ভূরাজনীতিতে হঠাৎ করে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে পাকিস্তান। এর একটি বড় কারণ চীনের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক। পাকিস্তানের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে চীনের উত্থান বর্তমান সময়ে নানা দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। বাণিজ্যিক দিক থেকেও বিশ্ববাজারে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে দেশটি। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ৫২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। নানা কারণেই অনেক আগে থেকে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কিন্তু দেশ দুটির এই সম্পর্ককে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করছে না যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। আঞ্চলিক রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়ছে।
চীন-পাকিস্তান সম্পর্কের যাত্রা শুরু ১৯৫১ সালে। এ বছর জাতীয়তাবাদী থেকে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া চীনকে স্বীকৃতি প্রদান করে পাকিস্তান। তারপর থেকেই দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ক্রমে তা আরও গভীর হতে থাকে। বর্তমানে তা দ্বিপক্ষীয় মৈত্রীর সম্পর্কের একটি উদাহরণ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে দুই দেশই আর্থিক লেনদেন ও কৌশলগত প্রয়োজনের নিরিখে তাদের সম্পর্ককে সামনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে।
চীনের গৃহীত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরকে পাকিস্তানের ভাগ্য পরিবর্তনের একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, এই প্রকল্পের মাধ্যমে পাকিস্তানের অবকাঠামো খাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে চীন। ধারণা করা হচ্ছে, এই প্রকল্প পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।
ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক দেশ দুটির জন্মের পর থেকেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। ভারত তার নীলনকশা অনুযায়ী কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিকসহ সব ফ্রন্টেই পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন বা একঘরে করে রাখতে চায়। প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় জোট বা নর্দান অ্যালায়েন্স পাকিস্তানের ব্যাপারে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। এই জোট আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে থাকে।
পাকিস্তানের পশ্চিমে আছে ইরান। এই প্রতিবেশীর সঙ্গেও পাকিস্তানের খুব একটা সুসম্পর্ক নেই। বিশ্বের আরেক বৃহৎ শক্তি রাশিয়ার সঙ্গেও পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই পাকিস্তানকে তাদের ইচ্ছায় চলতে বাধ্য করার চেষ্টা করে থাকে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় বা বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে নানা নির্দেশনা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যখন ইচ্ছা করেছে, তখনই পাকিস্তানে আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক কখনও ভালো ছিল না।
চারিদিকের এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে পাকিস্তান এমন একটি দেশ বা শক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকে । যে দেশটি তার বিপদের দিনে প্রকৃত বন্ধু হিসাবে পাশে থাকবে। সেদিক থেকে চীনই হয়ে ওঠে পাকিস্তানের পছন্দের একটি দেশ।
জাতিসংঘ, সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পাকিস্তানের সহায়তায় এগিয়ে এসেছে চীন। নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার গ্রুপ এর সদস্য পদের জন্য পাকিস্তানের উদ্যোগক সব সময়ই সমর্থন করেছে বেইজিং। এছাড়া জম্মু ও কাশ্মির ইস্যুতেও পাকিস্তানের পাশে দাড়িয়েছে চীন। এসব নানা কারণেই পাকিস্তান চীনের দিকে ঝুকে পড়েছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক বা সিজিটিএনকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের মতো দেশকে কোন পক্ষ নিতে বলা যুক্তরাষ্ট্র কিংবা অন্য কোন পশ্চিমা শক্তির জন্য শোভন নয়। এটি একটি অন্যায্য কাজ। তিনি বলেন, ‘যা কিছুই ঘটুক না কেন, যত চাপই আসুক না কেন, পাকিস্তান ও চীনের সম্পর্কে কোন পরিবর্তন আসবে না।
ইমরান খান বলেন, গত ৭০ বছর ধরে পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে ‘একটি বিশেষ সম্পর্ক’ গড়ে উঠেছে। সকল দিক থেকে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কৌশলগত এই সম্পর্ককে কেন কিছুই পরিবর্তন করতে পারবেনা। চীন ও পাকিস্তানের এই সম্পর্ককে সাধারণত পর্বতের চেয়েও উচু, সাগরের চেয়েও গভীর, মধুর চেয়েও মিষ্টি, ষ্টীলের চেয়েও শক্তিশালী হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
এজন্যই এই দুই দেশকে আয়রন ব্রাদ্রার্স বা চীনা ভাষায় ‘বা টাই’ বলা হয়ে থাকে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দুই দেশের সম্পর্কের বিষয়ে বলেন, ‘চীন ও পাকিস্তানের সম্পর্ক খুবই গভীর। এই সম্পর্ক কেবল দুই দেশের সরকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা গড়ে উঠেছে দুই দেশের জনগণের মধ্যেও।
