আফ্রিকা থেকে বিতাড়িত হচ্ছে ফ্রান্স


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০১ জুলাই ২০২১, ১৩:৪৭

আফ্রিকা থেকে ক্রমেই বিতাড়িত হচ্ছে মহাদেশটির সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স। আফ্রিকার দেশগুলোর সম্পদ লুণ্ঠন, রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপ এবং মানবতাবিরোধী নানা কর্মকাণ্ডের কারণে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটছে। এখন এই অঞ্চলে পশ্চিমা মিত্রদের সহায়তায় একটি বহুজাতিক বাহিনী গঠন করে সরে যেতে চায় প্যারিস।

একটি সামরিক প্রশিক্ষণে জুন মাসে অংশ নিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা ও ইউরোপের হাজার হাজার সেনা। বিস্ময়করভাবে সেখানে অনুপস্থিত ছিল ফ্রান্স। আফ্রিকার সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স এই মহাদেশে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখা এবং সাহারার দক্ষিণে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দীর্ঘদিন ধরেই ছিল বড় শক্তি।

যুক্তরাষ্ট্র যখন এ অঞ্চলের অন্যতম বৃহত্তম সামরিক মহড়া চালাচ্চিল, ফ্রান্স তখন এই মহাদেশ থেকে বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেশটি ঘোষণা দিয়েছে যে, চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের নেতৃত্বাধীন ‘অপারেশন বারখেন’ শেষের দিকে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ফ্রান্সের ওই অভিযান কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। এ অঞ্চলে চরমপন্থীদের সহিংসতা আদৌ কমেনি।

ফ্রান্সের এই পিঠটানের পর প্রশ্ন উঠছে বাইডেন প্রশাসন এ অঞ্চলে কতটা ভূমিকা রাখতে চায়। সাহেল নামে পরিচিত এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন সহযোগীর ভূমিকায় ছিল। পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার দেশগুলো বলছে, চরমপন্থী সংগঠনের হাত থেকে দেশকে বাচানোর মত অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র তাদের নেই। পশ্চিমা সমর্থন ছাড়া তারা টিকে থাকতে পারবে না।

অপারেশন বারখেনের অংশ হিসেবে সাহেল অঞ্চলে ফ্রান্সের ৫ হাজার একশ’ সেনা মোতায়েন রয়েছে। চরমপন্থীদের কাছ থেকে মালির রাজধানীকে রক্ষার জন্য ২০১৪ সালে এই বাহিনী গঠন করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রেরও সেখানে ১১০০ সেনা সদস্য রয়েছে। তবে তাদের ভূমিকা মূলত প্রশিক্ষণ, লজিস্টিক সহায়তা ও গোয়েন্দা তৎপরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এ অঞ্চলে সন্ত্রাসবিরোধী জোট গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মিত্র দেশকে স্পেশাল ফোর্স সরবরাহের অনুরোধ করেছেন। তারা বারখেনের স্থলাভিষিক্ত হবে।

ম্যাক্রোঁ ঘোষণা দিয়েছেন, তার দেশের সেনাবাহিনী আর পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে ইসলামী চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না। সাহেল অংশের মধ্যে রয়েছে সেনেগাল, মালি, বুরকিনা ফাসো, নাইজার, চাদ, মধ্য ও দক্ষিণ সুদান, ইরিত্রিয়া এবং ইথিওপিয়া।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে নতুন অভিযানে অংশ নিতে পশ্চিমা দেশগুলোর তেমন আগ্রহ নেই। অন্যদিকে সাহেল অঞ্চলের দেশগুলোও নিজেদের সেনা ও অর্থ দিয়ে চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়তে সক্ষম নয়। ফ্রান্স সরকারের এই পিছু হটার ফলে এ অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে পারে চীন ও রাশিয়া।

গবেষকরা বলছেন, বৈশি^ক প্রভাব বাড়ানোর অংশ হিসেবে দুটি দেশই আফ্রিকা মহাদেশে নিজেদের শক্তিমত্তা ও প্রভাব বাড়াতে সচেষ্ট। ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিসের আফ্রিকা প্রোগ্রামের পরিচালক জুড ডেভারমন্ট ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, রাশিয়া ইতিমধ্যেই সাহেল অঞ্চলের কয়েকটি দেশের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করেছে। তারা এই সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুত।

