জিনজিয়াং থেকে গাজা : আমেরিকার ভণ্ডামি


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২৪ মে ২০২১, ১৪:১৫

জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীন সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে খুবই সোচ্চার যুক্তরাষ্ট্র। মনে হবে, উইঘুর মুসলিমদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দরদের যেন শেষ নেই। কিন্তু সেই যুক্তরাষ্ট্রই আবার ফিলিস্তিনের গাজায় ইহুদিবাদী ইসরাইলের গণহত্যার পক্ষে অবস্থান নেয় প্রকাশ্যে।

আমেরিকার অর্থ ও অস্ত্রে যখন গাজায় ইসরাইলের বর্বরতা চলছে, নিহত হচ্ছে নারী ও শিশুরা, যুক্তরাষ্ট্র তখন হামলার নিন্দা করার পরিবর্তে দৃঢ় সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ঠিক একই সময় আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা ঘটিয়েছেন আমেরিকার আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক দপ্তরের প্রধান ড্যানিয়েল নাদেল। তিনি বলেছেন, পুরো জিনজিয়াং অঞ্চলটিকে একটি উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত করেছে চীন সরকার।

অসহায় উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীন সরকার যে ভয়াবহ নিপীড়ন চালাচ্ছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, দশ লাখেরও বেশি উইঘুর মুসলিমকে চীন সরকার জিনজিয়াং প্রদেশের বন্দিশালায় আটক রেখে নিপীড়ন করে আসছে। সেখানে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, নির্যাতন, বন্ধ্যাকরণ, বাধ্যতামূলক শ্রম ও জাতিগত নিধনের অভিযোগ আছে।

যুক্তরাষ্ট্র এসব অভিযোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি উচ্চকণ্ঠ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকার উইঘুরদের ওপর নিপীড়নকে গণহত্যা বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। চীনের বিরুদ্ধে কিছু নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার তার পশ্চিমা মিত্র যুক্তরাজ্য, কানাডা ও নেদারল্যান্ডসও একে গণহত্যা বলেছে।

অথচ জিনজিয়াংয়ের চেয়েও করুণ পরিস্থিতি ফিলিস্তিনে। গাজার ২০ লাখ মানুষকে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে অবরুদ্ধ করে রেখেছে ইসরাইল। আক্ষরিক অর্থেই গাজা একটি উন্মুক্ত কারাগার। সেখানে খাবার নেই, চিকিৎসা নেই। তরুণরা বেকার। বিদ্যুত থাকে না গাজায়। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কখনো ইসরাইলের সমালোচনা করে না। বরং ইসরাইলকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে থাকে। সম্প্রতি গাজায় ইসরাইলি হামলার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব উঠলে ১৫ সদস্যের মধ্যে ১৪টি দেশ তাতে সম্মতি দেয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণে প্রস্তাবটি পাস হয়নি।

১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে ইহুদিবাদী দেশটি। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইসরাইলের বিরুদ্ধে তদন্তের উদ্যোগ নিলে তাতে বাধা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ উইঘুরদের বিরুদ্ধে চীনের নিপীড়ন নিয়ে যুদ্ধংদেহী মনোভাব যুকরাষ্ট্রের। সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমারা এ ইস্যুতে অনেকটা সরব হয়ে উঠেছেন। তবে তাদের ভূমিকা কী মানবাধিকারের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের প্রতিফলন নাকি এটা ভূরাজনৈতিক খেলার অংশ, সেসব প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

বাইডেন প্রশাসন জিনজিয়াং এখন কিছুটা প্রতীকি পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে চীনের জিনজিয়াং নীতিকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছিলেন। ট্রাম্পের সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বল্টন তার বইতে লিখেছেন, যে ট্রাম্প জিনপিংকে বলেছিলেন, জিনিজয়াংয়ে বন্দিশিবির তৈরি সঠিক পদক্ষেপ।

