আফগানিস্তানের দিকে নজর চীনের


  • মোতালেব জামালী
  • ২৩ জুন ২০২১, ১৬:১৭

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহারের পর দেশটির ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে, তা নিয়ে নানা শঙ্কা বিরাজ করছে। পশ্চিমা দেশগুলোর সৈন্য প্রত্যাহার শুরু হওয়ার পর থেকেই তালেবানের হামলা বেড়ে গেছে। দেশটির বর্তমান সরকার এবং তালেবান ও অন্য বিরোধীদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের লক্ষ্যে শান্তি আলোচনা শুরু হলেও তা সফল হবে কিনা তা নিশ্চিত নয়। এমন পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানের দিকে সর্তক দৃষ্টি রাখছে চীন। আফগানিস্তানের কৌশলগত অবস্থানের কারণে চীন দেশটিতে নানাভাবে সম্পৃক্ত হচ্ছে।

আফগানিস্তানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সার্বিক সমর্থন অপরিহার্য। বিশেষ করে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর। আফগানিস্তানে যেসব দেশের কৌশলগত, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থ জড়িত রয়েছে, সেসব দেশের সমর্থন খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে প্রতিবেশী পাকিস্তানের ভূমিকা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, পাকিস্তানের সমর্থন ছাড়া আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা কখনও সম্ভব হবে না। বিগত কয়েক বছরে দেখা গেছে, পাকিস্তানের সবচেয়ে বিশ^স্ত মিত্র চীন আফগানিস্তানে তার কর্মকাণ্ডের পরিধি বাড়াতে খুবই আগ্রহী। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার পর চীনের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়।

২০২০ সালের এপ্রিল মাসে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল, তা থেকেই আফগানিস্তানের ব্যাপারে দেশটির সরকারি অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠে। এই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল যে, ‘নিজেদের দেশের উন্নয়নের ব্যাপারে আফগানিস্তানের জনগণের যে কোনো পথ বেছে নেওয়ার ইচ্ছার প্রতি চীন সব সময়ই শ্রদ্ধাশীল। দেশটিতে শান্তি ও সমঝোতার প্রক্রিয়ায় সমর্থন দিতে বা প্রয়োজনে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত রয়েছে। চীন আফগানিস্তানে সব সময়ই গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে চায়।’ একদিকে বেইজিংয়ের ভূরাজনৈতিক কৌশলের বাস্তবায়ন, অন্যদিকে তাদের জ¦ালানি চাহিদা পূরণের জন্যও আফগানিস্তানে চীনের জোরালো উপস্থিতি নিশ্চিত করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীন অন্তত চারটি কারণে আফগানিস্তানে শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করতে চায়। এগুলোর মধ্যে আছে, আফগানিস্তানের সাথে নিজের সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। দেশটি থেকে যাতে কোনো সশস্ত্র উগ্রপন্থী গ্রুপের সদস্যরা জিনজিয়াং-এর উইঘুর মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশে প্রবেশ করতে না পারে। দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানের বিভিন্ন খনিজ সম্পদ চীনের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। চীন এগুলোর ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তৃতীয়ত, চীনের সড়ক যোগাযোগের নেটওয়ার্ক বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআইকে আফগানিস্তানে সম্প্রসারণ করা। এই কানেক্টিভিটি নেটওয়ার্ককে এখান থেকে মধ্য এশিয়ায় নিয়ে যাওয়া। চতুর্থত, আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্য সামনে রেখেও আফগানিস্তানে প্রবেশ করতে চায় চীন।

আফগানিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে চীন খুবই উদ্বিগ্ন। দেশটি কোনো ভাবেই চায় না দক্ষিণ-মধ্য এশিয়ার উগ্রপন্থী গ্রুপ আফগানিস্তানে এসে ঘাটি গাড়ুক। বেইজিং মনে করে এসব গ্রুপ আফগানিস্তানে ঘাটি গাড়তে পারলে এরপর তারা চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।

আফগানিস্তানের ব্যাপারে চীনের প্রথম আগ্রহ দেখা যায় ২০১৪ সালে। এ বছর চীন তার পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের আওতায় প্রথম বারের মতো আফগানিস্তান বিষয়ক একজন বিশেষ দূত নিয়োগ করে। এরপর ২০১৫ সালে আফগান শাািন্ত প্রক্রিয়ায় তালেবানকে জড়িত করার ব্যাপারে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দেয় বেইজিং। পরে তারা ‘পীস এন্ড রিকনসিলিয়েশন ফোরাম’-এর ব্যানারে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও তালেবানের প্রতিনিধি নিয়ে আলোচনা শুরুর উদ্যোগ নেয়।

