কার নিয়ন্ত্রণে যাবে আফগানিস্তান?


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০৫ জুলাই ২০২১, ১৩:৪৪

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর দেশটিতে নতুন করে গৃহযুদ্ধের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরইমধ্যে দেশটির বড় বিমানঘাঁটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা চলে গেছেন। তালেবানরা একের পর এক এলাকা দখল করছেন। দেশটির সরকারি বাহিনী এখন এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, তাদের ভাড়া করতে হয়েছে মিলিশিয়া যোদ্ধাদের। তবে তাতেও হয়তো শেষ রক্ষা হবে না। নতুন করে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে কিংবা আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে গেলে কেমন হতে পারে দেশটির রাজনৈতিক চিত্র।

বছরের পর বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনী প্রশিক্ষণ ও অর্থসহায়তা দেওয়ার পরও আফগান সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী খুবই দুর্বল। তালেবানের হামলার আশঙ্কায় ইতোমধ্যেই কয়েক ডজন সিকিউরিটি পোস্ট ছেড়ে চলে গেছে এই বাহিনী।এমনকি তালেবানরা সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো দখলে নিলে বিচারের মুখোমুখৗ হওয়ার ভয়ে অনেক আফগান সেনা সশস্ত্র গোষ্ঠিটির সাথে যোগ দিতে শুরু করেছে।

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর প্রশিক্ষিত এসব সেনারা বাহিনী ত্যাগ করছে তার আরেকটি কারণ মাসের পর মাস বেতন না পাওয়া। যে কারণে তারা সাজোয়া যানের বহর, মেশিন গান ও মর্টারসহ অনেক সমরাস্ত্র তালেবানদের হাতে তুলে দিচ্ছে। যাতে তারা নিরাপদে বেড়িয়ে যেতে পারে অথবা অর্থের বিনিময়ে তালেবানের সাথে কাজ করতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কাবুলের প্রশাসন টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন মিলিশিয়া গোষ্ঠির ভাড়াটে যোদ্ধাদের ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। এর ফলে আফগানিস্তানের যুদ্ধবাজ নেতারা সামনে চলে আসার সুযোগ পাচ্ছেন। এসব যোদ্ধাদের ওপর সরকারের নির্ভরতা প্রমাণ করে তারা কত দ্রুত গণতান্ত্রিক বৈধতা হারাচ্ছে। সশস্ত্র মিলিশিয়াদের ওপর সরকারের ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার মাধ্যমে আশরাফ গনির প্রশাসন একটি স্বার্বভৌম রাষ্ট্রের মৌলিক স্তম্ভ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে।

ভাড়াটে গোষ্ঠিগুলোর বিরুদ্ধে সব সময়ই সহিংসতার অভিযোগ রয়েছে। তালেবানের বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ কম নেই। কিন্তু সরকার নিজেই এখন এসব গোষ্ঠির ওপর নির্ভর করছে। রাষ্ট্রের বৈধ জায়গাগুলিতে মিলিশিয়াদের বিচরণ করতে দিয়ে নিজেদের বৈধতাকেই প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এর ফলে তালেবানও কাবুলের প্রশাসনকে পরাজিত করে ক্ষমতা দখল করলে নিজেদের রাষ্ট্রীয় বাহিনী হিসেবে দাবি করতে পারবে। যেটি তারা খুব শীঘ্রই করবে বলে আশাবাদী। ইতোমধ্যেই আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনীর চলে যাওয়াকে তারা দুই দশকের যুদ্ধে পশ্চিমাদের পরাজয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

কাবুল সরকারের এই নীতিতে মূলত আফগানিস্তানের প্রধান প্রধান যুদ্ধবাজ নেতাদের স্বার্থই প্রতিফলিত হচ্ছে। আবদুর রশিদ দোস্তাম, ইসমাইল খান, আতা মোহাম্মাদের মতো নেতারা জনগনের স্বার্থের চেয়েও বেশি চিন্তিত তালেবানের প্রত্যাবর্তন নিয়ে। তাদের সবারই লক্ষ্য ক্ষমতা দখল করা, তবে এই লড়াইয়ে তাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে তালেবানরা।

আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহারের সাম্প্রতিক অগ্রগতিকে বিজয় হিসেবে দেখছে তালেবানরা। তার বলছে এটি আফগানিস্তানের স্থায়ী শাস্তির রাস্তা খুলে দেবে। গোষ্ঠিটি বলেছে, তাদের মুক্ত করা এলাকাগুলোর পরিস্থিতি পুরোপুরি ইসলামিক আমিরাতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। নাগরিকদের জীবনাযাত্রা স্বাভাবিক হয়েছে এবং জনগন বহু বছর পর তাদের কাক্সিক্ষত শান্তি, নিরাপত্তা ও ভরসা পেয়েছে।

কাবুল সরকারের সশস্ত্র মিলিশিয়াদের ওপর নির্ভরতার কথা উল্লেখ করে তালেবানরা বলেছে, এতে প্রমাণ হয় সরকারের কোন বৈধ ভিত্তি নেই এবং এই সরকার গঠিত হয়েছ শুধুমাত্র বিদেশীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। তারা গনি সরকারের এই নীতিকে পুরনো ব্যর্থ কৌশল হিসেবেও আখ্যায়িত করেছে।

তালেবানদের পক্ষ থেকে আরো বলা হয়েছে, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে যে সেনাবাহিনী গঠন করা হয়েছে- তারা আফগান জাতিকে সুরক্ষা দেওয়ার বদলে উল্টো তাদেরই হত্যা করছে এবং বিদেশী প্রভূদের দেশত্যাগের ফলে সেই বাহিনী চূর্ণবিচুর্ণ হয়ে গেছে।

অনেক দিন ধরে কাবুলের সরকারের ক্ষমতা কমে আসছিলো। এরপর ন্যাটো ও মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের ফলে এর গতি আরো বাড়বে। তালেবানরা তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো থেকে বাইরে বের হয়ে আরো নুতন নতুন এলাকা দখলে নিতে উৎসাহ পাবে। ইতোমধ্যেই তারা ৫০টির বেশি জেলা দখলে নিয়েছে। যদিও তালেবানের দাবি একশোর বেশি জেলা তাদের দখলে। তাজিকিস্তানের সাথে প্রধান সীমান্ত ক্রসিংটিও এখন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পুরো আফগানিস্তানের অর্ধেকের বেশি গ্রাম এলাকা এখন তালেবানের দখলে। কিছু শহরও আছে তাদের নিয়ন্ত্রণে।

অনেকেই এখন কাবুল সরকারের শেষের শুরু হয়ে গেছে বলে মনে করছেন। সাম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এক গোয়েন্দা মূল্যায়নেও বলা হয়েছে, মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের ছয় মাসের মধ্যে কাবুল সরকারের পতন হতে পারে। একই সময়ে তালেবান নিজেদের কাবুল সরকারের চেয়ে শক্তিশালী. দেশ পরিচায়নায় দক্ষ ও বৈধ কর্তৃপক্ষ হিসেবে প্রচার করছে এবং কাবুলের সরকারকে তারা পুতুল সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করছে।

তালেবানের একটি কৌশল তাদের দ্রুত বিভিন্ন এলাকার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সহযোগিতা করেছে। তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি জাতিগত বৈচিত্রপূর্ণ সশস্ত্র গোষ্ঠিতে পরিণত হয়েছে। ২০১৬ সালের পর থেকে তালেবান তাদের দলে ভিড়িয়েছে আফগানিস্তানের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির লোককে। বিভিন্ন জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠির যোদ্ধার উপস্থিতিই তালেবানকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে দ্রুত একের পর এক এলাকা দখলে নিতে সহযোগিতা করেছে।

এখনো সংখ্যালঘুরা তালেবানের মধ্যে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদে না থাকলেও তাদের যোগদান ও সমর্থন তালেবানকে সহযোগিতা করেছে বিভিন্ন এলাকা দখলে নিতে। আর যার ফলে ত্বরান্বিত হয়েছে কাবুল সরকারের সামরিক ও রাজনৈতিক পতন।

