ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন দেশটির প্রধান বিচারপতি সাইয়েদ ইবরাহিম রাইসি। তিনি কট্টর ডানপন্থী ও দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশটিতে মোট নিবন্ধিত ভোটার পাঁচ কোটি ৯৩ লাখ ১০ হাজার ৩০৭ জন। এর মধ্যে ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ বা দুই কোটি ৮৯ লাখ ৩৩ হাজার ভোটার নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। এটা দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে সর্বনিম্ন ভোটারের অংশগ্রহণের রেকর্ড।
অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতি, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিধি-নিষেধ, করোনা মহামারি ও জনপ্রিয় কয়েকজন প্রার্থীকে বাদ দেওয়ায় ইরানের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হবে বলে আগেই আশঙ্কা করা হয়েছিল। বাস্তবেও তাই ঘটেছে। এর আগে ১৯৯৩ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ছিল সর্বনিম্ন। ওই নির্বাচনে মোট ভোটারের মধ্যে ৫০ দশমিক ৬৬ শতাংশ ভোট দেন।
এবারের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার তার চেয়েও কম হয়েছে। কারণ, রাইসি যে নির্বাচনে বিজয়ী হবেন, তা আগেই ইরানিরা বুঝতে পেরেছিলেন। তাকে বিজয়ী করার জন্য বেশ কয়েকজন জনপ্রিয় প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া, নির্বাচনের কয়েকদিন আগে দুই রক্ষণশীল প্রার্থী সাইদ জলিলি ও আলীরেজা জাকানি রাইসির সমর্থনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। ফলে রাইসির বিজয় নির্বাচনের অনেক আগেই নিশ্চিত হয়ে যায়। অনেক ভোটার অভিযোগ করেছেন, ইরানকে একদলীয় ব্যবস্থার দিকেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
গণতান্ত্রিক নির্বাচনের নামে এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ জানাতে অর্ধেকেরও বেশি ভোটার নির্বাচন বর্জন করেছেন। আবার যারা ভোট দিতে এসেছেন, তাদের অনেকেই সাদা ব্যালট পেপার বাক্সে দিয়ে গেছেন। আবার কেউ ব্যালট পেপার নষ্ট করে গেছেন। এ কারণে ৩৭ লাখ ভোট বাতিল হয়েছে।
রাইসি একটি পরিশ্রমী, বিপ্লবী ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর দেওয়া প্রথম প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ কথা জানান। এক বিবৃতিতে জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমার প্রতি আপনারা যে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন, তার ভিত্তিতে আমি পরিশ্রমী, বিপ্লবী ও দুর্নীতিবিরোধী প্রশাসন গড়ে তুলব। আমি সারা জাতির প্রেসিডেন্ট। কেউ আমাকে ভোট দিক বা না দিক, আমি প্রজাতন্ত্রের জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করব।
রাষ্ট্র পরিচালনা এবং পররাষ্ট্র নীতির বিষয়ে রাইসির তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তার সরকারের পররাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক নীতি কেমন হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। নির্বাচনে বিজয়ের পর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠকের ব্যাপারে তার আগ্রহ নেই। এছাড়া ইরানের মিসাইল কর্মসূচী নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। এরমধ্য দিয়ে তিনি কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। রায়সি তার পুরো ক্যারিয়ারই বিচার বিভাগে কাটিয়েছেন। ২০১৯ সালের মার্চ থেকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ভবিষ্যতে তিনি বর্তমান সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির স্থলাভিষিক্ত হবেন বলেও অনেক ইরানীর ধারণা। ৮২ বছর বয়স্ক খামেনি গত ৩২ বছর ধরে এই পদে রয়েছেন।
ইরানের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে রাইসির উত্থান পশ্চিমা বিশ্বের সাথে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দেশটির ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে রাইসি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব সম্পর্কে নানা ধরণের নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানী ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে গত ৮ বছর ধরে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রাইসির আমলে তা উল্টে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২০২০ সালের জনুয়ারি মাসে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কুদস ফোর্সের কমান্ডার কাসেম সোলাইমানিকে ইরাকে বিমনবন্দরে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র। এ ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে রাইসি বলেন, এটা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদেরই একটি স্পষ্ট উদাহরণ। তিনি আরো বলেন, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি নিরাপত্তাহীনতা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং স্থিতিশীলতা নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই উপহার দেবেনা। বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে রাইসি ইরানের শত শত মানুষকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান ও তা কার্যকর করেছেন। এ করণে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার লংঘণের অভিযোগে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
