ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার অধিকার

হুইলচেয়ারে করে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন ফাদি আবু সালেহ। ইসরায়েলি সেনারা এ ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করে। ২০১৮ সালের ছবি - সংগৃহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ১৯ মে ২০২১, ১৪:৪০

জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বিশ্বের অনেক মানুষ আশা করেছিল, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতে তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি থেকে সরে আসবেন। যুক্তরাষ্ট্র নতুন পথে চলবে, যা ফিলিস্তিনিদের জন্য সহায়ক হতে পারে। কিন্তু সেই ধারণা যে কতটা ভুল ছিল, তা এখন প্রমাণিত হচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে বাইডেন ট্রাম্পের নীতিই অনুসরণ করছেন। যুক্তরাষ্ট্র সবসময় ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বলছে, কিন্তু ফিলিস্তিনের আত্মরক্ষা নিয়ে কোনো কথা নেই।

ইসরায়েলের ব্যাপারে বাইডেনের নীতি কি, তা তার একটি বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। ১৯৮৬ সালের জুন মাসে মার্কিন সিনেটে দেওয়া ভাষণে জো বাইডেন বলেছিলেন, ‘ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ার জন্য আমাদের লজ্জিত হওয়া বা এজন্য ক্ষমা চাওয়া বন্ধ করার এটাই সঠিক সময়। ইসরায়েলে আমরা যে তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে থাকি, তা হচ্ছে সর্বোত্তম বিনিয়োগ। যদি ইসরায়েল রাষ্ট্র না থাকত, তাহলে ওই অঞ্চলে আমাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে একটা ইসরায়েল সৃষ্টি করতে হতো।’ বাইডেনের এই বক্তব্যের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছরই ইসরায়েলকে তার সামরিক খাতের জন্য তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক সহায়তা দিতে শুরু করে এবং তা দেশটির সব সরকারের আমলেই অব্যাহত আছে।

বিশ্বের ঔপনিবেশিক ও দখলদার সব শক্তি সব সময়ই এ কথা বলে থাকে, তাদের অধীনে থাকা জনগোষ্ঠির যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে আত্মরক্ষার অধিকার তাদের রয়েছে। এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো এই অধিকারের কথা বলে যুগ যুগ ধরে পরাধীন জনগোষ্ঠির ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে। লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে । পশ্চিমা বিশ্বের সেই ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত আছে অধিকৃত ভূখণ্ডের ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠি ওপর।

১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলো সব সময় একথা বলে আসছে যে, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ফিলিস্তিনিরাই হচ্ছে নির্যাতিত জনগোষ্ঠি যাদের দখলদার বাহিনীর হামলা থেকে নিজেদের রক্ষার অধিকার রয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সরকারই কখনোই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে একথাটি উচ্চারণ করেনি।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের সমর্থক শত শত উগ্রপন্থি ইহুদি জেরুসালেমের রাস্তা দিয়ে মিছিল করার সময় ম্লোগান দিয়েছে-‘আরবরা নিপাত যাক’। তখন কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ইহুদিদের এই উস্কানীমূলক শ্লোগানের জবাবে বলেছিল-‘ফিলিস্তিনিদের নিজেদের রক্ষার অধিকার রয়েছে? না, একথা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন বলেনি।

গাজার আবাসিক ভবনে ইসরায়েলি বিমান হামলায় যখন শত শত নারী ও শিশু নিহত হয় তখন ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার অধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কোনো কথা বলে না। যুক্তরাষ্ট্রের বক্তব্য থেকে যে কারো মনে এই ধারণার সৃষ্টি হতে পারে যে, ফিলিস্তিনিরাই প্রবল সামরিক ক্ষমতার অধিকারি দখলদার শক্তি। ইসরায়েল রাষ্ট্রটি মজলুম একটি দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তি ইসরায়েলের অত্যাধুনিক অস্ত্রের আঘাতে যত ফিলিস্তিনিই নিহত বা আহত হোক, আন্তর্জাতিক আইন অগ্রাহ্য করে তাদেরকে যতোই বাড়ীঘর থেকে উচ্ছেদ ও বিতাড়িত করা হোক না কেন যুক্তরাষ্ট্র কখনোই এ কথাটি উচ্চারন করে না যে- ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই ভাওতাবাজি ও ন্যাক্কারজনক ভূমিকার স্বরুপ উন্মোচিত হয়েছে গত ১১ মে মঙ্গলবার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র নীড প্রাইসকে করা একজন সাংবাদিকের একটি প্রশ্নে। পূর্ববর্তী ৪৮ ঘন্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় প্রায় ২৫ জন নিরস্ত্র সাধারণ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন একথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ঐ সাংবাদিক প্রাইসের কাছে জানতে চান- ‘যেকোন উপায়েই হোক না কেন ফিলিস্তিনিদের কি আত্মরক্ষার কোনো অধিকার নেই?’

