এরদোয়ানের হাত দিয়ে সুলতান সুলেমানের স্বপ্নপূরণ


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০৪ জুলাই ২০২১, ১৩:০৪

বহুল আলোচিত ইস্তাম্বুল ক্যানেল বা ইস্তাম্বুলের খাল খননকাজ শুরু করেছে তুরস্ক। ইস্তাম্বুল নগরীরর বুক চিরে বসফরাসের মতোই এটি যুক্ত করবে ভূমধ্যসাগর ও কৃষ্ণসাগরকে। ওসমানীয় সম্রাজ্যের সুলতান সুলেমানের স্বপ্নের সেই খালের নির্মাণকাজ শুরু করেছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। খালটি বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে। যে কারণে এর বিরোধিতাও শুরু হয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে। তবে তুরস্কের সরকার অনড়।

২০২১ সালের ২৬ জুন একটি ব্রিজের নির্মাণকাজ শুরু করার মাধ্যমে বিশাল এই প্রকল্পের উদ্বোধন করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। মোট ছয়টি ব্রিজ থাকবে ইস্তাম্বুল ক্যানেলের ওপর। যোগাযোগ ব্যবস্থা যাতে বিঘ্নিত না হয় সেজন্য ব্রিজগুলো আগে বানানো হবে, তারপর নিচ দিয়ে কাটা হবে খাল। তুরস্কের প্রাচীন নগরী ইস্তাম্বুলের ওপর দিয়ে যাবে এই খালটি। ইস্তাম্বুলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বসফরাস প্রণালীর সমান্তরাল হবে এই খালটি। বসফরাসের মতোই এটি যুক্ত করবে কৃষ্ণসাগরের সাথে মারমারা সাগরকে। মারমারা সাগর থেকেই বের হওয়া যায় আজিয়ান সাগর ও ভূমধ্যসাগরে।

বসফরাস প্রণালী ইস্তাম্বুলকে দুই ভাগে ভাগ করেছে। এর পশ্চিম পাশ ইউরোপ মহাদেশে আর পূর্ব পাশ পড়ছে এশিয়া মহাদেশে। নতুন এই খালটির অবস্থান হবে ইস্তাম্বুলের ইউরোপীয় অংশে। বসফরাসের পশ্চিম দিক দিয়ে এটি বয়ে চলে যাবে কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত। সুয়েজ খাল ও পানাম খালের পর এটি হবে আরেকটি মানবসৃষ্ট আন্তর্জাতিক নৌপথ। এর দৈর্ঘ হবে ৪৫ কিলোমিটার বা ২৮ মাইল। চওড়া হবে ৭৫ মিটার আর গভীরতা হবে ২০ দশমিক ৭৫ মিটার। চওড়া ও গভীরতা- দু’দিক থেকেই এটি সুয়েজ ও পানামা খালের চেয়ে বেশি হবে। ইস্তাম্বুল ক্যানেল দিয়ে চলতে পারবে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৪৮ ফুট লম্বা নৌযান।

ইস্তাম্বুল নগরীরর বাইরে কৃষি জমি ও বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে খালের রুট নির্ধারণ করা হয়েছে। যার ফলে বসতবাড়ি বা কল কারখানার বড় কোন ক্ষতি হবে না। উল্টো এর দুই পাড়ে নতুন আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে তুর্কি সরকার। ৫টি বিকল্প রুটের মধ্য থেকে সবচেয়ে সুবিধাজনকটি বেছে নেয়া হয়েছে খালের জন্য। খাল, ব্রিজ ছাড়াও এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে কৃষ্ণসাগরের প্রবেশ মুখে একটি কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, খালের খননকৃত মাটি দিয়ে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি ও লজিস্টিক সেন্টার নির্মাণ। বিশাল এই প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পুরো প্রকল্পে কাজ করবে ৮ থেকে ১০ হাজার লোক, আর খনন কাজ শেষে নৌ রুটের পরিচালনায় কাজ করবে ৫শ থেকে ৮শ জনবল। আগামী ছয় বছরের মধ্যে বিশাল এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করছেন তুরস্কের ইঞ্জিনিয়াররা।

ইস্তাম্বুল ক্যানেল শুধু একটি খাল নয়, তুরস্কের শাসকদের বহুদিনের স্বপ্ন এই ইস্তাম্বুল ক্যানেল। বহু শতাব্দী ধরেই ইস্তাম্বুলের নীতি নির্ধারকরা মারমারা ও কৃষ্ণসাগরকে সংযুক্তকারী দ্বিতীয় নৌরুটের কথা ভেবে আসছেন। সাবেক শাসকদের সেই স্বপ্নই এবার পূরণ হচ্ছে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের হাত দিয়ে।

