মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামীরা আন্তরিকভাবে চাইছে যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জোরপূর্বক ক্ষমতায় আসীন হওয়া সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে। কোনো দেশের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করলে পশ্চিমা বিশ্ব নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশটির ওপর অবরোধ আরোপ করতে চায়। তারা দেশটির কাছে অস্ত্র বিক্রি করা বন্ধ করে দেয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর নানা ধরনের অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অথচ, মিয়ানমারের ক্ষেত্রে গোটা বিষয়টি বেশ ভিন্নভাবে অগ্রসর হচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে।
মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলো সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে বরং ব্যবসা ও আর্থিক লেনদেনকেই অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। যেমন ধরা যাক অস্ট্রেলিয়ার কথা। অস্ট্রেলিয়া কখনও কোনো ইস্যুতে নিজ থেকে স্পষ্ট কোনো অবস্থান নিতে চায় না। তারা বরাবরই তাদের মিত্রদেশ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থানের আলোকে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করে।
পশ্চিমা দেশগুলো এখনও অবধি অবরোধ আরোপের মতো কড়া পদক্ষেপ নেয়নি। তবে তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ব্যবসা বাণিজ্য এবং মিয়ানমার বাহিনীর সাথে ব্যবসাকে নিষিদ্ধ করেছে। এছাড়া সামরিক জান্তা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের বিদেশে থাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা এবং তাদের ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু জাতীয় স্বার্থের দোহাই দিয়ে অস্ট্রেলিয়া এখনই এ ধরনের চরম কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে না। এ অঞ্চলের অন্য কোনো দেশও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এ রকম শক্ত পদক্ষেপ নেয়নি- একে অস্ট্রেলিয়া অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে।
গত এপ্রিলে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় আসিয়ান নেতারা সর্বশেষ বৈঠকে মিলিত হন। মিয়ানমার ১৯৯৭ সাল থেকেই আসিয়ানের সদস্যরাষ্ট্র। আসিয়ান নেতারাও মিয়ানমারের সামরিক নেতাদেরকে খারিজ করে কোনো অবস্থান নেননি। বরং মিয়ানমারে বিগত কয়েকমাস ধরে চলমান সহিংসতার খবর জানার পরও আসিয়ান নেতারা সংলাপের মধ্য দিয়ে চলমান সংকট নিরসনের সুপারিশ করেছে।
এর আগে প্রায় দুই দশক মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেছে। তখনও আসিয়ান নেতারা একই অবস্থান নিয়েছিল। অন্যদিকে, চীন পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, তারা মিয়ানমারের পাশে আছে। চীন এমন একটি উন্নয়ন প্রক্রিয়া বের করার চেষ্টা করছে, যা মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। চীন মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে যাওয়ায় জাতিসংঘও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না।
মিয়ানমারে অবরোধ আরোপের ঘটনা আগেও ঘটেছে। ১৯৮৮ সালে গণতন্ত্রকামীদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী নিপীড়ন ও নির্যাতন চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন সে বছরেরই সেপ্টেম্বর মাসে একবার মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন র রিগ্যান প্রশাসন সব ধরনের আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করে দেয়। সামরিক বাহিনী ১৯৮৯ সালে দেশটির গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু চি-কে গৃহবন্দি করে। এ সকল ঘটনার প্রেক্ষিতে অবরোধের মাত্রাও জোরদার করা হয়।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সহযোগীদের ১৯৯৬ সালে ক্লিনটন প্রশাসন ভিসা স্থগিত করে দেয়। এরপর ১৯৯৭ সালে মিয়ানমারে নতুন করে সকল বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। ২০০৩ সালে মার্কিন কংগ্রেস মিয়ানমার থেকে যাবতীয় আমদানি নিষিদ্ধ করে। পাশপাশি, মার্কিন নাগরিকদেরকেও মিয়ানমারে কোনো ধরনের আর্থিক সহযোগিতা বা পেশাগত কোনো কাজে যুক্ত হতে নিষেধ করা হয়।
২০০৮ সালে মিয়ানমারে উৎপাদিত কোনো ধরনের মূল্যবান খনিজ পদার্থ বা অলংকারের আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এসব পদক্ষেপ নেয়ার পর অন্য পশ্চিমা দেশগুলো একইপথে অগ্রসর হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৯৯৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর মিয়ানমারের সামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং তাদের পরিবারের জন্য অস্ত্র ব্যবহারে এবং ভিসা সরবরাহে অবরোধ আরোপ করে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০০৭ সালে মিয়ানমার থেকে কাঠ ও কাঠ নির্মিত সামগ্রী, অন্যান্য ধাতব পণ্য এবং মূল্যবান পাথরের আমদানিও বন্ধ করে দেয়। অস্ট্রেলিয়াও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের এসকল পদক্ষেপকে সে সময়ে সমর্থন করেছিল। তারাও শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের আর্থিক লেনদেনের ওপর প্রতিবন্ধকতা আরোপ করে। পাশাপাশি তাদের ভিসা স্থগিত করে দেয় এবং ভ্রমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে অস্ট্রেলিয়া কয়েক জন সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এসব পদক্ষেপ নিলেও মিয়ানমারের সাথে কখনও ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আর্থিক লেনদেন বন্ধ করেনি।
