যুক্তরাষ্ট্রের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ দ্রুত উদীয়মান চীনকে মোকাবিলা করা। এক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের জন্য আরেক মাথাব্যথার কারণ রাশিয়ার সঙ্গে চীনের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রাশিয়ার নেতা ভ্লাদিমির পুতিন উষ্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। এই দেশের সম্মিলিত শক্তি সহজেই যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে। তাই বেইজিং ও মস্কোর মধ্যে সম্পর্কে ফাটল ধরাতে মরিয়া ওয়াশিংটন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি রাশিয়ার নেতা ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে বৈঠকে করেছেন। এ সময় তিনি এবং তার সহযোগীরা মস্কো-বেইজিং সম্পর্কের দিকে গভীর মনোযোগ দেন। চলতি মাসের শুরুর দিকে রাশিয়া এবং চীনা কর্মকর্তারা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি বার্ষিকী উদযাপন করেন। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন তারা।
‘সু-প্রতিবেশীতা, বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করার বিশ বছর’ পূর্তিতে আয়োজিত একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ফোরামকে ভিডিও বার্তায় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন চীনা-রাশিয়া সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌছেছে এবং এটা এখন বৃহত্তর ক্ষেত্র ও গভীর স্তরে পৌঁছানোর জন্য প্রস্তুত।
ফোরামে ভিডিও ভাষণে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, মস্কো এবং বেইজিং বিশ্বব্যবস্থায় অধিকতর ন্যায়বিচার, গণতান্ত্রিক এবং স্থিতিকেন্দ্রিক ব্যবস্থা গঠনের ধারাবাহিক সমর্থক।
পুতিনকে চীনের নেতা শি জিনপিং তার ‘সেরা বন্ধু’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এটাকে কী অতিশয়োক্তি বলে মনে হচ্ছে? কিছুটা হলেও এটা সেরমকই। এটাকে কি কপটতা মনে হচ্ছে? কিছু ফ্রন্টে অবশ্যই। তবে মস্কো এবং বেইজিংয়ের মধ্যে এইরকম দহরম-মহরম বক্তব্য বাইডেন প্রশাসনের চরম মাথাব্যথার কারণ।
প্রকৃতপক্ষে, রাশিয়া ও চীনের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে প্রখ্যাত আমেরিকান কৌশলবিদরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। আর এমন সময় এটা ঘটছে যখন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশী নীতির কেন্দ্রে রয়েছে উদীয়মান চীনকে মোকাবিলার দিকে মনোনিবেশ করা। প্রেসিডেন্ট বাইডেন জেনেভায় পুতিনের সাথে বৈঠকেও বেইজিংয়ের সাথে মস্কোর সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
বহু বছর ধরে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে সম্পর্ক কৌশলগত সহযোগিতা বা অস্থায়ী অংশীদারিত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল বলে মনে করা হতো বলে বাইডেন প্রশাসনের এক প্রবীণ কর্মকর্তা পলিটিকোকে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন। তবে সাম্প্রতিককালে এটি আরও স্থিতিশীল এবং কৌশলগত সম্পর্কে রূপান্তরিত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ওই সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, আমরা গত দশকের শেষদিকে দেখেছি চীন ও রাশিয়ার গভীর সম্পর্ক এবং স্পষ্টতই তা উদ্বেগের।
বাইডেনকে চীনা-রাশিয়ার সম্পর্কের বিষয় সম্পর্কে ব্রিফ করা হয়েছে। এ সম্পর্ক নিয়ে গোয়েন্দা তথ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে বলেও খবর এসেছে। পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, পররাষ্টমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনের অনুরোধে ওই ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। তবে বাইডেনের প্রশাসনের অনেক মূল পদ এখনও পূরণ না হওয়ায় বেইজিং-মস্কোর সম্পর্কে গতিশীলতা পর্যবেক্ষণের জন্য তারা এখনো সেরাটা দিতে পারছেন না বলে মন্তব্য করেছেন ওই কর্মকর্তা।
নতুন প্রশাসন সামগ্রিক কৌশল সম্পর্কে কর্মকর্তাদের এখনো বিস্তারিত জানায়নি। এই পদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনি কি গভীরভাবে আর নেতিবাচকভাবে ওই দুটি দেশের লাগাম টেনে ধরবেন ? নাকি আপনি মস্কোর সাথে সম্পর্ক উন্নত চেষ্টা করছেন? এগুলির সবই অবিশ্বাস্যরকম কঠিন জিনিস।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, মস্কো-বেইজিং সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। ১৯৪৯ সালের অক্টোবরে চীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই দেশটিকে স্বীকৃতি দেয় তৎকালীন সাভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৫০-এর দশকেও দুটি দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে তারা উত্তর কোরিয়াকে সামরিক সহায়তা দিয়েছিল।