এ ধরনের প্রশ্নে স্পষ্টতই বিব্রত ও অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়া প্রাইস সুস্পষ্ট কোনো জবার না দিয়ে বলেন, ‘মোটা দাগে বলতে গেলে আমরা আত্মক্ষার ধারণায় বিশ্বাস করি। যে কোনো রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য বলে আমরা মনে করি। আমি নিশ্চিত ভাবেই চাইনা যে আমার বক্তব্যের কোনো ভুল ব্যাখ্যা করা হোক। এ সময় আরেকজন সাংবাদিক প্রাইস প্রশ্নের সঠিক জবাব দেননি অভিযোগ করে বলেন, তার জবাবের মধ্যে বড় ধরণের সমস্যা রয়েছে, বিশেষ করে ‘আত্মরক্ষার অধিকার যে কোনো রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য’ একথা দিয়ে তিনি আসলে কি বোঝাতে চেয়েছেন তা স্পষ্ট করতে বলেন। তিনি প্রাইসের কাছে জানতে চান ফিলিস্তিনকে তিনি একটি রাষ্ট্র মনে করেন কিনা?

এর জবাবে প্রাইস বলেন, আমি ব্যাপক অর্থে কথাটি বলেছি, এটা শুধু ইসরায়েল বা ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। বৈধতার প্রশ্নে আমি কোনো বিতর্কের মধ্যে যেতে চাই না।’ প্রাইসের এই জবাবের মধ্যেই আমেরিকার আসল চেহারাটা উন্মোচিত হয়েছে। কেননা তিনি এটা ভালো করেই জানেন যে, জাতিসঙ্ঘ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃত দিয়েছে। সে হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনে ফিলিস্তিন একটি জাতিরাষ্ট্র। কিন্তু প্রাইস সেটা স্বীকার করতে চাননা। স্বীকার করলে তো ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রাধিকরের বিষয়টিও স্বীকার করতে হয়।

বাইডেন প্রশাসন এটা ভালো করেই জানেন যে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সঙ্ঘাতের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় ইসরায়েল নয়, ফিলিস্তিনিদেরই আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার রয়েছে। কেননা, আন্তর্জাতিক আইনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হয়েছে যে, ‘ঔপনিবেশিক এবং বিদেশি শাসনের অধীনে থাকা কোনো জনগোষ্ঠির অধিকার রয়েছে ঐ শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করার। জাতিসংঘের এই প্রস্তাব অনুযায়ী দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র সংগ্রাম সম্পূর্ণ বৈধ।

জাতিসংঘের এই প্রস্তাবের শুরুতে ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিয়ে সুস্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের, সার্বভৌমত্বের, স্বাধীনতার ও তাদের নিজেদের ভূখণ্ড ফিলিস্তিনে ফিরে যাওয়ার অধিকারকে অস্বীকার করা এবং ঐ অঞ্চলের জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের বারবার আগ্রাসন চালানো সুস্পষ্ট ভাবেই আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি।

এই প্রস্তাবে এটা বলা হচ্ছে ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে রাখা সম্পূর্ণ অবৈধ এবং এই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করার, ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের রক্ষা করার বৈধ অধিকার ফিলিস্তিনিদের রয়েছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ থেকে ইসরায়েলের নিজেদের রক্ষা করার কথা জাতিসঙ্ঘ প্রস্তাবে এ রকমভাবে উল্লেখ করা হয়নি।

সে কারণেই জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিয়ো গুতেরেজ এক বিবৃতিতে ইসরায়েলকে ফিলস্তিনিদের বাড়ীঘর ধংস ও তাদেরকে উচ্ছেদ করা বন্ধের আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইসরায়েলের এসব কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের ও মানবাধিকারের সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। তিনি পবিত্র স্থান গুলোর উপর স্থিতবস্থা বজায় রাখার আহবান জানিয়ে বলেছেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সঙ্ঘাতের সমাধান জাতিসংঘে গৃহীত বিভিন্ন প্রস্তাব, আন্তর্জাতিক আইন ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আলোকেই করা উচিত।

বছরের পর বছর ধরেই ইসরায়েলকে জতিসঙ্ঘ প্রস্তাব ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার আহবান জানানো হচ্ছে। ইহুদি বর্ণবাদী দেশটি বরাবরই এই আহবানকে অগ্রাহ্য করে আসছে। নিশ্চিতভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের মদদেই ইসরায়েল এধরণের দু:সাহস দেখাতে পারছে। কারণ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের কিরুদ্ধে আনা যে কোনো ভেটো দেয়ার ক্ষমতা রাখে এবং সব সময়ই তা দিয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই ইসরায়েলকে সুরক্ষা দিয়ে আসছে। এজন্যই ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের উপর বারবার ভয়াবহ নৃসংসতা চালিয়েও জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থেকে যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের কথা বললেও ইসরায়েলের বেলায় তা কখনোই বলেনা। এ ব্যাপারে ইসরায়েলকে দায়মুক্তি দিয়ে রেখেছে ওয়াশিংটন। বাইডেনের দল ডেমেক্রেটিক পার্টির অনেক ও সিনেট কংগ্রেস সদস্য ইসরায়েলকে নৃশংসতা বন্ধের আহবান জানালেও বাইডেন মুখে কুলুপ এটে বসে আছেন। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলকে নি:শর্ত সমর্থন দিয়ে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারকে পদদলিত করছেন।