এ সময় মিয়ানমারের প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলো তখনও আগের মতোই মিয়ানমারের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে আসছিল। চীন বরং আগের তুলনায় মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক আরো গভীর করে। আসিয়ান নেতারা তখনো সংলাপের কথা বলতো। এমনকী মালয়েশিয়াও মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক খারাপ করতে চায়নি।
যুক্তরাষ্ট্র এবং বেশ কিছু মিত্র দেশ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সে সময় কঠোর অবস্থান নিলেও এশিয়ার দেশগুলো এ ধরনের কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ অনুপস্থিতিকে তারা নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। যুক্তরাষ্ট্র যে সময় মিয়ানমারের ওপর অবরোধ চাপিয়েছিল, তখন এশিয়ার দেশগুলো মিয়ানমারে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের পরিমাণ অনেকটাই বৃদ্ধি করেছিল।
ইতিহাসের এ বাস্তব চিত্র পর্যালোচনা করে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা নতুন করে মিয়ানমারের ওপর অবরোধ আরোপের বিষয়টিকে অর্থহীন হিসেবেই মনে করছেন। আসলে একতরফাভাবে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ওপর অবরোধ আরোপ করলে তা সবদিক থেকেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেন, কোনো দেশের ওপর বড়ো আকারের অবরোধ চাপিয়ে দিলে বা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা - আর্থিক অনুদান বন্ধ করলে সংকটের মূল কারিগররা খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হন না। বরং যারা দরিদ্র এবং যাদের বেশি সহযোগিতা প্রয়োজন তারাই নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ২০০৪ সালের একটি পর্যবেক্ষন থেকে জানা যায়, ২০০৩ সালে মিয়ানমার থেকে পন্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর মিয়ানমারের পোশাক উৎপাদন শিল্পের ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে যান।
এমন বাস্তবাতায় প্রশ্ন এসেছে, ২০২১ সালে এসে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং পশ্চিমা দেশগুলো কি সত্যিই এমন কোনো অবরোধ আরোপ করতে পারবে যাতে মিয়ানমারের শাসক গোষ্ঠী চাপের মুখে পড়বে। বিশ্লেষকরা মনে করেন এমনটা করা অসম্ভবও নয়। কারণ বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবরোধ জারি করলে তার ব্যাপকভিত্তিক প্রভাব পড়বে। কেননা, বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক এ দেশগুলোতেই অবস্থিত এবং এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত। এ ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্র করেই শেয়ারের কেনাবেচা হয়। তাই বড়ো দেশগুলো অবরোধ আরোপ করলে অবরুদ্ধ দেশটির অথনৈতিক কার্যক্রমে অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে।
মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত এবং সাবেক মার্কিন কংগ্রেসম্যান থমাস এন্ড্রিউস মনে করেন, মার্কিন কর্তৃপক্ষ যদি মিয়ানমারের জান্তা প্রশাসনের ওপর অবরোধ আরোপ করে তার প্রভাব হবে মারাত্নক। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের কোনো ব্যাংকও যদি মিয়ানমারের প্রশাসনের সহায়তায় মার্র্কিন ডলার লেনদেন করে করে তাহলে তাদেরকে বড়ো আকারের ফৌজদারি ও জরিমানা গুনতে হবে। যদি এমনটা হয়, তাহলে চীনা সমর্থন পাওয়ার পরও মিয়ানমারের সামরিক জান্তা আর্থিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যেতে পারে।
মিয়ানমার প্রশাসনকে বেকায়দায় ফেলার আরেকটি উপায় হলো মানবাধিকার সংগঠন ও সিভিল সোসাইটির মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করা। এরই মধ্যে মিয়ানমারের সামরিক কোম্পানিগুলোর সাথে আঁতাত করে ব্যবসা করায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অনেকটাই প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার স্টিল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান পোসকো এবং ভারতীয় কোম্পানি আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে সহায়তা করার অভিযোগ উঠেছে।
সামরিক জান্তার বিকল্প হিসেবে দেশটির বরখাস্ত হওয়া পার্লামেন্ট মেম্বাররা এরই মধ্যে একটি ছায়া সরকার গঠন করেছে। যারা বিদেশী সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে মিয়ানমারের সামরিক প্রশাসনের সাথে সম্পর্ক ছেদ করার আহবান জানিয়েছে। মিয়ানমার সরকারকে কোনো ধরনের আর্থিক বিল পরিশোধ না করতেও এ কোম্পানিগুলোর প্রতি অনুরোধ করা হয়েছে।
গণতন্ত্রকামীরা চাইছেন, মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে চারদিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে কোণঠাসা করার মাধ্যমে ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য করতে। পুনরায় গণতান্ত্রিক একটি শক্তিকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু অবরোধ আরোপের মতো পদক্ষেপের দিকে আন্তর্জাতিক মহল কতটা এগিয়ে যেতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।