ফ্রান্স ও আঞ্চলিক সেনাবাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা সত্ত্বেও সাহেল অঞ্চলে রক্তপাত অব্যাহত আছে। চরমপন্থীদের কেন্দ্রস্থল মালি থেকে হামলা এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। ২০১১ সালে লিবিয়ার স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে বলে গবেষকরা দাবি করছেন। বুরকিনা ফাসো ও নাইজারে চরমপন্থীরা শক্তি সঞ্চার করেছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, এ অঞ্চলে সহিংসতায় ২০২০ সালেই অন্তত সাত হাজার মানুষ মারা গেছে। এক বছরে এটাই সর্বোচ্চ প্রাণহানি। বুরকিনো ফাসোতে কয়েক বছরের মধ্যে একটি গ্রামে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলায় মারা যায় অন্তত ১৩২ জন। সরকারি বাহিনী এবং তাদের সহযোগী গ্রামীণ প্রতিরক্ষা গোষ্ঠীগুলোও শত শত বেসামরিক লোককে হত্যা করছে। চরমপন্থীদের সহায়তা করার অভিযোগে শত শত নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে বলে গবেষকরা দাবি করছেন।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক হান্নাহ আর্মস্ট্রং বলেন, ফ্রান্সের নেতৃত্বাধীন বাহিনী সাহেল অঞ্চলের কিছু চরমপন্থী নেতাকে হত্যা করলেও তাদের পরাস্ত করা যায়নি। বরং এ অঞ্চলে এখন স্বৈরশাসকদের উত্থান হচ্ছে ও অস্থিতিশীলতাও বাড়ছে। এতে বেসামরিক লোকরা আরও বেশি ঝুকিতে পড়ছেন। ফ্রান্সের নেতৃত্বাধীন বাহিনী বিদায় নিলে সেখানে সংলাপের পরিবেশ তৈরি হতে পারে। আবার সাহেল অঞ্চলের এই যুদ্ধ ফ্রান্সের অভ্যন্তরেও জনসমর্থন পাচ্ছে না।

পশ্চিম আফ্রিকা দেশগুলো মনে করছে, ফ্রান্সের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর অপারেশন বারখেন উপকারের চেয়ে ক্ষতিই করেছে বেশি। মালি ও তার প্রতিবেশি দেশগুলো ফরাসি সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

বুরকিনা ফাসোর একজন সেনা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের সহায়তা নিশ্চয়ই প্রয়োজন। তবে বছরের পর বছর ধরে ফ্রান্স প্রমাণ করেছে যে তাদের পক্ষে সহায়তা করা সম্ভব নয়। জনগণ দিনদিনই বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। কিন্তু আফ্রিকার জনগণ কেন ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছেন?

এক সময় ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল আলজেরিয়া মালি, গিনি, আইভরি কোস্ট, কঙ্গো, গ্যাবন, সোমালিয়াসহ আফ্রিকার আরও অনেক দেশ। আফ্রিকার বিশাল দেশ আলজেরিয়ায় ফরাসীদের উপনিবেশ ছিল দীর্ঘ দেড়শ’ বছর ধরে। আট বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৬২ সালে মুসলিমপ্রধান আলজেরিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৫৪ সাল থেকে ৬২ পর্যন্ত ফরাসী বাহিনীর হাতে ১৫ লাখের বেশি আলজেরীয় নিহত হন।

সিএফএ ফ্রাঙ্কের মাধ্যমে এভাবে আফ্রিকার ১৪টি দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে ফ্রান্স। এই মুদ্রা ছাপেও তারা। এসব দেশের রিজার্ভের অন্তত ৫০ ভাগ ফ্রান্সের ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। ফ্রান্স আবার সেই টাকা উচ্চ সুদে সেই দেশগুলোকেই ঋণ দেয় । এই দেশগুলো আজও বিশে^র দরিদ্রতম।

