তুরস্ক ও আজারবাইজান ঘনিষ্ঠতা : পেছনের কারণ কী?


  • শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
  • ২৫ জুন ২০২১, ১৩:৪২

নাগরনো-কারাবাখ নিয়ে সর্বশেষ লড়াই হয়েছিল গত বছর। এ লড়াই শেষ হয় রাশিয়ার মধ্যস্থতায়। ফলাফল আসে আজারবাইজানের ঘরে। অবৈধভাবে আর্মেনিয়ার দখলে থাকা নাগরনো-কারাবাখ মুক্ত করে আজারবাইজান। আর এই যুদ্ধে প্রকাশ্যে সহযোগিতা করে তুরস্ক। সম্প্রতি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আজারবাইজান সফর করেন।

তুরস্ক ও আজারবাইজান দেশ দুটির মধ্যে গলায় গলায় ভাব! এর পেছনের কারণ কী? কারণ অনেক। এর মধ্যে একটি- আজারিরা তুর্কিদের ভাই। দেশ দুটিতে স্লোগান প্রচলিত আছে, ‘এক জাতি, দুই দেশ’। জাতি এক হলেও দীর্ঘ সময় ধরে আজারবাইজান ছিল রাশিয়ার কব্জায়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দেশটির রাজনীতি ব্যাপকভাবে তুর্কীমুখী হতে থাকে। তবে এর আগে থেকেই তুর্কিদের সাথে ছিল আজারিদের ভাইয়ের সম্পর্ক। বহু আজারির বসবাস তুরস্কে। আবার বহু তুর্কির বসবাস আজারবাইজানে। আর এই সম্পর্কটিই দেশ দুটির বন্ধনের প্রধান সূঁতো।

তাছাড়া আর্মেনিয়ার সাথে বিরোধে আজারবাইজানের পাশে যেভাবে এসে দাঁড়িয়েছিল তুরস্ক, এতে দুই দেশের জনগণের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছেন তুর্কী নেতা এরদোয়ান। তিনি সম্প্রতি বাকু সফর করেছেন। ভাষণ দিয়েছেন আজারবাইজানের পার্লামেন্টে।

এই ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘ককেশাসে শান্তি ও স্থিতিশীলতা এলে কেবল এই অঞ্চল নয়, উপকৃত হবে গোটা বিশ্ব। শুধু আজারবাইজান নয়, আর্মেনিয়াতেও শান্তি আসবে।’

আজারবাইজানের প্রতি তুরস্কের সমর্থনের কথা পুনরাবৃত্তি করে তিনি বলেছেন, ‘আজ আমরা সর্বাত্মকভাবে আজারবাইজানের পাশে আছি। ঠিক এভাবে অগামীকাল আপনার পাশেও দাঁড়াবো। আর্মেনিয়ার সাথে আজারবাইজানের সমস্যার যেন সমাধান আসে, আমরা এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবো।’

এরদোয়ান বলেন, ‘যারা বিশ্বকে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্খার চোখে দেখেন, নাগরনো-কারাবাখ পুনরুদ্ধার তাদের পরিকল্পনাও ব্যর্থ হয়ে গেছে। আর্মেনিয়ানরা ঘরবাড়ি ধ্বংশ করে, আগুন লাগিয়ে এই অঞ্চল ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আজারবাইজান এখন তুরস্কের সাথে মিলে গ্রামগুলো পুননির্মাণ করছে।’ তিনি বলেন, ‘যারা সভ্যতা এবং ধ্বংসের মধ্যে পার্থক্য দেখতে চান তারা কারবাখে দুই সময়ের মধ্যে পার্থক্য দেখতে পাবেন।’

আজরাবাইজান এবারের যুদ্ধে যে এলাকা বিজয় করেছে সেই শুসা সফর করেন এরদোয়ান। সেখানে তিনি বলেন, ‘নাগরনো-কারাবাখের শুশা শহরকে এ বছর আজারবাইজানের সংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে দেখে তুরস্ক খুশি হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘শুশা হলো বুদ্ধিজীবিদের শহর। এদের আইডিয়ায় তুর্কি বিশ্ব সমৃদ্ধ হতে পারে। সংস্কৃতি এবং সভ্যতার পুনর্জাগরণ হতে পারে।’ আজারবাইজানের জাঙ্গেজুর করিডোর প্রকল্পের বিষয়ে এরদোগান বলেন, প্রকল্পটি এই অঞ্চলে স্বস্তি এবং সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। এরদোয়ানের এসব বক্তব্যর মধ্যে এ অঞ্চলের কৌশলগত রাজনীতির নানা দিক লুকিয়ে আছে।

