আফগানিস্তান থেকে শিগগিরই চলে যাচ্ছেন মার্কিন এবং ন্যাটো সেনারা। তবে বিদেশি মিশন ও কূটনীতিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব তুর্কি সেনাদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার আলোচনা চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই। সর্বশেষ তথ্য বলছে, বিষয়টি নিয়ে একটি কৌশলগত চুক্তির কাছাকাছি রয়েছে তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে বিমানবন্দরের বাইরে নিরাপত্তা দেওয়া সংক্রান্ত ছোট্ট একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। বিষয়টির সঙ্গে সম্পর্কিত- এমন দুটি সূত্রের বরাত দিয়ে এই তথ্য জানিয়েছে মিডেল ইস্ট আই।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের একটি কৌশলগত প্রতিনিধিদল গত সপ্তাহে আঙ্কারা সফর করেছে। সফরে তুরস্কের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং গোয়েন্দাদের সঙ্গে কাবুলে তুর্কি বাহিনীর অবস্থানের বিষয়ে একটি খসড়া কাঠামো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিদেশি মিশন, ত্রাণ সংস্থা, এমনকি খোদ আফগান সরকারের জন্য কাবুল বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
জুন মাসের প্রথমদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান মৌখিকভাবে একমত হন যে, আফগানিস্তান থেকে ন্যাটোর সিংহভাগ সেনা চলে যাওয়ার পর কাবুল বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণভার নেবে তুর্কি বাহিনী। তবে ওই সময় তুর্কি প্রেসিডেন্ট অর্থনৈতিক ও লজিস্টিক্যাল এবং অংশীদার দেশগুলোর সহায়তার প্রসঙ্গ তুলেছেন। জুলাইয়ের মাঝামাঝি নাগাদ দেশটি থেকে ন্যাটো সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
২০১৩ সাল থেকেই কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা দিয়ে আসছে তুরস্কের সামরিক বাহিনী। তবে এক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, হাঙ্গেরি, ফ্রান্স ও ন্যাটোর অন্য সদস্য দেশগুলো।
মিডেল ইস্ট আই বলছে, কাবুল বিমানবন্দর আফগান সরকারের জন্য লাইফলাইন। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে তালেবানরা বেশ কিছু জেলার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় ব্যাপক ঝুঁকিতে রয়েছে বিমানবন্দরটি। মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো সেনারা চলে যাওয়ার ৬ মাসের মধ্যে দেশটির সরকার ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।
স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ সম্পর্কে অবহিত দুটি সূত্র জানিয়েছেন, পারস্পারিক বোঝাপড়ায় কয়েকটি বিষয়ে একমত হয়েছে তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র। সেগুলো হলো-
# তুর্কি বাহিনীকে সামরিক ও গোয়েন্দা সহযোগিতা দেবে যুক্তরাষ্ট্র।
# এ কার্যক্রম পরিচালনার ব্যয়ভার বহন করবে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো।
# প্রয়োজন হলে তুরস্ক অতিরিক্ত সামরিক সহযোগিতা চাইতে পারবে।
# বিমানবন্দরের বাইরে কোনো যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করবে না তুর্কি বাহিনী।
# তুরস্ক চাইলে অন্য কোনো বিদেশি অংশীদারকে সঙ্গে নিতে পারবে এবং আঙ্কারাকে স্থানীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগের অনুমতি দিতে হবে।
জুন মাসের শুরুর দিকে তুরস্কের শর্ত মেনে কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় অর্থব্যয়ের প্রতিশ্রুতি দেয় ন্যাটো। তবে তুরস্কের পক্ষ থেকে ড্রোন, আত্মরক্ষামূলক সরঞ্জাম ও অন্য মিত্র দেশগুলোর সেনাদেরও মোতায়েনের দাবি করা হয়েছে।
সূত্র বলছে, তালেবানের মর্টার ও রকেট হামলা মোকাবেলায় তুর্কি বাহিনীর যাতে কোনো ঘাটতি না থাকে, সেজন্য ওয়াশিংটন কাউন্টার রকেট, আর্টিলারি এবং সি র্যা ম মর্টার সিস্টেম কাবুলে রাখার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। এছাড়া কাবুল বিমানবন্দরে অপারেটিং সিস্টেম ও হেলিকপ্টার সাপোর্টের জন্য এয়ার ক্রু হিসেবে কিছু মার্কিন সেনা রাখার কথাও জানিয়েছে পেন্টাগন।
