তুরস্ক ও ফ্রান্সের মধ্যে সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরেই টানাপড়েন চলছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লিবিয়া, সিরিয়া, পূর্ব ভূমধ্যসাগরসহ বেশ কিছু ইস্যুতে তুরস্ক ও ফ্রান্সের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। এই বিরোধ আরও চাঙা হয় ২০১৮ সালে ফরাসি কর্মকর্তারা তুর্কি বিদ্রোহী গ্রুপ পিকেকে-র সিরীয় শাখা ওয়াইপিজি-র নেতাদের সাথে বৈঠক করায়। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এসব ক্ষেত্রে ফ্রান্সের নীতি ও ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করে আসছেন। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে। তুরস্কের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সমুদ্রসীমা ও গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে বিরোধেও ফ্রান্স হস্তক্ষেপ করছে। সমুদ্রসীমা নিয়ে গ্রিসের সাথে তুরস্কের বিরোধ রয়েছে। এই বিরোধে ফ্রান্স গ্রিসের সমর্থনে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল পূর্ব ভূমধ্যসাগরে। এখন পরিস্থিতি কিছুটা বদলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
ফ্রান্স ও তুরস্কের মধ্যে বিরোধের বড় একটি ক্ষেত্র হচ্ছে লিবিয়া। সেখানে তুরস্ক সমর্থন দিচ্ছে জাতিসংঘ স্বীকৃত গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড বা জিএনএ সরকারকে। অন্যদিকে ফ্রান্স পরোক্ষভাবে সমর্থন দিচ্ছে লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহী জেনারেল খলিফা হাফতারকে। যদিও দেশটি দাবি করছে যে, তারা নিরপেক্ষ রয়েছে, কোনো পক্ষকেই সমর্থন দিচ্ছে না। এখন দুই দেশই তাদের মধ্যে বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে চাইছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে দুই দেশই জানায়, তারা সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে কাজ করছে। ব্রাসেলসে ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে এরদোয়ান ও ম্যাক্রোঁর মধ্যে এক ঘণ্টার বৈঠক হয়েছে।
এ সময় তারা দুই দেশের মধ্যে বিরোধপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে কথা বলেছেন। এসব ইস্যুতে নিজ নিজ দেশের অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গিও পরস্পরের কাছে তুলে ধরেছেন। ফ্রান্সে ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যে বিরোধ চলছে, তা নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়।
বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর দফতর থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, ফ্রান্সে দীর্ঘদিন ধরে সরকারিভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার যে নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, তার সরকারও সেটাই করছে। কোনো ধর্মের প্রতি সরকারের কোনো বৈরী মনোভাব নেই। ইসলাম ধর্মের সাথে ফ্রান্সের কোনো বিরোধ নেই বলেও বিবৃতিতে বলা হয়েছে। এতে আরও উল্লেখ করা হয়, দুই নেতা লিবিয়া ও সিরিয়া ইস্যুতে একসাথে কাজ করতে সম্মত হয়েছেন। পরে এক টুইট বার্তায় ম্যাক্রোঁ বলেন, বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের মধ্যে গভীর মতবিরোধ রয়েছে। তবে মতবিরোধ যাই থাক না কেন, সম্মানজনক সম্পর্কের ভিত্তিতেই দুই দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায়। আমাদেরকে সব সময়ই আলোচনার মধ্যে থাকতে হবে। তুর্কি কর্মকর্তারা বলছেন, তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতি সফল হয়েছে, তারা ফ্রান্সকে তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে।