মার্কিন সেনাদের চলে যাওয়ার পর আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানকে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সাথে তুলনা করলে ভুল হবে। কারণ সিরিয়ায় এমন একটি সরকার আছে যারা রাশিয়া ও ইরানের সহযোগিতা নিয়ে বিদ্রোহীদের পরাজিত করতে পেরেছে। কিন্তু আফগানিস্তানে সেটি সম্ভব নয়। যে কারণে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি আরো বেশি রক্তাক্ত হয়ে উঠতে পারে। আবার তালেবানেরও কোন শক্তিশালী বিদেশী বন্ধু নেই। কাজেই এই সুযোগে আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার করতে উঠে পড়ে লাগবে প্রতিবেশী দেশগুলো।

পাকিস্তান, চীন, রাশিয়া, ইরানের মতো দেশগুলো ইতোমধ্যেই তালেবানের সাথে ভবিষ্যত সম্পর্কের আভাস দিয়ে রেখেছে। এদের মধ্যে আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতার সাথে সবচেয়ে বেশি জড়িত ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক। যে কারণে আফগাস্তিানে গৃহযুদ্ধ লাগলে সেটি পাক-ভারত প্রক্সি যুদ্ধে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ভারত ঐতিহাসিকভাবে তালেবানের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করেনি। আফগানিস্তান তালেবানের নিয়ন্ত্রণে যাক সেটিও তারা চাইবে না। যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই ভারত বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। তার ভয় পাচ্ছে আফগানিস্তান থেকে ভারতের মাটিতে সশস্ত্র কর্মকান্ড বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে কাশ্মীরে।

আফগান তালেবান এখন এতটাই সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে যে, ভারতের করার খুব বেশি কিছু থাকবে না হয়তো। পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে নয়া দিল্লি হয়তো বাধ্য হয়েই তালেবানের সাথে সংলাপ শুরু করতে পারে। গত বছর আন্তঃআফগান সংলাপে অংশ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছিলেন, তার দেশ চায় আফগানদের নিয়ন্ত্রণে ও তাদের নেতৃত্বেই আফগানিস্তান চলুক। যদিও তালেবান প্রসঙ্গে তিনি কিছু বলেননি।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রও চাইবে তালেবান ক্ষমতায় এলে ভারত তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করুক। এতে আখেরে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থই রক্ষা হবে। গত বছর আফগানিস্তান বিষয়ক মার্কিন বিশেষ দূত জালমি খলিলজাদ ভারতকে আহ্বান জানিয়েছেন তালেবানের সাথে কথা বলে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানাতে। কাতারে তালেবানদের সাথে সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি গোপন বৈঠক হয়েছে বলে বিভিন্ন গনমাধ্যমে খবর এসেছে।

পাকিস্তানের দিক থেকে বিষয়টি এখন অন্যরকম। প্রধানমন্ত্রী ইমারান খান ইতোমধ্যেই বলেছেন, আফগানিস্তানে একটি টেকসই শান্তি চুক্তি না হলে গৃহযুদ্ধ লেগে যেতে পারে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে আফগানিস্তান ত্যাগ করার আগে দেশটিতে একটি রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজতে বলেছিলেন। কারণ আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে পাকিস্তানের ওপর। দুই দেশের মধ্যে বিশাল পার্বত্য সীমান্ত থাকায় সহজেই আফগান সশস্ত্র গোষ্ঠিগুলো পাকিস্তানের মাটিতে প্রবেশ করতে পারে।

তবে পাকিস্তান একটি জায়গায় এগিয়ে রয়েছে, তা হলে তালেবানের সাথে তাদের পুরনো সম্পর্ক। এটি এক দিকে যেমন নিজেদের মাটিতে সন্ত্রাসবাদ বিস্তার রোধে সহায়ক হবে অন্য দিকে ভারতকে আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তারে বাধা দেবে। তবে পাকিস্তান সবচেয়ে বেশি চাইবে আফগানিস্তানে শান্তি আসুক।

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক উইলসন সেন্টারের বিশ্লেষক মিখায়েল কুগেলম্যান মনে করেন, পাকিস্তান সবার আগে নজর রাখবে আফগান শান্তি প্রক্রিয়ার দিকে।শান্তি প্রক্রিয়া চালু থাকলে পাকিস্তান তাতে সমর্থন করবে, কারণ আফগানিস্তানে অশান্তি থাকলে তা পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।