বসফরাসের বিকল্প হিসেবে একটি নৌ রুটের প্রস্তাব প্রথম দিয়েছিলেন ওসমানীয় সম্রাজ্যের দাপুটে সুলতান সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট। ১৫২০ থেকে ১৫৬৬ সাল পর্যন্ত সুলতান সুলেমানের শাসনামলে এই খালের পরিকল্পনা নেয়া হলেও বাস্তবায়ন শুরু হয়নি অজানা কারণে।

পরবর্তীতে আরো কয়েকজন সুলতানের সময়ে এই খাল খননের পরিকল্পনা নেয়া হলেও কখনো আর্থিক কারণে, কখনো আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে তার বাস্তবায়ন হয়নি। আধুনিক তুরস্কেও বেশ কয়েকবার খালটি নিয়ে প্রস্তাব উঠেছে। সর্বেশেষ ১৯৯৪ সালে প্রস্তাবটি নতুন করে আবারো উঠলে, সেটি বিবেচনায় রেখে গবেষণা শুরু হয়। ২০১১ সালে এরদোয়ান এক নির্বাচনী সমাবেশে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিলেন। অবশেষে যা শুরু হলো।

তুরস্ক বলছে, ইস্তাম্বুল ক্যানেল খননের প্রধান উদ্দেশ্য বসফরাস প্রণালীর ওপর থেকে চাপ কমানো। বসফরাস প্রণালী দিয়ে আন্তর্জাতিক নৌ রুটের জাহাজ চলাচল আগের চেয়ে অনেকগুণ বেড়েছে। আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বাণিজ্য ক্রমশই বাড়ছে, কাজেই এই চাপ আরো বাড়তে প্রতিনিয়ত। বসফরার দিয়ে প্রতি বছর গড়ে ৪৮ হাজার নৌযান চলাচল করে। যা সুয়েজ খাল ও পানামা খালের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। ২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ৭৮ হাজারে পৌছবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অন্য এক হিসেবে দেখা গেছে, ২০০৬ সালে বরসফরাস দিয়ে ২০০ মিটারের চেয়ে বড় নৌযান চলাচল করেছে ৩ হাজার ৬৫৩টি। ২০১৮ সালে যা বেড়ে দাড়িয়েছে ৪ হাজার ১০৬টিতে। ছোট ও মাঝারি নৌ যানের সংখ্যাও বেড়েছে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে। যে কারণে ইস্তাম্বুল নগরীর দুই পাশের জনজীবন ও বিভিন্ন স্থাপনার ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বসফরানের তীর ঘেঁষেই ব্লু মস্ক, আয়া সোফিয়ার মতো ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো রয়েছে। অতিরিক্ত যান চলাচলে বসফরাসের জীববৈচিত্রেও ক্ষতি হচ্ছে।

বসফরাস প্রণালী দিয়ে চলাচলের জন্য প্রতিদিন জাহাজের লম্বা লাইন হয়। সরু হওয়ার কারণে একটির পেছনে আরেকটি জাহাজকে ঢুকতে হয় এই প্রণালীতে। এতে অনেক সময় জাহাজকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় বসফরাসে ঢুকতে। নতুন আরেকটি রুট চালু হলে এই ভীড় কমবে। এছাড়া বসফরাসের নৌ পথ অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এই প্রণালীতে রয়েছে ১৯টি বিপজ্জনক বাক, যার কোন কোনটি ৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত। যে কারণে গত চার বছরে ছোট-বড় ৬৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব বিষয় মাথায় রেখে ইস্তাম্বুল ক্যানেলের নকশা করা হয়েছে। সেখানে ১০ ডিগ্রির বেশি কোন বাক থাকবে না।

তুরস্কের সরকারের তথ্য মতে, ইস্তাম্বুল ক্যানেল চালু হলে দেশটির রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে অনেকগুণ। বসফরাস প্রণালী তুরস্কের স্বার্বভৌমত্বের অংশ হলেও ১৯৩৬ সালে চাপিয়ে দেয়া এক চুক্তিতে তুরস্ককে এই নৌপথের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের মন্ট্রাক্স শহরে সম্পাদিত পশ্চিমা দেশগুলোর নেতৃত্বে মন্ট্রাক্স কনভেনশনে বলা হয়, তুরস্ক বসফরাস প্রণালী দিয়ে চলাচালকারী কোন বেসামরিক নৌযান থেকে কর আদায় করতে পারবে না।