পুরো সাক্ষাৎকার জুড়েই ইমরান খান দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতাকে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, যা কিছুই ঘটুক, যত চাপই পাকিস্তানের উপর আসুক না কেন দুই ‘ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশির’ মধ্যে সম্পর্কের কখনোই অবনতি ঘটবেনা। ইমরানের এই সাক্ষাতকারে দুদেশের সর্ম্পকের দিকগুলো বেশ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ইমরান কোনো রাখ ঢাক না করেই চীনের প্রতি তার সমর্থন প্রকাশ করেছেন। এমনকি চীনের উইঘুর নীতিকেও তিনি সমর্থন করেছেন। যা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছেন।
ইমরান খান স্বীকার করেন দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূরাজনীতি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র চীন বিরোধী সেন্টিমেন্টকে প্রবল ভাবে উস্কে দেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইমরান জানিয়ে দেন, পাকিস্তান কখনোই ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টিকারি এই প্রচারণার অংশিদার হবেনা। তার মতে পাকিস্তান একটি দায়িত্বশীল দেশ এবং জন্ম থেকেই শান্তি প্রিয় জাতি। ইতিহাস আমাদেরকে তিক্ত শিক্ষা দিয়েছে, পাকিস্তান আর কখনোই সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করবেনা।
সাবেক এই ক্রিকেট তারকা বলেন, যেকোন সময়, যেকোন স্থানে, যে কারো সঙ্গে শান্তি, উন্নয়ন ও গঠনমূলক কাজে অংশিদার হওয়াটাই পাকিস্তানের সুস্পষ্ট নীতি। কোথাও কোন আগ্রাসন, যুদ্ধ, আক্রমন, সংঘাত বা ঘৃনা ও বিদ্বেষ সৃষ্টিকারি কাজের অংশিদার পাকিস্তান আর কখনোই হবে না।
ইমরান খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বেও অনেক বড় মূল্য দিতে হয়েছে পাকিস্তানকে। বিশেষ করে গত চার দশকে আফগানিস্তানে সীমাহীন আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। পাকিস্তানের অবদানের ও ইতিবাচক ভূমিকার স্বীকৃতি যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে দিয়েছে । কিন্তু এখনও দেশটি পাকিস্তানের উপর কঠোর অবরোধের বোঝা চাপিয়ে রেখেছে।
ইমরান এই সাক্ষাতকারে এ অঞ্চলে ভূ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়েও কথা বলেছেন। তিনি বলেন, এই অঞ্চলে ‘একটি আশ্চর্যজনক, মারাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ গড়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘কোয়াদ’ নামে একটি আঞ্চলিক জোট গড়ে তুলেছে। এই জোটে ভারত ও অন্য কয়েকটি দেশ রয়েছে। যদি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পরিবর্তন বা মৈত্রীর বন্ধন কমিয়ে আনার জন্য পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয় তাহলে তা কার্যকর হবেনা।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চীনবিরোধী জোট ‘কোয়াদ’ এর সদস্য হিসেবে ভারতকে অনেক বেশি উদারতা দেখানো হচ্ছে, অনেক সমর্থন দেওয়া হচ্ছে । উদার অর্থনৈতিক সহায়তা, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন, আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ, বাণিজ্য ছাড় ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইসরাইলের পর বর্তমানে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম সুবিধা প্রাপ্ত দেশ। চীনের বিরুদ্ধে উঠে দাড়াতে ভারতকে সবদিক থেকেই সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইমরানের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া সব সহায়তা ও সুবিধা ভারত কাজে লাগাচ্ছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। এটা একেবারেই অনৈতিক কাজ বলে মন্তব্য করেন ইমরান খান। চীনের দিকে পাকিস্তানের ঝুকে পড়ার পেছনে যে সমীকরন কাজ করছে সেটা বেশ স্পষ্ট।
ইমরান বলছেন, পাকিস্তান যখনই রাজনৈতিক বা আন্তর্জাতিকভাবে অথবা প্রতিবেশি বৈরি দেশ ভারতের সঙ্গে কোনো সমস্যায় পড়েছে তখনই চীন পাকিস্তানের পাশে দাড়িয়েছে। সুদিনে প্রত্যেকেই আপনার পাশে থাকবে। কিন্তু দুর্দিনে বা খারাপ সময়ে যে পাশে দাড়াবে তার কথা সব সময়ই স্মরণে থাকবে। ইমরানের দাবি এ কারণেই পাকিস্তানের জনগনের মাঝে চীনের জনগণের প্রতি অপরিসীম ভালবাসা রয়েছে।
এই প্রথম পাকিস্তানের কোনো সরকার প্রধান চীনের পক্ষ নিয়ে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করলেন। তিনি এমন এক সময় এই সাক্ষাতকার দিলেন যখন আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা চলে যাচ্ছে। এ অঞ্চলে এক ধরনের শুন্যতা তৈরি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তান আরো বেশি চীনের দিকে ঝুকে পড়তে যাচ্ছে।
দুই দেশের সম্পর্ক কোন ক্ষেত্রে আরো বেশি গভীর হতে পারে তাও জানিয়েছেন ইমরান। তিনি বাণিজ্য বাড়ানোর কথা বলেছেন। চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর বা সিপিইসিকে পাকিস্তানের জন্য একটি বিরাট বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেন।
পাকিস্তানের অনেকেই এটা বিশ্বাস করেন যে, সিপিইসি পাকিস্তানের দুর্বল অর্থনীতির জন্য অক্সিজেন হিসেবে কাজ করবে। সাক্ষাৎকারে ইমরান খান ভূরাজনীতিতে পাকিস্তানের দৃঢ় ও সুস্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরেছেন। চীন-পাকিস্তান বন্ধুত্বের সম্পর্কের ৭০ বছর পূরণ হওয়া উপলক্ষে ইমরান খান ও চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং যে চিঠি লিখেছেন, তাতে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে আরও গভীর করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।