জাঙ্গেজুর এক সময় আজারবাইজানের অংশ ছিল। তবে ১৯২০ এর দশকে সোভিয়েতরা এই অঞ্চলটি আর্মেনিয়াকে দিয়েছিল।

পার্লামেন্টে ভাষণের পর এরদোয়ান বাকুতে তুর্কি এবং আজারবাইজানীয় কবরস্থান পরিদর্শন করেন। এইসব করস্থানে ঘুমিয়ে আছেন আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে বিরোধে নিহত অনেক আজারি।

সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হওয়ার পর থেকে দেশ দুটির ভৌগোলিক বিরোধ প্রকট হয়। রুশ বিপ্লবের পর ১৯১৮ সালে রাশিয়ান সাম্রাজ্যের পতন হয়। তখন দেশ দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মূলত যুদ্ধটা শুরু হয় সেই গোড়ার সময় থেকেই। রুশ বিপ্লবের দ্বিতীয় ধাপে বলশেভিকদের বিজয়ের পর ১৯২৩ সালে দুটি দেশই সোভিয়েত ইউনিয়নের পেটের ভেতর চলে যায়। সেই সময় নাগরনো-কারাবাখ ছিল আজারবাইজান সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অধীনে।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে দুটি দেশই স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। তখন আজারিদের অংশগ্রহণ ছাড়া এক গণভোটে নাগরনো-কারাবাখকে আর্মেনিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে দেশ দুটির মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। নাগরনো-কারাবাখ এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আজারবাইজানের মানচিত্রে থাকলেও আর্মেনিয়া সেনাবাহিনী পাঠিয়ে সে অঞ্চল দখলে নেয়।

গত বছর দুই দেশের এই বিরোধ আরো বেড়ে যায়। শুরু হয় যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ছয় সপ্তাহ ধরে চলে। পরে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয়।এই যুদ্ধে নাগরনো কারাবাখের কয়েকটি কৌশলগত শহর এবং প্রায় ৩০০টি জনবসতি ও গ্রাম পুনরুদ্ধার করে উজারবাইজান। ১০ নভেম্বর দুই দেশের যুদ্ধের অবসান হয়। একটি বৃহত্তর সমাধানের জন্য শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর হয়। এই যুদ্ধে আজারবাইজানের পেছনে ব্যাপক রাজনৈতিক, সামরিক ও নৈতিক সমর্থন ছিল তুরস্কের।

তুরস্ক ও আজারবাইজান জাতিগত, ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, ধর্মীয় ও ঐতিহ্যগতভাবে এক। ভৌগোলিক দিক থেকে দুই দেশ পাশাপাশি। উজবেকিস্তান এবং কাজাখস্তানের ভাষা তুর্কি হলেও দেশ দুটি আজারবাইজানের মতো তুরস্কের সাথে ঘনিষ্ঠ নয়।

১৯১৮ সালে প্রথমবারের মতো স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের সময় আজারবাইজানকে সক্রিয় সমর্থন করে ওসমানীয় সাম্রাজ্য। আর ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পরও দেশটিকে প্রথম স্বীকৃতি দেয় তুরস্ক। এ সময় থেকেই পারস্পরিক অর্থনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার হতে থাকে। তাছাড়া রাশিয়ান সাম্রাজ্যের সময় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়ও আজারবাইজান থেকে অনেক বুদ্ধিজীবি তুরস্কে চলে এসেছিলেন। এরা তুরস্কের ভ’মিতে থেকেই আজারবাইজানের জন্য বুদ্ধির চর্চা করতেন।

এসব নানা কারণেই দেশটির সাথে তুরস্কের সম্পর্ক গাঢ় হয়ে উঠে। সদ্য স্বাধীন আজারবাইজানের সাথে আর্মেনিয়ার যুদ্ধে ছিল তুরস্কের ব্যাপক সহায়তা। তবে সে সময় তুরস্কের রাজনৈতিক সাহস এখনকার মতো শক্তিশালী ছিল না। এ কারণে সহায়তাগুলো এখনকার মতো প্রকাশ্য ছিল না। ওই সময়ও তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থা আজারবাইজানকে যুদ্ধের রসদ সরবরাহ করেছে। আজারি সেনাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। যুদ্ধের মাঠে তুরস্ক থেকে পাঠানো হয়েছে স্বেচ্ছাসেবক।