রাইসি ২০১৮ সালে ৭ জন শিশু আসামীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করায় যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সালের নভেম্বরে রাইসিকে কালো তালিকাভূক্ত করে। এছাড়াও আরো অন্তত ৯০ জন শিশু আসামীকে মৃত্যুদণ্ড দেন তিনি। পাশাপাশি তিনি ইরানের ৭ জন বিশিষ্ট মানবাধিকার আইনজীবীকেও কারাদণ্ড প্রদান করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব ফরেন এসেটস কন্ট্রোল দাবি করেছে, ১৯৮৮ সালে বিচারকদের যে প্যানেল ৫ হাজার বন্দির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিষয়টি অনুমোদন করেছিল, সেই প্যানেলের সদস্য ছিলেন রাইসি। রাইসি কখনোই তার বিরদ্ধে উত্থাপিত মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তার নেতৃত্বাধীন বিচার বিভাগ আসামীদের বিরুদ্ধে কঠোর সাজা প্রদান ও যখন-তখন মৃত্যুদণ্ড প্রদানের জন্য ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল। ২০২০ সালে ইরানে ২৪৬ জনের বেশি আসামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ করেছে, দেশটিতে রাজনৈতিক নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাইসি ২০০৪ সালে থেকে ২০১৪ সালে পর্যন্ত ইরানের ফার্স্ট ভাইস চীফ জাস্টিস ছিলেন। ২০০৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়া নিশ্চিত করতে ব্যাপক কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগ উঠে। সারাদেশে গড়ে উঠে প্রবল আন্দোলন। গ্রিন মুভমেন্ট নামে পরিচিত সেই আন্দোলন নির্মূল করতে ব্যাপক দমন অভিযান চালানো হয়। এই দমন অভিযানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অন্যতম ছিলেন রাইসি।
রাইসির বিজয়ে পশ্চিমা বিশ্ব নীরব রয়েছে। যদিও প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে তাকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা উচিত। সংস্থাটির মহাসচিব অ্যাগনেস কালামার্ড এক বিবৃতিতে বলেছেন, হত্যা, গুম ও নির্যাতন করাসহ মানবতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধ করেও পার পেয়ে গেছেন রাইসি। এখন তিনি ইরানের প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন। এটা থেকে এই বার্তাই পাওয়া যায় যে, ইরানে অপরাধীরাই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারি। এ ধরনের বিবৃতিকে অনেক বিশ্লেষক পশ্চিমা দেশগুলোর ইরানের ওপর চাপ প্রয়োহের কৌশলের অংশ হিসাবে দেখে থাকেন।
অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ২০১৮ সালে ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে দেশটির অর্থনীতি মারাত্মক চাপের মধ্যে পড়ে। জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর ইরানের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের সেই নীতি থেকে কিছুটা সরে আসে। কিন্তু রাইসির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের যে সব অভিযোগ তোলা হচ্ছে তা আমলে নিতে পারেন জো বাইডেন। ফলে রাইসির আমলে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সংলাপ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
স্পেনের বার্সেলোনার পম্পেও ফাবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সোহাইল জানেসারি মনে করেন, রাইসি আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের কালো তালিকাভূক্ত আছেন। এখন মানবাধিকার গ্রুপগুলো তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি অনুরোধ জানাতে পারে। ফলে রাইসি কখনোই পশ্চিমা বিশ্বের কোনো দেশ সফর করতে পারবেন না।
ইরানের কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রাইসির সাথে কাজ করতে চাইবে। অতীতেও ইরানের কয়েকজন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযাগ আনা হয়েছিল। তারপরও তাদের সাথে কাজ করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। রাইসির সাথেও তারা একই ভাবে কাজ করবে। অন্যদিকে রাইসিও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহনের পর এমন কোনো কাজ করবেন না যাতে তার দেশের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমাদের সাথে সংলাপে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট অ্যান্টনি কলেজের শিক্ষক তালাল মাহমুদ মনে করেন, রাইসির প্রশাসন ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে যেমন আপোষ করবে না, তেমনি হামাস ও হিজবুল্লার মতো সংগঠনগুলোকে সহায়তা দেয়াও বন্ধ করবে না। এছাড়া সিরিয়ার বাশর আল আসাদ ও ভেনিজুয়েলার মতো বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোকেও নানাভাবে সহায়তা দিয়ে যাবে।
ইতোমধ্যে রাইসির বিজয়ের পর ইসরায়েল উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। অপরদিকে এ অঞ্চলের প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো তার বিজয়কে স্বাগত জানিয়েছে। রাইসির বিজয় শুধু ইরান বিরোধিতা নয় এ অঞ্চলের রাজনীতিতে যে পরিবর্তন আসছে সেদিকে মনোযোগ দিতে বাধ্য করবে। বিশেষ করে ইসরায়েলের আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বকে নতুন করে ভাবতে হবে। নীরবে এ অঞ্চলে ইসরায়েল বিরোধী মেরুকরন ঘটতে যাচ্ছে। এছাড়া মনে রাখতে হবে, সবকিছুই নির্ধারণ করার ক্ষমতা ইরানের প্রেসিডেন্টের হাতে থাকেনা। দেশটিতে ক্ষমতার আরো কিছু কেন্দ্র রয়েছে। তারাও অনেক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে।
রাইসি কোন পথে হাটবেন, ইরানকে কোন পথে নিয়ে যাবেন, তা বলার চূড়ান্ত সময় এখনও আসেনি। এজন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাহীন ব্যক্তি হয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন তার জন্য একটি বড় পরীক্ষা। এছাড়া আগামীতে শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির স্থলাভিষিক্ত হতে গেলে তাকে অনেক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। অনেক পরীক্ষায় উৎরে যেতে হবে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন রাইসির পরীক্ষার একটি বড় ধাপ। আগে এই পরীক্ষায় তাকে পাশ করতে হবে। এজন্য তাকে তার অনেক সহযোগীর ওপর নির্ভরশীল হতে হবে।