চীনকে মোকাবেলায় অসহায় হয়ে পড়ছে ভারত


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৪ জুলাই ২০২১, ১৩:১৭

ভারত চেয়েছিল চীনকে টেক্কা দিতে কিংবা নিদেনপক্ষে বেইজিংয়ের সমকক্ষ হতে। কিন্তু নয়াদিল্লি দেখতে পাচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রও এখন চীনকে মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। এ-জন্য জি-সেভেনভুক্ত দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে চীনকে সামলাতে চাচ্ছে ওয়াশিংটন। এ পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে ক্ষয়িষ্ণুশক্তি ভারত চীনের মোকাবিলায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।

জি-সেভেনের সদস্য নয় চীন। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত এ জোটের শীর্ষ সম্মেলনে আলোচ্য বিষয় ছিল মূলত চীনের উত্থান ঠেকানোর পরিকল্পনা। চীনকে মোকাবিলায় জি-সেভেন সদস্যরা নানা পরিকল্পনা তুলে ধরেছেন। তবে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরাই মনে করেন, চীনের উত্থান আসলে ঠেকাতে সক্ষম হবে না বিশে^র সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই জোট।

এ পরিস্থিতিতে সবার নজর কেড়েছে ভারতের নীরবতা। চীনকে দমনের পশ্চিমা কৌশল নিয়ে ভারত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। ভারত বুঝতে পেরেছে যে চীনকে মোকাবিলার স্বপ্ন এখন তার জন্য বিলাসী কল্পনা ছাড়া কিছু নয়।

অভ্যন্তরীণ নানা সংকটে পর্যুদস্ত ভারত তাই এখন আর চীনকে ক্ষ্যাপাতে চাইছে না। কিছুদিন আগেও লাদাখ নিয়ে ভারত যুদ্ধংদেহী মনোভাব দেখালেও এখন তলে তলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য অনেক বেড়েছে। অথচ চীনা পণ্য বর্জনের জন্য ভারতের বিজেপি নেতারা ব্যাপক শোরগোল তুলেছিলেন।

ভারতের জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে করোনা মহামারি। এতে অর্থনৈতিকভাবে ভারত লণ্ডভণ্ড হয়েছে। ভারতের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিকভাবে তলানিতে ঠেকেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সর্বনাশটা হয়েছে কূটনৈতিক পর্যায়ে। ভারত প্রতিবেশী দেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশকে টিকা দেওয়ার চুক্তি করলেও একতরফাভাবে সেখান থেকে পিঠটান দেয়। হঠাৎ টিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় এসব দেশগুলোর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তাদের মহামারি মোকাবিলার প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়।

এতে ভারতের অঙ্গীকারের প্রতি আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে ভারত নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছু বোঝে না। ফলে ভারতের ওপর এখন আর কেউ নির্ভর করতে পারছে না। টিকার এই সংকট নিরসনের এগিয়ে এসেছে চীন।

চীনের অর্থনৈতিক শক্তির কাছেও ভারত ম্লান হয়ে যাচ্ছে। যেমন ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশ মালদ্বীপের বিদেশি ঋণের প্রায় ৭৮ ভাগই দিয়েছে চীন। এর মোট পরিমাণ ১৪০ কোটি ডলার। অথচ মালদ্বীপে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে ভারত। মন্টেনিগ্রো চীনের কাছ থেকে ৮০ কোটি ডলার ধার নিয়ে একটি মহাসড়ক তৈরি করেছে। এর জামানত হিসেবে জমি বন্ধক রেখেছে মন্টেনিগ্রো সরকার। কোনো কারণে তারা ঋন পরিশোধে অক্ষম হলে চীণ সরকার সেই জমির মালিকানা পাবে। আর এর মাধ্যমে সরাসরি ইউরোপে প্রবেশের পথ পেয়ে যাবে চীন।

প্রেসিডেন্ট জিনপিং তার দেশের কর্মকর্তাদের বলেছেন, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক উন্নত করতে হবে।

চীন তার সামরিক বাহিনীর আধুনিককায় করছে দ্রুত গতিতে। চীনের গণফৌজ বা পিপলস লিবারেশন আর্মির প্রধান হিসেবে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দেশটির সামরিক বাহিনীকে বিশে^র বৃহত্তম বাহিনীতে পরিণত করেছেন। সামরিক শক্তিতে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে গেছে বলে সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

চীন সামরিক খাতে যুক্তরাষ্ট্রের পরই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে। বছরে চীনের সামরিক ব্যয় ২০ হাজার কোটি ডলারের বেশি। চীনের গণফৌজ প্রতিষ্ঠার শতবার্ষিকী ২০২৭ সালের মধ্যে একে পরিপূর্ণ আধুনিক বাহিনীতে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছেন জিনপিং। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উদ্ভাবনে চীন বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে চলেছে।

চীন ব্যালেস্টিক মিসাইল, সাইবার ও ইলেকট্রনিক যুদ্ধের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে। চীনের বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী এখন অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত।

ভারতের বড় মাথাব্যথার কারণ চীনের প্রেসিডেন্টের একটি ঘোষণা । তিনি বলেছেন, কোনো বিদেশি বৈরি শক্তির কাছে ভূখণ্ড হারাবে না চীন। জিনপিংয়ের এ ঘোষণায় লাদাখ, সিকিম, অরুণাচল, হিমাচল ও উত্তর প্রদেশ নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন। এখানে চীনের সঙ্গে ভারতের লড়াইটা যে জারি থাকবে তা এখন স্পষ্ট।