বস্তুত জিনজিয়াং নিয়ে পশ্চিমাদের কোনো সমন্বিত নীতি নেই। চীনের ক্রমবর্ধমান উত্থান ঠেকাতে তারা বিভিন্ন সময় নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। জিনজিয়াং নিয়ে তাদের পদক্ষেপও এই আলোকেই দেখতে হবে। চীনকে কোণঠাসা রাখাই তাদের উদ্দেশ্য। উইঘুরদের নিয়ে পাশ্চাত্যের আসলে কোনো মাথাব্যথা নেই।

লন্ডনভিত্তিক রাজনৈতিক ভাষ্যকার ফিওনা সিম মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ডা ক্রিস্ট্যাল ক্লিয়ার। নৈতিকতাবোধ থেকে যুক্তরাষ্ট্র উইঘুরদের পক্ষে দাঁড়াচ্ছে না। মানবাধিকারও তাদের মনের ব্যথা নয়। যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে দ্রুত উদীয়মান চীন যাতে তাদের একাধিপত্য খর্ব করতে না পারে।

এদিকে ইসরাইলি আগ্রাসনে যখন গাজার শিশুসহ নিরাপরাধ অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে তখন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভূমিকা নিজ দেশে এবং সারা বিশে^ সমালোচিত হচ্ছে। তিনি ইসরাইলি যুদ্ধবাজ নেতা নেতানিয়াহুকে ফোন করে হামলায় সমর্থন দিয়েছেন। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে ফোন করে হামলা থামাতে বলেছেন।

ফিলিস্তিনি হামলা বলতে শুধু রকেট ছোড়া। তাতে ইসরাইলিদের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয় না। কিন্তু ইসরাইলি হামলায় গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। অথচ বাইডেনের সব মাথাব্যথা ফিলিস্তিনি হামলা নিয়ে। তবে এবার বাইডেন আর দলের অকুণ্ঠ সমর্থন পাচ্ছেন না। নিজ দলের আইনপ্রণেতারাই পার্লামেন্টে বাইডেনের কঠোর সমালোচনা করেছেন। এটা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কিছুটা অভিনব ঘটনাই বটে।

ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বামপন্থি উদারনৈতিক সদস্যরা বাইডেনের মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। ইসরাইলের ওপর আরও চাপ সৃষ্টির দাবিও জানাচ্ছেন তারা। উদারনৈতিক ডেমোক্র্যাটরা এখন চান যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে ন্যায়বিচারের প্রতিফলন ঘটুক।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন আমেরিকার পুরোনো ফরমূলার পুনরাবৃত্তি করে বলেছেন, ফিলিস্তিনের রকেট হামলার জবাবে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। হামাসের রকেটের জবাবে ইসরাইলকে এখন পর্যন্ত বাড়াবাড়ি রকমের কিছু করতে দেখেননি বলেও বাইডেন মন্তব্য করেছেন। তার এই অবস্থানের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে সরব হন উদারনৈতিক ডেমোক্র্যাটরা।

ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে বলে বাইডেন যে মন্তব্য করেছেন তার সমালোচনা করে নিউ ইয়র্কের ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি অ্যালেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ ক্ষুব্ধ এক ভাষণে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের কি বাঁচার অধিকার আছে? আমরা কি সেটা বিশ^াস করি? এজন্য আমাদের কি কোনো দায় নেই? বাইডেন প্রশাসন যদি এক মিত্রকেই রুখে দাঁড়াতে না পারে তাহলে কার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবে? তারা তাহলে কিভাবে মানবাধিকারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার দাবি করে?

