তিব্বতের রাজধানী লাসা থেকে নিংচি পর্যন্ত চালু হয়েছে ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ আলোচিত চীনা বুলেট ট্রেন। নতুন এই রেললাইন তিব্বতে চীনের একটি বড় ধরনের উন্নয়ন পদক্ষেপ। এই রেললাইন এখন ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দেখা দিতে যাচ্ছে। এই রেললাইন ও ট্রেন চালুর মাধ্যমে এই অঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে।
নিংচি ভারতের অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তের খুব কাছে। আর ভারতের অরুণাচল প্রদেশের সীমানা নিয়ে রয়েছে চীন-ভারত বিতর্ক। ভারতের বিভিন্ন মহল থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, অরুণাচল সীমান্তের নিংচি পর্যন্ত চীনা বুলেট ট্রেন ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে উদ্বেগজনক।
ভবিষ্যত সম্ভাব্য যে কোনো যুদ্ধে চীন দ্রুত এসব অঞ্চলে সৈন্য এবং অস্ত্র সরবরাহ করতে পারবে। লাসা-নিংচি বুলেট ট্রেন নিয়ে ভারতের উদ্বেগের আরেকটি কারণ হলো, এটি চীনের বৃহৎ রেল প্রকল্পের অংশ। এর প্রথম অংশমাত্র সম্পন্ন হয়েছে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ধাপ সম্পন্ন হলে গোটা চীনের হাই-স্পিড রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হবে তিব্বত। চীনা মূল ভূখণ্ডের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে তিব্বতের দূরত্ব অভাবনীয় মাত্রায় কমে যাবে।
নিংচির অবস্থান ভারতের অরুণাচল প্রদেশের সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটারের কম। হিমালয় অঞ্চলে চীন-ভারত সঙ্ঘাতের অন্যতম ফ্রন্টলাইন হলো নিংচি। লাশা-নিংচি রেললাইন তৈরি হয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদীর সমান্তরালে। ব্রহ্মপুত্রের উৎস তিব্বতের মানস সরোবরে।
অবশ্য চীনের দাবি সামরিককাজে এ রেললাইন ব্যবহারের প্রয়োজন নেই তাদের। এই রেল নেটওয়ার্কের উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক এবং আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করা। লাসা-নিংচি হাই মাউনটেইন বুলেট ট্রেনের কারণে চীনের বাণিজ্য এবং পর্যটন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।
তিব্বত ডেইলির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন রেললাইন পৌঁছতে পারে ভারত সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ সব চেকপয়েন্টে এবং এর মাধ্যমে চীনা আর্মি তাদের সীমান্ত ব্যারাকে দ্রুত সেনা ও লজিস্টিক পৌঁছাতে পারবে। এ-সমস্ত ক্যাম্প এবং সামরিক স্থাপনা ছড়িয়ে আছে ভারতীয় সীমান্তজুড়ে।
চীনা গ্লোবাল টাইমসের বরাতে ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছে, নতুন রেললাইনের মাধ্যমে চীন দ্রুত সীমান্তে সৈন্য এবং অস্ত্র পৌঁছাতে পারবে। নতুন বুলেট ট্রেন চালু হওয়ায় লাশা থেকে নিংচি শহরে যাতায়াতে এখন সময় লাগবে মাত্র আড়াই ঘণ্টা। আগে সড়ক পথে লাসা-নিংচি যাতায়াতে সময় লাগত ৯ ঘণ্টা।
এই বুলেট ট্রেনের রেললাইন ২৫০ মাইল দীর্ঘ। নতুন এ রেললাইন তিব্বতের রাজধানী লাসা থেকে আলপাইন অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিমের নিংচি আউটপোস্ট পর্যন্ত। নতুন এ রেললাইন চালুর ফলে চীনা মূল ভুখন্ডের ৩১টি প্রভিনশিয়াল স্তরের রাজ্যের হাই স্পিড রেল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হলো পৃথিবীর ছাদ নামে পরিচিতি তিব্বতের সঙ্গে। নতুন এই বুলেট ট্রেন সম্পূর্ণরূপে বিদ্যুৎ চালিত। এটিই তিব্বতে এ ধরনের প্রথম রেল করিডোর।
হিমালয়ের কোলে অবস্থিত উচু পাহাড় আর বরফ আচ্ছাদিত অঞ্চলে এ রেললাইন নির্মাণ ছিল চীনের জন্য একটি বড় ধরনের জটিল আর কঠিন প্রকল্প। মোট রেললাইনের ৯০ ভাগ সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার মিটার উচুতে অবস্থিত।
আড়াইশ মাইল এ দীর্ঘ রেললাইনে রয়েছে ৪৭টি টানেল এবং ১২১টি ব্রিজ। মোট রেললাইনের ৭৫ ভাগ হলো এসব টানেল এবং ব্রিজ। এর মধ্যে রয়েছে ৫২৫ মিটার দীর্ঘ জাংমু রেলওয়ে ব্রিজ। এটি এখন বিশ্বের দীর্ঘতম এবং উচু আর্ক রেল ব্রিজ।
চীনের মোট ৬ বছর লেগেছে বুলেট ট্রেনের টানেল এবং ব্রিজ নির্মাণে। বুলেট ট্রেনলাইন নির্মাণে খরচ হয়েছে ৫ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। ট্রেনের মধ্যে রয়েছে অটোমেটিক অক্সিজেন সাপ্লাই সিস্টেম। প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে ২১ ভাগ অক্সিজেন রয়েছে। আর ট্রেনের মধ্যে রাখা হয়েছে অক্সিজেন লেভেল ২৩ ভাগ ।