তবে ১৯৬০-এর দশকে দু'দেশের মধ্যে সম্পর্কের নাটকীয় অবনতি ঘটে এবং কমিউনিস্ট বিশে^ আধিপত্যের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় দুই দেশ। সোভিয়েত ও চীনা সেনারা এমনকি সীমান্তে সংঘর্ষেও জড়িয়েছিল। ১৯৮০ সালে চীন মস্কো অলিম্পিক বয়কট করে। তবে এই দশকের শেষদিকে, দুদেশই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়ে একমত হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, চীন এবং রাশিয়া প্রায়শই কূটনীতিক ফ্রন্টে বিশেষ করে জাতিসংঘের মতো বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠানে একযোগে কাজ করে চলেছে। দেশ দুটি সাধারণত একে অপরকে সমর্থন দেয়। উদাহরণস্বরূপ, সিরিয়ার বিষয়ে চীন প্রায়শই রাশিয়াকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে রাশিয়ার সেনা রয়েছে।
চীন ও রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য বাড়ছে। বর্তমানে তা ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাগিয়েছে। মস্কো এবং বেইজিং ২০২৪ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য দ্বিগুণ করতে চায়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো রাশিয়া এবং চীনের মধ্যে সামরিক এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বাড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাইডেন প্রশাসনের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, উন্নত যুদ্ধবিমান, হাইপারসোনিক প্রযুক্তি, খুব কার্যকর রাডার ব্যবস্থা নিয়ে মস্কো- বেইজিং কাজ করছে। এছাড়া সাবমেরিনের সাথে পারমাণবিক প্রযুক্তি ও নাইট ভিশন নিয়ে রাশিয়া এবং চীন ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে ।
বিশ্লেষক আন্দ্রেয়া কেন্ডাল-টেলর এবং ডেভিড শুলম্যান সম্প্রতি জানিয়েছেন , রাশিয়া এবং চীন প্রায়ই নানা জটিল বিষয়ে যৌথ সামরিক মহড়া চালাচ্ছে। দুটি দেশের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পরে। তারা এক হলে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে দ্রুত উন্নত প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্লেষকই মস্কো-বেইজিং ঘনিষ্ঠতার প্রতি বাইডেন প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন।
টমাস গ্রাহাম এবং রবার্ট লেগভোল্ড এ বছরের শুরুতে পলিটিকো ম্যাগাজিনে তার মতামতে জানান , চীন রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে, প্রযুক্তিগতভাবে, সামরিকভাবে এবং কূটনৈতিকভাবে আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। পাশাপাশি এই ক্ষেত্রগুলির প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা নতুন দিগন্তকে অতিক্রম করেছে। পূর্ব এশিয়া এবং মধ্য ইউরেশিয়াজুড়ে তাদের সম্মিলিত শক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন সাবেক কর্মকর্তা চীন-রাশিয়ার সম্পর্ককে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন। তারা বলেছেন দুদেশ এখনও নির্বিঘ্নে সহযোগিতা করে না এবং তাদের মধ্যে অবিশ্বাসের মাত্রাও কম নয়।
রাশিয়া সাম্প্রতিক বছরগুলিতে চীনের বিরুদ্ধে তার সামরিক প্রযুক্তি চুরি করার অভিযোগ করেছে। আর্কটিক অঞ্চলে বেইজিংয়ের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও মস্কো সন্দিহান। ভারত নিয়েও দই দেশের মধ্যে মতবিরোধ থাকা স্বাভাবিক। ভারতের কাছে বড় অস্ত্র বিক্রেতা রাশিয়া। তাদের সম্পর্ক চমৎকার। তবে ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক যথেষ্ট খারাপ। সীমান্তে বারবার সংঘর্ষ হচ্ছে দুই দেশের।
চীনের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাশিয়া ক্রমশ নিজেকে জুনিয়র অংশীদার মনে করছে। মধ্য এশিয়া এবং এর বাইরের দেশগুলির সাথে চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রসারিত করাকেও রাশিয়া সুজনরে দেখছে না। রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরেই এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রা ছিল।
চীনের সাথে রাশিয়ার অর্থনৈতিক সর্ম্পকের বিষয়টি অনেক বেশি জটিল। কারণ এক্ষেত্রে চীনের আধিপত্য রয়েছে। চীন রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্য অংশীদার। তবে রাশিয়া এমনকি বেইজিংয়ের শীর্ষ ১০ ব্যবসায়িক অংশীদারদের মধ্যেও নেই। চীন সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যে অনেক বড় খেলোয়াড়। কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই চী যত টাকার পণ্য রফতানি করে, তা সমগ্র বিশ্বে রাশিয়ার মোট রফতানির চেয়েও বেশি।
চীনের সাথে রাশিয়ার শক্তির ভারসাম্যহীনতার বিষয়টি সম্পর্কে পুতিন ভালই জানেন। কিছু বিশ্লেষক মনে করেছেন, সম্প্রতি ইউক্রেন সীমান্তে সেনা উপস্থিতি বাড়িয়ে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে যে, মস্কোকে উপেক্ষা করা যাবে না। যদিও বাইডেনে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ এখন চীন।
চীন ও রাশিয়া উভয় দেশের সাথেই আমেরিকার সম্পক এখন যথেষ্ট শীতল ও উত্তেজনাপূর্ণ। মস্কো ও বেইজিং খুবই সতর্ক যে যাতে তাদের সম্পর্কে উত্তেজনা তৈরি না হয় বা কেউ তাদের বিভক্ত করতে না পারে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকেই তাদের একমাত্র সন্দেহ।