চীন যেভাবে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াল


  • মোতালেব জামালী
  • ২৪ মে ২০২১, ১৪:৩১

ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে এবারের সঙ্ঘাতে চীন বেশ কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে। দুই পক্ষের সাথেই চীনের সুসম্পর্ক রয়েছে। কীভাবে দেশটি দুই পক্ষের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে, সেটাই বেইজিংয়ের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এরপরও এবার ফিলিস্তিন প্রশ্নে চীনের অবস্থানের কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। মধ্যপ্রাচ্যে চীন কার্যকর ভূমিকা নিয়ে সামনে আসতে যাচ্ছে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

চলতি মে মাসে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে চীন। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্টেট কাউন্সিলর ওয়াং ই গত ১৬ মে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের ওপর নিরাপত্তা পরিষদে এক উন্মুক্ত বিতর্কে সভাপতিত্ব করেন। এর পরদিন চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওয়াং ই সঙ্ঘাতের গুরুত্ব বিবেচনা করে চার দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। এতে অস্ত্রবিরতি ও সহিংসতার অবসানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ইসরায়েলকে অবিলম্বে আত্মসংবরণ করার ও বৈরী আচরণ বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।’

এই বিবৃতিতে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা খুবই সুক্ষ্ম হতে পারে। কিন্তু বক্তব্য খুবই পরিষ্কার। ‘বিশেষ করে ইসরায়েল’ কথাটি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। ওয়াং ই তার প্রস্তাবে স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘ইসরায়েলের আত্মসংবরণ করা উচিত এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, হুমকি ও উস্কানিমূলক আচরণ বন্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে জেরুসালেমে পবিত্র স্থানগুলোর ওপর স্থিতাবস্থা বজায় রাখা ও এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে।’

চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রস্তাবে পরস্পরের বিরুদ্ধে সহিংসতার জন্য ‘সব পক্ষই’ দোষী বলা হলেও এখানে স্পষ্ট করেই ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীনের এই বক্তব্যে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। জাতিসংঘে চীনের রাষ্ট্রদূত ঝাং জুন গত বছর জুলাই মাসে নিরাপত্তা পরিষদে দেওয়া বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘চীন হচ্ছে ফিলিস্তিনি জনগণের আন্তরিক বন্ধু। ফিলিস্তিনি জনগণ তাদের ন্যায্য ও বৈধ জাতীয় অধিকারের প্রতি সব সময়ই চীনের সমর্থন পাবে।

১৯৯২ সালে ইসরায়েল ও চীনের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ওই সময় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি মার্কিন ডলারের মতো। বর্তমানে দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ১১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। দুই দেশের সম্পর্ক কেবল বাণিজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। চীন ইসরায়েলে প্রযুক্তি খাতে কয়েকশ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।

বেইজিংয়ের সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামো নেটওয়ার্ক ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই এর অংশ হিসেবে ইসরায়েলের অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পেও বিপুল বিনিয়োগ করেছে। চীনা মূল ভূখণ্ডের বিশ^বিদ্যালয় গুলোতে ইসরায়েলি শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া করা বর্তমানে একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে প্রতি বছর দেড় লাখেরও বেশি চীনা পর্যটক ইসরায়েল ভ্রমন করে থাকেন।

দুই দেশের এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাঝেও ভূরাজনীতির নানা সমীকরণের কারণে চীন প্রতি বছরই জাতিসংঘে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে থাকে। ইরান ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠি হামাস ও ইসলামিক জিহাদকে সমর্থন দিয়ে থাকে এবং ইসরায়েলের ধ্বংস চায়। এ কারণে ইরানের প্রতি চীনের সমর্থন বন্ধ করতে ইসরায়েল অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু এতে কোনো কাজ হয়নি। ইরানের প্রতি চীনের সমর্থন অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি দেশ দুটি ২৫ বছর মেয়াদি কৌশলগত চুক্তিও করেছে যা দেশ দুটির সম্পর্ককে আরো জোরদার করেছে।

ইসরায়েল বার বার চেয়েছে চীন হামাসকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভূক্ত করুক। কিন্তু এতে সায় মেলেনি বেইজিংয়ের। দেশটি তা করতে অস্বীকার করেছে। হামাস ২০০৭ সালে গাজা ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার পর চীন হামাসকে একবার ‘ফিলিস্তিনি জনগণের পছন্দের প্রতিনিধি’ হিসেবেও অভিহিত করেছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং ই জোর দিয়েই বার বার একথা বলেছেন যে, ‘ফিলিস্তিনি ইস্যুটিই সব সময়ই মধ্যপ্রচ্যের সব সমস্যার উপরে স্থান পাবে।