ওই যুদ্ধে আজারবাইজান পরাজিত হয়। এর জন্য দায়ী করা হয় দুর্নীতি, সেনাদের প্রশিক্ষণ এবং মনোবলের অভাবকে। ওই যুদ্ধের পর নাগরনো-কারাবাখসহ সাতটি এলাকা চলে যায় আর্মেনিয়ার দখলে।

তবে এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। এর মধ্যে অর্থনীতি ও রাজনীতিতে শক্তি অর্জন করেছে আজারবাইজান। পাশাপাশি নতুন করে বিশ্বশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে তুরস্ক।

তুরস্কের বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে দেখা যাচ্ছে খিলাফতের ছবি। সঙ্গত কারণেই তুরস্ক এখন আগের চাইতে অনেক বলিষ্ঠ। আঞ্চলিক ও ককেসাস এর রাজনীতিতে দেশটি এখন বড় খেলোয়াড়। বিশ্লেষকরা বলছেন, শক্তি ও সামর্থ্যরে জোরেই আজারবাইজানের পক্ষে প্রকাশ্যে নামতে পেরেছে তুরস্ক।

২০২০ সালের জুলাইয়ে আজারবাইজান-আর্মেনীয়া সংঘাতের পর থেকে আজারবাইজানের জন্য মাঠে নেমে যায় তুরস্ক। বাকু, গাঞ্জা, কুর্দামির, ইয়েভলাখ ও নাখচিভান অঞ্চলে যৌথ সামরিক মহড়া শুরু করে। এই মহড়াকে সামনে দেখিয়ে কিছু তুর্কি অস্ত্র রেখে যাওয়া হয় আজারবাইজানের ভূমিতে। পরে এই অস্ত্রগুলো কাজে লেগেছে রণাঙ্গনে। নাগরনো-কারাবাখের আকাশে উড়েছে তুর্কি ড্রোন।

যুদ্ধের সময় এক সুরে কথা বলতে দেখা গেছে দেশ দুটির সাধারণ মানুষকেও। তুরস্কের রাজপথে দেখা গেছে আজারবাইজানের পতাকা হাতে মিছিল। অন্যদিকে নাগরনো-কারাবাখ উদ্ধারের পর আজারবাইজানে দেখা গেছে তুরস্কের পতাকা হাতে বিজয়মিছিল? দেশ দুটির এই বন্ধন কি কেবল ‘এক জাতি, দুই দেশ’ এর সূঁতোয় গাঁথা। না। এর পেছনে আছে ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত কিছু কারণও।

তুরস্কে রয়েছে জ্বালানি সম্পদের ব্যাপক ঘাটতি। রাশিয়া থেকে জ্বালানির বড় একটি অংশ আমদানি করতে হয় দেশটির। জ্বালানির ক্ষেত্রে খুব বেশিদিন রাশিয়ার ওপর নির্ভরতাকে ঝুঁকি হিসেবেই দেখছে তুরস্ক। ককেসাস এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে রাশিয়া-তুরস্কের বিরোধ এখন লুকোছাপার মধ্যে নেই। এই বিরোধ আরো প্রকট হয়ে দেখা দিলে বিপর্যয়ে পড়তে পারে তুরস্ক। তাই বিকল্প হিসেবে জ্বালানি সমৃদ্ধ আজারবাইজানের ওপর নির্ভর করতে চাইছে দেশটি।

কেবল অর্থনীতি নয়, আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রভাব বাড়ানোর আকাঙ্খায় আজারবাইজানের নাখচিভান এলাকায় সামরিক ঘাঁটি বানাতে চায় তুরস্ক।

এছাড়া ককেসাস অঞ্চলকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে নিয়ে আসতে আজারবাইজান থেকে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে দেশটি। রাশিয়ার সাথে পাল্লা দিতে তুরস্কের উষ্ণতা বাড়ছে জর্জিয়ার সঙ্গেও।

রাশিয়ার ভেতরেও খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হতে চাচ্ছেন রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। ইতোমধ্যে রুশ নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি প্রজাতন্ত্রের ভেতরে তুর্কি প্রভাব তৈরি করার কাজ শুরু করেছেন তিনি। অন্তত বিশ্লেষকরা এমন ধারণাই প্রকাশ করছেন গণমাধ্যমে।