অপরদিকে ম্যাক্রোঁ জানিয়েছেন, লিবিয়ায় এ বছরের শেষের দিকে নতুন পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। এই নির্বাচন সফল করার জন্য লিবিয়া থেকে বিদেশি ভাড়াটে যোদ্ধাদের যত দ্রুত সম্ভব চলে যাওয়া উচিত। এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ভূমিকা রাখতে রাজী হয়েছেন বলেও ম্যাক্রোঁ দাবি করেন। তিনি বলেন, এই ভাড়াটে যোদ্ধাদের প্রত্যাহার নিশ্চিত করার ব্যাপারে কাজ করতে আমরা একমত হয়েছি। তবে বিষয়টি কেবল আমাদের দুজনের উপরই নির্ভর করেনা। এখানে আরো কিছু পক্ষও জড়িত রয়েছে। অন্যদিকে বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সাংবাদিকদের বলেছেন, তুরস্ক-ফ্রান্স সম্পর্কের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিক নিয়েই আলোচনার সুযোগ রয়েছে।
জেনারেল খলিফা হাফতারের বাহিনীর হামলার মুখে লিবিয়ার জিএনএ সরকারকে সামরিক সহায়তা দিয়ে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। জেনারেল হাফতারের বিরুদ্ধে তুরস্কের সামরিক সমর্থনের কারণেই ফ্রান্স লিবিয়ায় সফল হতে পারেনি। ফ্রান্স চেয়েছিল লিবিয়ায় প্রভাব বলয় বাড়িয়ে দেশটিতে নিজের নানা স্বার্থ হাসিল করা। কিন্তু তুরস্কের কারণে ফ্রান্সের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। পরে লিবিয়ায় জাতিসংঘের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সফল করতে দুই দেশই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে। এরপর মার্চ মাসে জাতিসংঘের উদ্যোগে গঠিত হয় জাতীয় ঐক্যের সরকার।
অন্যদিকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সমুদ্র সীমা নিয়ে তুরস্ক ও গ্রীসের মধ্যে বিরোধে ফ্রান্স যুদ্ধজাহাজ পাঠানোয় ক্ষুব্ধ হয় তুরস্ক। এতে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে ন্যাটো। কেননা ফ্রান্স ও তুরস্ক উভয়েই ন্যাটোর সদস্য। তাদের বিরোধ ন্যাটোতে বিভাজনের আশঙ্কা সৃষ্টি করে। পরে ২০২০ সালের জুলাই মাসে পূর্ব ভূমধ্যসাগর থেকে যুদ্ধজাহাজ প্রত্যাহার করে ফ্রান্স।
তুরস্কের বিষয়ে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক গবেষক সাইদ ইলহাজ মনে করেন, ‘সম্ভবত ফ্রান্স এটা অনুধারণ করতে পেরেছে, আঞ্চলিক সব ইস্যুতে তুরস্কের বিরোধিতা করা কিংবা প্রতিপক্ষকে সমর্থন দেয়া কার্যকর কোনো পথ নয়। এ পথ অনুসরণ করে তুরস্কের পররাষ্ট্র নীতিতেও পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না। ফ্রান্সের এই নীতি চরম ব্যর্থ হয়েছে।’ তিনি আরো মনে করেন, তুরস্কের উপর অবরোধ আরোপ করতে ফ্রান্স ইউরোপের অন্য কোনো দেশকেও রাজী করাতে পারেনি। বরং তুরস্কের পররাষ্ট্র নীতি ফ্রান্সকে তার অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে।
বর্তমানে ফ্রান্সের ব্যাপারে তুরস্কের দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলুর বক্তব্য থেকে। সম্প্রতি ফ্রান্স সফরে যাওয়ার আগে ফরাসি দৈনিক এল ওপিনিয়নে এক মতামত কলামে তিনি লিখেছেন, ‘তুরস্ক ও ফ্রান্স দুটি বন্ধুপ্রতীম ও মিত্র দেশ। এবং তারা সেভাবেই থাকবে।
গত জানুয়ারি মাসে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, ২০২১ সালে আঙ্কারা ইউরোপের সাথে তার সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করতে চায়। এর পর কেবল ফ্রান্সের সাথেই নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথেও তুরস্ক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্লেষক সাইদ ইলহাজ মনে করেন, জো বাইডেন গত জানুয়ারি মসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহনের পর তুরস্ক এটা অনুভব করেছে যে, তাদেরকে খাপ খাইয়ে চলার নীতি গ্রহন করতে হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তুরস্ক বুঝতে পেরেছে, ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে অনেকটাই মধ্যপন্থি নীতি অনুসরণ করে চলতে হবে। জো বাইডেন দায়িত্ব গ্রহনের পর তার প্রশাসন বেশ কিছু ঘটনা ও আচরণের মাধ্যমে তুরস্ককে এটা বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ব্যাপারে খুব একটা সন্তষ্ট নয়। এর পরই তুরস্ক আঞ্চলিক কয়েকটি দেশের সঙ্গে বিশেষ করে মিসর ও সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেয়।