তবে একটি ক্ষেত্রে এখনো তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতানৈক্য এখনো রয়েছে। সেটি হলো- বিমানবন্দর থেকে বিদেশি মিশন পর্যন্ত কূটনৈতিক বহরের নিরাপত্তা দেওয়া। তুরস্ক একাকি এই ধরনের নিরাপত্তা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য দেশগুলো যদি এক্ষেত্রে তুরস্ককে সাপোর্ট দেয়, তাহলে আঙ্কারার কোনো সমস্যা নেই।
মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বিমানবন্দর ও মার্কিন কূটনৈতিকদের নিরাপত্তার জন্য সাড়ে ৬০০-এর মতো সেনা কাবুলে রাখতে পারে ওয়াশিংটন।
মনে করা হচ্ছে, তুরস্কের ৫০০ সেনা ও ২০০ টেকনিক্যাল পার্সোনেল আফগানিস্তানে অবস্থান করবে। তুর্কি সরকারের ধারণা, এই কূটনৈতিক মিশনে অংশগ্রহণ এবং কূটনৈতিক বহরের নিরাপত্তায় এই সেনা সংখ্যাই যথেষ্ট। গত সপ্তাহে এক টেলিভিশন ভাষণে তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকর বলেছেন, এই মুহূর্তে আফগানিস্তানে অতিরিক্ত তুর্কি সেনা পাঠানোর প্রয়োজন নেই।
সূত্র বলছে, সাধারণ শান্তি ও কাবুলের নিরাপত্তা রক্ষার ক্ষেত্রে নিজেদের অবদান রাখতে আঙ্কারা চায় আফগান সরকারের সঙ্গে কাজ করতে। আর এজন্য তুর্কি সরকার আফগানিস্তানের স্থানীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ করতে আগ্রহী। এ ব্যাপারে তুরস্কের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আলোচনা যা হয়েছে সেটা সাধারণভাবে ইতিবাচক। তবে এই ইস্যুতে আমাদের আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
সেই অটোমান শাসনামল থেকেই তুরস্কের সঙ্গে আফগানিস্তানের সুসম্পর্ক রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যখন কাবুলে তুর্কি সেনাদের অবস্থানের প্রসঙ্গটি উঠানো হয়, তখন থেকেই এর ঘোর বিরোধিতা করে আসছে তালেবানরা। তুরস্ক এত বড় ভুল করবে না বলেও সর্তক করেছে তারা। অবশ্য এটাও ঠিক যে, ২০০১ সালে ন্যাটো যখন আফগানিস্তানে আগ্রাসন শুরু করে তখন থেকেই তুর্কি সেনাদের হামলার টার্গেটে পরিণত করার বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই এড়িয়ে গেছে তালেবান।
এখানে উল্লেখ যে, রাশিয়ার অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এস-৪০০ কেনা নিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্কে যে টানাপোড়েন চলছে, সেটাকে ঝালিয়ে নিতে আফগান ইস্যুকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে চায় তুরস্ক। ওয়াশিংটনের একটি সূত্র সম্পতি মিডেল ইস্ট আইকে বলেছেন, তুর্কি প্রেসিডেন্ট আশাবাদী যে, কাবুল মিশনের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা পাবেন তিনি।
ওয়াশিংটনের ওই সূত্রটি আরো বলছে, এটা সত্য যে, আফগানিস্তানের সঙ্গে তুরস্কের ঐতিহাসিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সবসময়ই ছিল। এই ক্ষেত্রেও অর্থাৎ এস-৪০০ ইস্যুসহ কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব পেতে ওয়াশিংটনের শক্ত স্বীকৃতি চায় আঙ্কারা।
এর আগে জুন মাসের শুরুর দিকে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, পাকিস্তান ও হাঙ্গেরির সেনাদের নিয়ে কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা দিতে পারে তুরস্ক। অনেকেই মনে করছেন, এক্ষেত্রে পাকিস্তান একটি যুক্তিসঙ্গত অংশীদার। তাছাড়া প্রতিবেশী দেশ হিসেবে তালেবানের সঙ্গেও ইসলামাবাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু হাঙ্গেরির প্রসঙ্গটা কেন এখানে আসছে, সেটাই বড় আশ্চর্যের বিষয়।
বিষয়টি সম্পর্কে অবগত এমন দুটি সূত্র বলছে, হাঙ্গেরির পক্ষ থেকেই এই মিশনে অংশ নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। সম্প্রতি ন্যাটো সম্মেলনের অবকাশে এরদোয়ান ও হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের বৈঠকেই ধারণাটি উঠে আসে।
যাই হোক, তুরস্কের ওই কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সম্ভাব্য অংশীদার হওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক এখনো কাজ করছে। এখনো এই ইস্যুতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।