মিশিগানের ডেমোক্র্যাটিক প্রতিনিধি রাশিদা তালিব গাজায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ভবনে হামলার প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ইসরাইল গণমাধ্যমকে হামলার নিশানা করছে, যাতে বর্ণবাদের হোতা নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে চলমান যুদ্ধাপরাধ বিশ্ব দেখতে না পায়। রাশিদা যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত একমাত্র কংগ্রেস সদস্য।

বাইডেন প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা শোনা গেছে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন প্রত্যাশী সিনেটর বার্নি স্যান্ডারসের কণ্ঠেও। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুরও কড়া সমালোচনা করেছেন তিনি।

নিউইয়র্ক টাইমসে এক নিবন্ধে স্যান্ডার্স লিখেছেন, ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় আমলেই আমাদের শুনতে হয় যে আত্মরক্ষার অধিকার ইসরাইলের আছে। গাজা থেকে রকেট হামলার জবাবে বিশাল সামরিক শক্তির অধিকারী ইসরাইলের হামলা নিয়ে আমাদের এ ধরনের কথা শুনতে হচ্ছে। অবশ্যই ইসরাইল বা অন্য যে কোনো দেশের সরকারের অধিকার আছে নিজ জনগণের রক্ষার। তো তারপরও কেন বছরের পর বছর আর যুদ্ধের পর যুদ্ধে আমাদের একই কথা শুনতে হয়?

বানি স্যান্ডার্স বলছেন, প্রশ্ন কেউ করছে না যে ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের কি অবস্থা? ইসরাইলে কোনো রকেট হামলা হলেই কেন আমাদের টনক নড়ে? ইসরাইলকে বছরে আমরা প্রায় ৪০০ কোটি ডলার সাহায্য দিই। অথচ সেই দেশের বর্ণবাদী সরকারের জন্য আমাদের নিজেদেরই কাঠগড়ায দাড়াতে হবে কেন? কিন্তু আমাদের তো আইন আছে যে যুক্তরাষ্ট্রে সাহায্য নিয়ে সেই অর্থ মানবাধিকার লংঘনে ব্যবহার করা যাবে না। তিনি বলছেন, বিশ^মঞ্চে মানবাধিকার রক্ষার পক্ষে সোচ্চার কণ্ঠ হতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে স্বীকার করতেই হবে যে ফিলিস্তিনিদের জীবনও মূল্যবান।

ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সোচ্চার আরেক ডেমোক্র্যাট সাংসদ ইলহাম ওমর বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন কেন একথা স্বীকার করতে পারছে না যে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। আল আকসায় নামাজি মুসল্লিদের ওপর বর্বরতা চালাচ্ছে ইসরাইলি পুলিশ। মানবেতিহাসের সবচেয়ে বড় উদ্বাস্তু সংকট তৈরি করেছে ইসরাইল। ৫৬ লাখ ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ জমিই ইসরাইল কেড়ে নিয়েছে।

কংগ্রেসে এভাবে বাইডেন প্রশাসনের তীব্র সমালোচনার পরই আমেরিকার ১৫০টি বিখ্যাত মানবাধিকার সংগঠন ইসরাইলের হামলার নিন্দা এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।

আমেরিকার মুসলিম সংগঠনগুলো ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বাইডেনের দেওয়া সংবর্ধনা বর্জন করেছে। আমেরিকার সর্ববৃহৎ মুসলিম সংগঠন কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক সেন্টার বা কেয়ার এক বিবৃতিতে বলেছে, গাজায় ইসরাইলি বর্ণবাদী সরকার যখন নিরীহ শিশু ও নারীদের হত্যা করছে তখন আমরা বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে পারি না। বাইডেনের উচিত অত্যাচারীর পক্ষ না নিয়ে অত্যাচারিতের পাশে দাঁড়ানো।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের সুবিধামত কোনো দেশের মানবাধিকার লংঘনের বিপক্ষে আবার কোনো দেশের আগ্রাসনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে তার কোনো নৈতিক অবস্থান বা মানদণ্ড নেই। ফলে বিভিন্ন দেশের মানবাধিকারের জন্য তাদের মায়াকান্না অনেকের হাসির খোরাক জোগায়। তবে আশার কথা হচ্ছে তাদের এই ভণ্ডামির মুখোশ এবার দেশটির আইনপ্রণেতারাই উন্মোচন করে দিচ্ছেন।