২০২০ সালে তুরস্ক বেশ কয়েকটি সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল। এর মাধ্যমে অর্জিত সামরিক ও ভূরাজনৈতিক সাফল্যকে তুরস্ক তার রাজনৈতিক লাভে পরিণত করতে চেয়েছিল। এখন তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক অবরোধ এড়াতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন এই ব্লকের সাথে বাণিজ্যিক সমপর্ক জোরদার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আদর্শিক কিছু পার্থক্য তুরস্ক ও ফ্রান্সের মধ্যে বিরোধকে বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে তুরস্ককে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণের দিকে ঠেলে দেয়ার ফ্রান্সের চেষ্টা দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তুরস্ক ফ্রান্সের এ ধরনের আচরণের নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এটা স্পষ্টতই ফ্রান্সের ইসলামবিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।
তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার যে চেষ্টা করছে সেটা নিয়েও ফ্রান্সের সাথে তাদের বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে। ফ্রান্স দীর্ঘদিন ধরেই তুরস্কের ইইউ’র সদস্য পদ লাভের ঘোর বিরোধীতা করে আসছে। সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট ভ্যালেরি জিসকার্ড দেস্তা ২০০২ সালে বলেছিলেন, ‘তুরস্ক ইউরোপীয় কোনো দেশ নয়। এটি অন্য সংস্কৃতি ও অন্য জীবনধারার একটি দেশ।’ ২০১৭ সালে ইইউ’র প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে ফ্রান্স। এরপর ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বলেন, তুরস্কের ইইউ’র সদস্য রাষ্ট্র হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ফ্রান্সে ‘ইসলামি বিচ্ছিন্নতাবাদ’ বাড়ছে এমন অভিযোগ তুলে দেশটিতে বসবাসরত মুসলমানদের উপর নজরদারি করার নামে গ্রেফতার, হয়রানিসহ নানাভাবে হেনস্তা করা হতে থাকে। এই অভিযোগে ফ্রান্সের সব মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি খেলার ক্লাব গুলোতেও কর্তৃপক্ষের নজরদারি করার একটি বিল পাশ করে। ফ্রান্সের এ ধরনের আচরণের কঠোর সমালোচনা করে তুরস্ক। এমনকি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান একথাও বলেন, প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর মানসিক চিকিৎসা দরকার। ফলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। সর্ম্পকের চরম অবনতি ঘটে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন ব্রাসেলসে ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে ম্যাক্রোঁ-এরদোয়ান বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে তা বলা যাবেনা। এখনো বেশ কিছু ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে বড়ো ধরনের মতপার্থক্য রয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ বক্তব্য থেকে তার আভাস পাওয়া যায়। বৈঠকের পর তিনি বলেছেন, ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাপারে ফ্রান্সের অবস্থানের যে কঠোর সমালোচনা প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান করেছেন সে ব্যাপারে ফ্রান্সের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন ছিল। এ বিষয়ে তুর্কি প্রেসিডেন্টের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। অন্যথায় এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা থেকেই যাবে।
তুরস্ক সম্প্রতি অভিযোগ করেছে যে, ফ্রান্স লিবিয়াকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে ফ্রান্স বলেছ, তুরস্ক লিবিয়ায় বিপজ্জনক খেলায় মেতেছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে লিবিয়া নিয়ে তার বর্তমান কর্মকান্ড থেকে সরে আসারও আহ্বান জানায় ফ্রান্স।
এছাড়া সিরিয়া, লেবানন, উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা নিয়েও এখনও দুই দেশের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ভূরাজনৈতিক স্বার্থের এসব বিষয়ে মতপার্থক্য দূর এবং পারস্পরিক আস্থা বাড়ানোর পদক্ষেপ না নেওয়া পর্যন্ত তুরস্ক ও ফ্রান্সের মধ্যে সম্পর্কের খুব একটা উন্নতি হবে না বলেই বিশ্লেষকরা মনে করেন।