২০১১ সালের আরব বসন্ত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নানা ধরণের অভ্যন্তরীন ও রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি করেছে। এসব দেশের কাছে ফিলিস্তিন ইস্যুর চেয়ে নিজ দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা বেশি জরুরি হয়ে পড়ে। নানা কারণেই ফিলিস্তিন ইস্যু আরব দেশ গুলোর কাছে গৌণ হয়ে পড়েছে। চীন এবারের ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সঙ্ঘাতের বিষয়টি লুফে নিয়ে তার দীর্ঘ দিনের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে এবারও বলছে যে, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সঙ্ঘাতই ঐ অঞ্চলের নানা সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের ব্যাপারে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক চীনের ইতিহাসের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। ১৯৫০ এর দশকে ইসরায়েলই হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রথম দেশ যেটি গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে স্বীকৃতি প্রদান করে। কিন্তু এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীন ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান করা থেকে বিরত থাকে। ঐ সময়ে চীনা কমিউনিষ্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সে তুং ‘সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা শক্তি’র বিরুদ্ধে চীনের ‘ইউনাইটেড ফ্রন্টে’ আরব ও মুসলিম দেশগুলোকে টানার চেষ্টা করেন। এ কারণেই চীন ফিলিস্তিন ইস্যুর প্রতি সহানুভূতিশীল হয় এবং ইসরায়েলের সমালোচনা করতে থাকে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চীনের মতানৈক্য এবং ১৯৭২ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে প্রাথমিক যোগাযোগ শুরুর পথ উন্মুক্ত হয়। এ সময়ে ইসরায়েল তার আরব প্রতিবেশিদের বিরুদ্ধে কয়েকটি যুদ্ধে বিজয়ী হয়। তাদের কাছ থেকে দখল করা সোভিয়েত নির্মিত কিছু অস্ত্র ব্যবস্থা বিক্রির চেষ্টা চালায়। চীন আগে থেকেই সোভিয়েত নির্মিত অস্ত্র কিনছিল। এ কারণে দেশটি ইসরায়েলের অস্ত্র কেনার প্রধান ক্রেতায় পরিণত হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এসব অস্ত্র বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের চীন-ইসরায়েল সম্পর্কে মৌলিক পরিবর্তন আসে। এক বছর পর চীন ইসরায়েলের সাথে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এসময় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ইসরায়েলের সাথে আরব দেশগুলো ও ফিলিস্তিনিদের শান্তি আলোচনা শুরু হয়। এতে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে চীনকে আরো উৎসাহিত করে। পর্যায়ক্রমে তা গভীর হতে থাকে। তবে সম্পর্ক জোরদার হলেও চীন ইসরায়েলের ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের ব্যাপারে বেইজিংয়ের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি।

চীনের জ¦ালানি চাহিদার অর্ধেকেরও বেশি আসে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো থেকে। এসব দেশের বেশ কয়েকটি আবার চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উইঘুর মুসলিমদের ব্যাপারে দেশটির রাষ্ট্রীয় নীতিকে সমর্থন করে থাকে। এটিও চীনের ফিলিস্তিন ইস্যুকে সমর্থন দেয়ার কারণ।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারের দ্বন্দ্ব ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতেও প্রভাব ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলকে সমর্থন দেয়ার নীতির বিপক্ষে চীন অবস্থান নেবে এটাই স্বাভাবিক। সেকারণেই দেশটি ফিলিস্তিনের পক্ষে।

জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে ফিলিস্তিন সংক্রান্ত চীনের যে কোনো প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়ে থাকে। সম্প্রতি চীনের সরকারি গণমাধ্যম সিজিটিএন এর একজন ভাষ্যকার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে শক্তিশালী ইহুদি লবি মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে দেশটির নীতিকে প্রায় সময় প্রভাবিত করে থাকে। ইহুদিরাই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি, মিডিয়া ও ইন্টারনেট সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এর প্রতিবাদ জানিয়ে ইসরায়েলি দুতাবাসের পক্ষ থেকে টুইট করে বলা হয়েছে, চীনের সরকারি মিডিয়ায় সব সময়ই ইহুদি বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালানো হয়ে থাকে। এগুলো বর্ণবাদী প্রচারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। চীনের সরকারি মিডিয়ার উচিত এ ধরণের প্রচারণা পরিহার করা। বাস্তবতা হচ্ছে, চীন এসব প্রতিবাদে কোনো কান দেয় না। তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের করণীয় কাজটি ঠিকই করে যায়।

মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে চীনের নীতি হচ্ছে সবাই তাদের বন্ধু। কিন্তু ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের এবারের সঙ্ঘাত বেইজিংকে একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিলেও চীন তার অবস্থানের কোনো পরিবর্তন করেনি। ফিলিস্তিনিদের পাশে দাড়িয়েছে চীন। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন চীন ও ইরানের মধ্যে কৌশলগত সর্ম্পক যেভাবে ঘনিষ্ট হচ্ছে তাতে ফিলিস্তিন ইস্যুতে চীন আরো বেশি সক্রিয় ভুমিকা নিতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে চীনের শক্ত অবস্থান জানান দেওয়ার জন্য তা জরুরি।