চীনের অন্যান্য অনেক রেললাইনের গতি যেখানে ঘণ্টায় সাড়ে তিনশ কিলোমিটার সেখানে তিব্বতের বুলেট ট্রেনের গতি রাখা হয়েছে ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার।
নতুন চালু হওয়া লাশা-নিংচি রেললাইন চীনের বৃহৎ লাসা-চেংদু-ইয়ান রেল প্রকল্পের অংশ। তিনটি ধাপে শেষ হবে এ প্রকল্প। প্রথম ধাপ লাসা-নিংচি রেললাইন চালু হয়েছে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ধাপের কাজও শুরু হয়েছে।
সিচুয়ান-তিব্বত রেললাইনের নির্মাণ শেষ হবে ২০২৬ সালের মধ্যে। সিচুয়ান-তিব্বত লাইন নির্মাণ শেষ হলে এটি যুক্ত হবে লাসা-নিংচি লাইনের সঙ্গে। ফলে সিচুয়ানের রাজধানী চেংদুর সঙ্গে যুক্ত হবে তিব্বতের রাজধানী লাসা। লাসা এবং চেংদুর মধ্যে যাতায়াত করতে বর্তমানে সময় লাগে ৪৮ ঘণ্টা। এসময় কমে আসবে মাত্র ১৩ ঘণ্টায় । সিচুয়ান-তিব্বত রেললাইনের দৈর্ঘ্য ১ হজার ১০১ কিলোমিটার।
নিংচি-ইয়ান বুলেট রেললাইন হলো প্রকল্পের তৃতীয় ধাপ। ২০২০ সালে এর নির্মাণ শুরু হয়েছে এবং শেষ হবে ২০৩০ সালে । এ প্রকল্প শেষ হলে সিচুয়ানের ইয়ান শহরের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হবে লাসা। ভারতের অনেক বিশ্লেষক অভিযোগ করছেন লাসা-নিংচি রেললাইনের বিভিন্ন অংশ চীন-ভারত বিতর্কিত এলাকায় পড়েছে।
চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রদেশের ইউনান থেকে আরেকটি রেললাইন এবং এর পাশপাশি ফিডার লাইন নির্মাণের মাস্টার প্লান গ্রহণ করেছে চীন। কৌশলগতভাবে এ রেললাইনও স্বায়ত্বশাসিত তিব্বত রাজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ লাইন একইসঙ্গে ভারতের বিরুদ্ধে চীনের সীমান্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করবে।
চীন জানিয়েছে নতুন লাশা-নিংচি রুটে বুলেট ট্রেন চালুর পর ইতোমধ্যে এ রুটের সমস্ত পর্যটন রুটে ট্রেন ট্রিপ বুকিং হয়ে গেছে। ফলে অতিরিক্ত চাহিদা পূরনে এখন বেইজিং, শাংহাই ও গুয়াংজু থেকে লাশা-নিংচি পর্যন্ত নতুন ট্রেন যুক্ত করা হবে।
বর্তমানে চীন-ভারত উভয়ে সীমান্তে সৈন্য এবং ভারী অস্ত্র জড়ো করে চলছে। চীন সীমান্তে মোতায়েনকৃত ২ লাখ সেনার সঙ্গে সম্প্রতি নতুন করে যুক্ত হয়েছে ভারতীয় ৫০ হাজার অতিরিক্ত সেনা। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী জয়শঙ্কর স্বীকার করেছেন তারা সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ অব্যাহত রেখেছে।
লাদাখ অঞ্চলে চীনকে মোকাবেলায় ফ্রান্সের রেফালে বিমান মোতায়েনের পর ভারত নতুন করে সাড়ে তিনশ শক্তিশালী হালকা ট্যাঙ্ক কেনার উদ্যোগ নিয়েছে। হিমালায় অঞ্চলে দ্রুত সেনা ও অস্ত্র সরবরাহে জন্য ডেডিকেটেড রেল করিডোর স্থাপন করেছে ভারত।
চীনের নতুন রেললাইন চালুর সঙ্গে সীমান্তে ভারতের অতিরিক্ত ৫০ হাজার সেনা মোতায়েনের কোনো সম্পর্ক আছে কি না তা স্পষ্ট নয়। চীনের মোকাবেলায় ভারতও সীমান্ত অঞ্চলে সড়ক এবং টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে।
জাওয়াহারলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের চীন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর শ্রীকান্ত কোন্দাপালি মনে করেন ভারত সীমান্তে চীনা এসব রেল নেটওয়ার্কের উদ্দেশ্য হতে পারে চীনা আর্মির প্রয়োজন পূরন। এ রেল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চীনা আর্মির আওতা আরো বিস্তৃত হবে ।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, সীমান্ত অঞ্চলে চীনা সৈন্য এবং সমরাস্ত্র বহনের জন্য এ রেললাইনের প্রয়োজন হবে না। কারণ চীনের পর্যাপ্ত ও বিস্তৃত সড়ক এবং বিমান অবকাঠামো রয়েছে। নিংচিসহ চীনা বিভিন্ন সীমান্ত শহরে রয়েছে অনেকগুলো এয়ারফিল্ড।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, চীন এই রেলকে সামরিক উদ্দেশে ব্যবহার করবে না। কারণ, যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের সহজ টার্গেটে পরিণত হতে পারে সীমান্তের রেললাইন। সে-ক্ষেত্রে চীন যদি রেললাইনের ওপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে যুদ্ধের সময় সহজে নিজের জন্য বিপদ ডেকে আনবে। কিন্তু ভারতের বিশ্লেষকদের শঙ্কা কাটছে না। কারণ, তাদের স্মৃতিতে আছে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের দৃশ্যপট। যে যুদ্ধে ভারত শোচনীয়ভাবে হেরে গিয়েছিল।