সীমান্ত নিয়ে এক সময় যুদ্ধ হলেও ভারত মনে করেছিল চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হবে। কিন্তু ভারত এখন ভুল বুঝতে পারছে। হিন্দি চিনি ভাই ভাই মন্ত্র থেকে সরে গিয়েছে চীন। চীনের হ্যাকাররা ভারতীয় মিশনগুলোতে সাইবার হামলা চালাচ্ছে।

২০১০ সালে টরন্টো ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, সাইবার হামলা চালিয়ে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার গোপনীয় তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে চীনা হ্যাকাররা। পশ্চিম আফ্রিকা, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান ও ন্যাটো নিয়ে ভারতের নীতির দলিলও হস্তগত করেছে চীনা হ্যাকাররা।

এক সময় মনে করা হতো চীনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারতেরও উত্থান হবে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির শাসনের সাম্প্রতিক নজিরবিহীন ব্যর্থতা সেই স্বপ্ন ধূলিষ্যাৎ করে দিয়েছে। মোদি এটা বুঝতে পেরেই সুর নমনীয় করেছেন। তাই জিনপিংয়ের সঙ্গে ভারতের সবরমতিতে এক বৈঠকে তিনি লাদাখ থেকে সেনা প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন।

জিনপিংকে মোদি বলেন, আপনার দেশের কাছ থেকে এটা আশা করি না। আপনি কি আমাকে বলতে পারেন কবে সেনা সরিয়ে নিচ্ছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জিনপিং এ প্রশ্নে ইতিবাচক উত্তর না দিয়ে বলেন, বিষয়টি বেশ জটিল। আমাদের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং এর জবাব দিতে পারবেন।

২০১৪ সালে ভারতের সবরমতিতে মোদি আর জিনপিং যখন চা পানে ব্যস্ত তখন লাদাখে অনুপ্রবেশ করে এক হাজার চীনা সেনা। এরপর আবার ডোকলামে চীনা সেনারা অনুপ্রবেশ করলে মোদি ছিলেন নির্বিকার। বিশ্লেষকরা বলছেন, মোদিকে বশ্যতা স্বীকার করাতে চান জিনপিং। চীন চায় ভারত যেন অসহায়বোধ করে।

ভূরাজনীতিতেও ভারতকে কোণঠাসা করে ফেলেছে চীন। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা ছাড়াও চীন প্রযুক্তিগত দিকে থেকে সাহায্য দিচ্ছে। এক্ষেত্রে চীনের সামনে ভারত খুবই দুর্বল।

ভারতের এই যখন অবস্থা তখন চীন বিশে^ আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাচ্ছে। করোনা সংকটে সীমাহীন ব্যর্থতার কারণ মোদি আগামী নির্বাচনে জয়ী হতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। কিন্তু জিনপিং নিজ দেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বিশে^ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তার প্রচেষ্টাকে জনগণ অকুণ্ঠ সমর্থন দিচ্ছে। অন্যদিকে জিনপিং তার দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের নির্জিব করে নিজের ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করেছেন। ফলে তিনি চীনকে যেভাবে বিশে^ একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথে নিতে চাচ্ছেন তাতে অভ্যন্তরীণভাবে তাকে কোনো বাধা মোকাবিলা করতে হবে না।

বৈশি^ক পরিমণ্ডলে জিনপিং এশিয়া, রাশিয়া, ইউরোপ, দক্ষিণ প্রশান্ত ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে শক্তিবৃদ্ধি করে চলেছেন। চীনের বিনিয়োগের ওপর এসব অঞ্চলের দেশগুলো এখন ভীষণ রকমের নির্ভরশীল। এ অবস্থায় পশ্চিমা থিঙ্কট্যাঙ্কই বলছে যে চলতি দশকের শেষ নাগাদই চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে বিশে^র বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে।

চীনকে এখনই বশে আনতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তিগুলো। যেমন হংকংয়ের স্বায়ত্বশান চীন কেড়ে নিলেও পশ্চিমা শক্তি কার্যত তেমন কিছুই করতে পারেনি। চীন এখন শক্তিমত্তা দেখাতে চাচ্ছে তাইওয়ানে। এমনকি তাইওয়ান নিয়ে চীন যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়তে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

তবে এতোসব ঘটনার ডামাডোলে পেছনে পড়ে আছে ভারত। লাদাখে বারবার চীনা অনুপ্রবেশ সত্ত্বেও পশ্চিমা বিশ^ ভারতের পাশে দাড়াচ্ছে না। ফলে ভারত অসহায় বোধ করছে।

ফলে এবারের জি-সেভেন শীর্ষ সম্মেলনে চীনকে মোকাবিলার জন্য জোট নেতারা নানা কৌশল ঘোষণা করলেও ভারতকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। অন্যদিকে ভারত চীনের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য কমানোর নানা পদক্ষেপ নিলেও তা কাজে আসেনি। ভারতে চীনের রফতানি বেড়েছে।

প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রকে হটিয়ে ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়েছে ভারত। সামনের দিনগুলোতে চীনের উত্থানের বিপরীতে ভারত আরও দুর্বল হয়ে পড়বে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।