এভাবে আফ্রিকার প্রতিটি সাবেক কলোনিতে ক্যু এবং পাল্টা ক্যুয়ের মাধ্যমে ফ্রান্স নিজেদের অনুগত স্বৈরশাসকদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে রেখেছে। আর তাদের মাধ্যমে খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ আফ্রিকার সম্পদ লুট করে নিচ্ছে। ১৯৬৪ সালে ফ্রান্স গ্যাবনে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ওমর বঙ্গোকে ক্ষমতায় বসায়। তার শাসনব্যবস্থা চলে পরবর্তী ৪২ বছর পর্যন্ত । গ্যাবনে আছে বিশাল ইউরেনিয়ামের মজুদ। আর ফ্রান্সের পরমাণু চুল্লিগুলোর জন্য দরকার এই ইউরেনিয়াম। ওমরের মৃত্যুর পরও গ্যাবনে ক্ষমতায় আছে তার ছেলে আলি ওমর বঙ্গো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ফ্রান্স আফ্রিকাতে এ পর্যন্ত ৩০টিরও বেশি সামরিক ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। আফ্রিকার প্রায় প্রতিটি অভ্যুত্থান ও গুপ্তহত্যার পেছনে ফ্রান্সের ভূমিকা আছেবলে অভিযোগ আছে। ২০১১ সালে লিবিযার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে উৎখাত করার পেছনেও প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল ফ্রান্স। ফ্রান্সই সর্বপ্রথম লিবিয়ার বিদ্রোহীদেরকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

গাদ্দাফির মৃত্যুর পরে আমেরিকা লিবিয়া থেকে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ফ্রান্স দিনে দিনে তার কার্যক্রম আরো বাড়িয়েছে। সামরিকভাবেও ফ্রান্স লিবিয়াতে বেশ সক্রিয়। ২০১৫ সাল থেকেই ফ্রান্স লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধবাজ নেতা জেনারেল খালিফা হাফতারের অন্যতম সহযোগী। আফ্রিকার অন্যান্য কলোনিগুলোর মতোই লিবিয়াতেও একজন স্বৈরশাসককে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে ফ্রান্স। মিশরের স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসিরও বড় পৃষ্ঠপোষক ফ্রান্স।

ফ্রান্স আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ ইউরোনিয়াম, স্বর্ণ, জ্বালানি, কফির উপর একচেটিয়া দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে। ফ্রাংক ব্যবহারকারী ১৪টি দেশের জলবিদ্যুৎ, টেলিফোন, পরিবহন, ব্যাংক, কৃষি, নির্মাণ শিল্প সবই ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্রান্সই একমাত্র দেশ যে তার সাবেক উপনিবেশগুলোতে এখনও শোষণের ধারা অব্যাহত রেখেছে। বলা চলে, ফ্রান্স টিকেই আছে তার সাবেক উপনিবেশ আফ্রিকাকে শোষণের মধ্য দিয়ে।

আইভরি কোস্টের ফ্রিডম অ্যান্ড ডেমোক্রেসি পার্টির উপদেষ্টা নাথালি ইয়াম বলেন, ফ্রান্সের কাছ থেকে আফ্রিকার দেশগুলো ৬০ বছর আগে স্বাধীনতা পেলেও এখনো এ দেশগুলোতে সত্যিকার স্বাধীনতা নেই। এমনকি স্কুলের পাঠ্যসূচি পর্যন্ত এখনো ফ্রান্স ঠিক করে দেয়।

এসব কারণে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের কারণেই ম্যাক্রোঁ এখন ওই অঞ্চল থেকে বিদায় নিতে চাইছেন। মালিতে ৯ মাসের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় সেনা অভ্যুত্থান হওয়ার পর ম্যাক্রোঁ সেনা সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছেন। মালি চালাচ্ছে এখন সেনাবাহিনী। পশ্চিমা সরকারগুলো তাদের সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দিয়েছে। জাতিসংঘের ১৩ হাজার শান্তিরক্ষী আছে দেশটিতে। তবে তাদের দায়িত্ব মূলত বেসামরিক লোকদের জীবনরক্ষা।

অপারেশন বারখেনের পরিবর্তে ফ্রান্স গত বছর অপারেশন তাকুবা বাহিনী গঠনের জন্য ইউরোপীয় মিত্রদের সহায়তা চায়। অপারেশন বারখেনের অধীনে মালিতে ফ্রান্স, সুইডেন, এস্তোনিয়া ও চেক প্রজাতন্ত্রের মাত্র ৬০০ সেনা রয়েছে। ম্যাক্রোঁর অনুরোধে সাড়া দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকা কমান্ড তাকুবায় যোগদান করবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়।