কৃষ্ণসাগর উপকূলের দেশ বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, মলদোভা, ইউক্রেন, রাশিয়াকে ভূমধ্যসাগরে বের হতে হয় বসফরাস প্রণালী দিয়ে। এসব দেশের নৌপথের বাণিজ্য পুরোপুরি এই রুটের ওপর নির্ভরশীল। যে কারণে তুরস্ক আশা করছে, ইস্তাম্বুল ক্যানেল চালু হলে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হবে।

তবে এসবের বাইরে এই খালের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়েই বেশি আলোচনায় এসেছে প্রকল্পটি। কারণ ১৯৩৬ সালে মন্ট্রাক্স কনভেনশনে তুরস্কের ওপর আরো কিছু বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। যার মধ্যে রয়েছে বসফরাস প্রণালীতে সামরিক জাহাজের ওপর বিধিনিষেধ। এই প্রণালী দিয়ে নির্দিষ্ট ওজনের চেয়ে বড় সামরিক জাহাজ চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যে কারণে তুরস্ক চাইলেই তার যুদ্ধজাহাজ মারমারা কিংবা আজিয়ান সাগর থেকে কৃষ্ণসাগরে নিতে পারে না।

আবার কৃষ্ণসাগর থেকেও চাইলে বড় কোন যুদ্ধজাহাজ যান অন্য পাশে নিতে পারে না। ছোট সামরিক জাহাজ চলাচলেও এর সংখ্যা এবং জাহাজটিতে কী অস্ত্র থাকবে সেগুলো নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। তাই ইস্তানবুল ক্যানেল চলাচলের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলে এই বাধা কেটে যাবে এবং তুরস্ক তার সামরিক নৌযানগুলোকে নিজেদের সুবিধামতো চলাচল করাতে পারবে।

ইস্তাম্বুল ক্যানেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সকলের উদ্দেশ্যে বলেছেন, এটি নিয়ে ভাবার কোন কারণ নেই। মন্ট্রাক্স শুধু বসফরাস প্রণালীতেই সীমাবদ্ধ। ইস্তাম্বুল ক্যানেল পুরোপুরি ওই চুক্তির বাইরে। অর্থাৎ বসফরাসের বিধিনিষেধ এড়াতে তুরস্ক নতুন জলপথ তৈরি করে নিচ্ছে- এমনটা ভাবলেও ভুল হবে না।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুরস্কের উত্থান লক্ষ্য করলে বিষয়টি নিয়ে দুই দুইয়ে চার মেলানো সহজ হয়। আর এর কারণেই ইস্তাম্বুল ক্যানেল নিয়ে বিরোধীতা করছে অনেক দেশ। বিশেষ করে কৃষ্ণসাগর পারের দেশগুলো ওই অঞ্চলে আঙ্কারার প্রভাববৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কায় আছে। সরাসরি কেউ এ বিষয়ে আপত্তি না তুললেও পরোক্ষভাবে বলা শুরু হয়েছে।

পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো নতুন খাল খননের ফলে ইস্তাম্বুলের কি ক্ষতি হবে সেটি নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করতে শুরু করেছে। রাশিয়া আশঙ্কা করছে, নতুন খাল দিয়ে ন্যাটোর যুদ্ধজাহাজ অবাধে কৃষ্ণসাগরে যাতায়াত করবে, যেটি ওই অঞ্চলে মস্কোর আধিপত্যে ভাগ বসাবে।

তুরস্কের ভেতরেও অনেকে এর সমালোচনা করছে। কয়েকটি বিরোধী দল খরচের অজুহাতে এই প্রকল্পের বিরোধীতা করছে। ইস্তাম্বুলের মেয়র ওর বিরোধী দলীয় নেতা একরাম ইমামগলুও এই খাল খননের বিরোধী। সাবেক কিছু নেভি অফিসার বিষয়টি নিয়ে তৎপর হওয়ায় বেসামরিক রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অভিযোগে তাদের গ্রেফতারও করা হয়েছে।

এসব কারণে ইস্তাম্বুল ক্যানেল নিয়ে কিছুটা হলেও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তুরস্কের সরকার। তবে সেসবকে পাত্তা না দিয়ে তারা প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যাকে বলেছেন, তুরস্কের উন্নয়নের নতুন অধ্যায়ের সূচনা।