চীন তার পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর মুসলমানদের মধ্যে স্বাধীনতাকামী চেতনা ও মনোভাব ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠায় খুবই শঙ্কার মধ্যে আছে। এই প্রদেশটি পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির ও আফগানিস্তান সীমান্তের সাথে অবস্থিত। আফগানিস্তানে যদি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বেড়ে যায় তাহলে তার ঢেউ জিনজিয়াং এ গিয়ে লাগতে বলে চীন আশঙ্কা করছে। এছাড়া আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকলে তার বিরূপ প্রভাব এই অঞ্চলে চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভেও পড়তে পারে বলে চীনের আশঙ্কা।

চীনের জন্য আরেকটি বড় নিরাপত্তা উদ্বেগ হচ্ছে আফগানিস্তান থেকে মাদক পাচার। দেশটি মনে করে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ইরান থেকে মাদক পাচার হয়ে চীনে প্রবেশ করে থাকে। মাদক পাচারের এই রুট কিভাবে বন্ধ করা যায় তা নিয়েও ভাবছে বেইজিং।

চীন তার অর্থনৈতিক কানেক্টিভিটি নেটওয়ার্ক চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরে আফগানিস্তানকে যুক্ত বিষয় নিয়েও আলোচনা শুরু করেছে। এতে সিপিইসিকে রেলওয়ের মধ্যমে কান্দাহারের সাথে যুক্ত করার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়েছে। এছাড়া কাবুল ও পেশোয়ারের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ চালু করা যায় কিনা তা নিয়েও আলোচনা করা হচ্ছে।

আফগানিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর চীনা কোম্পানীগুলোর বিশেষ নজর রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে যে, এসব প্রাকৃতিক সম্পদের মূল্য এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে। ২০০৭ সালে চীনের দুটি সরকারি কোম্পানি চায়না মেটালুরজিক্যাল গ্রুপ কোম্পানী ও জিয়াংজি কপার কোম্পানী রিমিটেডের সাথে আফগান সরকারের ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের ৩০ বছর মেয়াদি লীজ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানী দুটি আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত আয়নাক তামা খনি থেকে তামা উত্তোলন করবে। বিশে^র দ্বিতীয় বৃহত্তম তামার মজুদ রয়েছে এই খনিটিতে।

২০১১ সালে চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে আফগানিস্তানের আমু দরিয়া অববাহিকায় তিনটি ব্লক ইজারা দেয়া হয় তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য। কিন্তু নিরাপত্তা জনিত, রাজনৈতিক ও প্রক্রিয়াগত প্রতিবন্ধকতার কারণে গত এক দশকেও এই প্রকল্পে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

বেইজিং আফগানিস্তানকে সামরিক সহযোগিতা দেয়ার প্রস্তাব নিয়ে খুবই সক্রিয় রয়েছে। ২০১৬-২০১৮ সালের মধ্যে চীন আফগান সরকারকে সামরিক খাতে ৭ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। বেইজিং আফগানিস্তানের উত্তাঞ্চলীয় বাদাখশান প্রদেশের কাছে ওয়াখান করিডোরে আফগান সেনাবাহিনীর একটি মাউন্টেন ব্রিগেড গঠনে সহায়তা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতো আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালানো কিংবা দেশটির সাথে যুদ্ধ করার কোন ইতিহাস চীনের নেই। বরং গত ৫ বছরে চীন আফগানিস্তানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে। সেই সহায়তা আস্তে আস্তে নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ ও করোনা ভাইরাস মহামারির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সম্প্রসারি হয়েছে।

চীন তার বিআরআই প্রকল্পের মাধ্যমে আফগানিস্তানকে তার প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে কানেক্টিভিটি নেটওয়াকে যুক্ত হতে সহায়তা করছে। বর্তমানে আফগানিস্তানে পাকিস্তানের পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে চীন বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। করোনা ভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যেও চীন আফগানিস্তানের অবকাঠামো পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

পাকিস্তানের সাথে চীনের গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কারণে আফগানিস্তানে কাজ করা চীনের জন্য খুবই সহজ হবে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। পাকিস্তানের পাশাপাশি আফগানিস্তানের অন্য প্রতিবেশি দেশগুলো বিশেষ করে মধ্য এশিয়া ও ইরানে চীনের উপস্থিতি রয়েছে। এটাও চীনের জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে।

আগামী দিনগুলোতে চীন আফগানিস্তানের অবকাঠামো পুননির্মানে ব্যাপক বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশটিতে তার অবস্থান আরো সংহত করার চেষ্টা করবে। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে এই বিনিয়োগ যাতে হুমকির মুখে না পড়ে সে চেষ্টাও করবে বেইজিং। এ কারণে দেশটি একা সবকিছু না করে ইরান ও পাকিস্তানসহ তার মিত্র দেশ গুলোকে সাথে নিয়ে কাজ করতে পারে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, চীন আফগানিস্তানকে সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা যদি কার্যকর হয়, তাহলে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে চীনের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের পথ প্রশস্ত হতে পারে। সেই লক্ষ্য সামনে নিয়েই চীন ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও যা অর্জন করতে পারেনি, চীন তা অর্জন করতে পারে। চীন আফগানিস্তানে কিভাবে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।