে বলেছেন, ‘চীন বন্ধুপ্রতীম একটি দেশ। আফগানিস্তানের পুনর্গঠন ও উন্নয়নকাজে চীনের উদ্যোগকে তারা স্বাগত জানান।
তালেবান প্রসঙ্গটি খুব জটিল একটি বিষয়। রাশিয়া এখনও তালেবানকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকাভুক্ত করে রেখেছে। কিন্তু তারপরও রাশিয়া এবং চীন উচ্চপর্যায়ের কূটনৈতিক তৎপরতায় তালেবানকে যুক্ত রাখার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। অন্যদিকে আফগানিস্তানের ব্যাপারে এসসিও-র সদস্য দেশ পাকিস্তানের ভূমিকাতেও সন্তুষ্ট চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই।
আফগানিস্তানের ব্যাপারে চীনের দৃষ্টি এখন বহু স্তরের চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের দিকে। এই কানেক্টিভিটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমেই কাবুলকে শক্ত বাঁধনে বাঁধতে চায় বেইজিং। টেলিযোগাযোগ ক্ষেত্রে এরইমধ্যে চীন আফগানিস্তানে পৌঁছে গেছে। চায়না টেলিকম ও আফগান টেলিকম ২০১৭ সালে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির আওতায় চীনের কাশগড় থেকে আফগানিস্তানের ফাইজাবাদ পর্যন্ত ফাইবার অপটিক ক্যাবল নেটওয়ার্ক নির্মাণ করবে চায়না টেলিকম। পরে তা চায়না-কিরগিজস্তান-তাজিকিস্তান-আফগানিস্তান সিল্ক রোড সিস্টেমে রূপান্তরিত করা হবে।
এছাড়া পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও উজবেকিস্তানের মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগ গড়ে তুলতে গত ফেব্রুয়ারিতে চীনের সাথে চুক্তি হয়েছে। মধ্যএশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপনে আফগানিস্তানকে ব্যবহার করা হবে। এটি হবে একটি এসসিও করিডোর। গত মাসে চীন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে এসব বিষয় চূড়ান্ত করা হয়। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির সরকার চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হতে এরইমধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আবার তালেবানও এই নেটওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার কথা উল্লেখ করেছে।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এটা ভালো করেই জানেন যে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে থাকা তালেবানরা চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর বা সিপিইসিকে টার্গেট করবে না। কেননা চীনের কয়েকটি অপটিক ফাইবার প্রকল্প পাকিস্তানের পেশোয়ার ও আশপাশের এলাকায় টেলিফোন নেটওয়ার্ক অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটাবে। এজন্য এই দুটি সংগঠন সিপিইসি-র কোনো প্রকল্পে হামলা করবে না।
ইরানেরও আফগানিস্তানের ব্যাপারে নানা পরিকল্পনা রয়েছে। ইরান ও চীনের মধ্যে সম্প্রতি স্বাক্ষরিত ২৫ বছর মেয়াদি কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তিতে আফগানিস্তানকে জড়িয়ে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে ইরানের। চীনের সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামো নেটওয়ার্ক চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরকে আফগানিস্তানে সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা রয়েছে চীনের। তালেবানও এটা ভালো করেই জানে।
সম্প্রতি তালেবান ও আপগান সরকারের দুটি প্রতিনিধি দল ইরান সফর করে সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছে। যুদ্ধের কারণে ১০ লাখের বেশি আফগান উদ্বাস্তু বর্তমানে ইরানে রয়েছে। এটিও ইরানের জন্য একটি সমস্যা। ইরানও চায় না আফগনিস্তানে যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।
ইরান এসসিও-র পর্যবেক্ষকের মর্যাদা লাভ করেছে। চীন ও রাশিয়ার সমর্থনে অবধারিতভাবেই দেশটি এক সময় পূর্ণ সদস্য পদ লাভ করবে। আফগানিস্তানও দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে আসছে সংগঠনটির সদস্য হওয়ার। এক্ষেত্রে ইরানের সহযোগিতা ও সমর্থন আফগানিস্তান ও তালেবানের প্রয়োজন। এসব কারণে ইরানও আফগান সংকটের এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। কিন্তু আফগানিস্তানে দৃশ্যমান নতুন পরিস্থিতিতে তেহরান কী ভূমিকা পালন করবে, সে ব্যাপারে নীতিনির্ধারকরা এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেননি। আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশের সাথে ইরানের মাশাদ অঞ্চলের সীমান্ত রয়েছে। এখানে দুই দেশের মধ্যে হাইওয়ে করিডোর রয়েছে। তালেবান দুটি জেলা ছাড়া পুরো হেরাত প্রদেশই দখল করেছে।
তালেবানের মুখপাত্র সোহায়েল শাহীন বলেছেন, ইরান থেকে শুরু করে মধ্যএশিয়ার দেশগুলোর সাথে আফগানিস্তানের আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য সবসময়ই চালু থাকবে। এ-ক্ষেত্রে কেউ কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। অন্যদিকে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পশ্চিম এশিয়া ডেস্কের মহাপরিচালক রসুল মুসাভি বলেছেন, তালেবান আফগানিস্তানের ঐতিহ্যবাহী সমাজেরই অংশ, তারা এর থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। তারা বিবেচনা করেই সব কিছু করবে বলে আমরা আশা করি।
সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সন্দেহ বাড়ছে, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করলেও দেশটিতে গৃহযুদ্ধ বাঁধানোর পরিকল্পনা থেকে সরে আসেনি। অনেকে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে ইরাকে আগ্রাসন চালানো ও দখলদারিত্ব কায়েমের আগে দেশটিতে ইসলামিক স্টেট বা আইএস নামের কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু সেখানে মার্কিন বাহিনী থাকার সময়েই এই সংগঠনের জন্ম হয়েছে।
আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী থাকার সময়েই আইসিস খোরাসান নামের নতুন জঙ্গি সংগঠনের কথা শোনা যাচ্ছে। মার্কিন বাহিনীর নাকের ডগায় কী করে এই সংগঠনের জন্ম হলো, সেই প্রশ্ন তুলেছে আফগান মিডিয়া। তাদের সন্দেহ- আফগানিস্তানে নতুন করে গৃহযুদ্ধ শুরু করার জন্যই যুক্তরাষ্ট্র এই সংগঠনটির জন্ম দিয়েছে।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে যুক্তরাষ্ট্র এখন আফগান সরকারকে নানাভাবে সহায়তা দিতে শুরু করবে বলে আশঙ্কা করছে আফগান মিডিয়া ও এসসিওভুক্ত দেশগুলো। ফলে আফগানিস্তানে নতুন করে বড় ধরনের খেলা শুরু হয়ে যেতে পারে।