সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে কথিত ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ বা শতাব্দীর সেরা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে কয়েকটি আরব দেশ। প্রথমে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন, পরে মরক্কো ও সুদান এই উদ্যোগে যুক্ত হয়। সৌদি আরবও ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলে বিভিন্ন মিডিয়ার খবরে বলা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছিল যে, ইহুদি দেশটির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ব্যাপারে ইসরায়েলের ওপর প্রভাব খাটাতে পারবে এসব দেশ। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো দিক এখন স্পষ্ট হচ্ছে।
গত দুই সপ্তাহ ধরে জেরুসালেম, আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ড ও গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি সহিংসতা চলছে। পূর্ব জেরুসালেমের শেখ জারা এলাকায় প্রায় ৭০ বছর ধরে বসবাসরত ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে উগ্র জাতীয়তাবাদী ইহুদিরা উচ্ছেদ করে তাদের বাড়িঘর ও সহায়-সম্পদ দখল করছে। অন্যদিকে পবিত্র রমজান মাসে আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডে ইবাদতরত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি সেনা, পুলিশ ও কট্টরপন্থি সশস্ত্র ইহুদিদের হামলায় অন্তত ৩০০ জন আহত হয়েছেন।
এর প্রতিবাদে গাজা ভূখণ্ড থেকে ইসরায়েলে রকেট হামলার পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ইসরায়েল গাজায় নির্বিচার বিমান হামলা চালাচ্ছে। সর্বশেষ এই সংঘাতে ১৪০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি ও ৭ জন ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে , ইসরায়েলি তাণ্ডব থামাতে এসব আরব দেশের কোনো ভূমিকাই চোখে পড়ছে না। ফলে আরব বিশ^ ও এর বাইরে এসব দেশের রাজনৈতিক বিশ^াসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে বলে বিশ্লেষকরা মন্তব্য করছেন।
কথিত আব্রাহাম চুক্তিকে এই বলে যুক্তিসংগত প্রমাণ করার চেষ্টা করা হচ্ছিল যে, ইহুদিবাদী দেশটির সাথে এই চুক্তির মাধ্যমে পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের সাথে সংযুক্ত করা ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এর মাধ্যমে কার্যত ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্র সমাধানের চেষ্টার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়েছে। দুই রাষ্ট্র সমাধানের আশা এখন সুদূর পরাহত। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে চলমান সঙ্ঘাতের ব্যাপারে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পক্ষ থেকে দেশটির সরকারি বার্তা সংস্থা ওয়াম-এর মাধ্যমে প্রচারিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনিদের সাথে চলমান সহিংসতা আরব-ইসরায়েলি সঙ্ঘাত নিরসনে আন্তর্জাতিক উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করবে।
আরব দেশগুলোর মধ্যে জোরালো ঐক্য না থাকা সত্ত্বেও ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলের দখল করা ভূখন্ডে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি এখনো করে আসছে। ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা দেশগুলো যুক্তি দেখিয়ে আসছে যে, এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্টায় কিছুটা হলেও গতি আসবে। কিন্তু পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের সাথে সংযুক্ত করার যে কোনো উদ্যোগ আরবদের ভঙ্গুর এই ঐক্য ও উদ্যোগ আরো বড় ধরণের সমস্যা তৈরি করবে।
এই অঞ্চলের সাথে যারা পরিচিত তারা ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা দেশগুলোর দেয়া এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাদের মত হচ্ছে, ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তির মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ হাসিল ও এ অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে হয়তো পরিবর্তন আসবে। কিন্তু এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় কোনো কিছুই অর্জিত হবে না।
ডিল অব দ্য সেঞ্চুরির দীর্ঘমেয়াদি ফলাফলের ক্ষেত্রেও নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে। ‘ভূমির বিনিময়ে শান্তি’ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আরবদের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে নীতিগত ভাবে যে একমত্য তৈরি হয়েছিল সেই সম্ভাবনাকেও এই চুক্তি ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অন্যদিকে ইসরায়েলি জনগন ও নেতাদের মধ্যে এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, আরব দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মাধ্যমে অধিকৃত ভূখন্ড থেকে ইসরায়েলের সরে আসার কোনো প্রয়োজন নেই।
দখলদারিত্বের অধীনে থাকা ফিলস্তিনিদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরেরও কোনো দরকার নেই। সোজা কথায় বলতে গেলে, আরব দেশগুলোর চাপের মুখে ইসরায়েলের কোনো ধরনের শান্তি চুক্তিতে আসার সম্ভাবনা কার্যত শেষ হয়ে গেছে। বর্তমানে ইসরায়েল যে সব পদক্ষেপ নিচ্ছে বিশেষ করে আল আকসা মসজিদে, পূর্ব জেরুসালেমের শেখ জারায় এবং গাজা ভূখন্ডে তা ইসরায়েলের সাথে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চুক্তিরই ফসল। এই চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল কার্যত তার নতুন আরব ‘পার্টনার’ দেরকে ব্লাফ দিচ্ছে।
ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েলি আগ্রাসনের মুখে আরব লীগ এবং ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা আরব দেশগুলো কাছ থেকে কোনো জোরালো প্রতিবাদ শোনা যায়নি। তারা অনেকটাই মুখে কুলুপ এটে আছে। মিসর, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত শুরুতে শুধু আল আকসা কম্পাউন্ডে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছে। সেখানে ফিলিস্তিনীদের মুক্তভাবে ইবাদত করার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের আহবান জানিয়েছে।
এসব দেশ তাদের বিবৃতিতে পূর্ব জেরুসালেমের শেখ জারা এলাকায় ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করার এবং ইসরায়েলের বিমান হামলা চালিয়ে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করার বিষয়ে কোনো কথা বলেনি। তবে ৫৭টি মুসলিম দেশের সংগঠন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন বা ওআইসি জোরালো ভাষায় শেখ জারা ও আল আকসা কম্পাউন্ডে ফিলিস্তিনদের উপর ইসরায়েলি সহিংসতার নিন্দা জনিয়েছে।
চলমান সংঘাতের অবসানে সংগঠনটি কূটনৈতিক উদ্যোগ ও ইসরায়েলের উপর চাপ সৃষ্টির মতো সক্ষমতাও রয়েছে। তবে সংগঠনটির এই ক্ষমতা এর সদস্যদের সক্ষমতা ও ইচ্ছার উপর নির্ভর করে। সমস্যা হচ্ছে ওআইসির অনেক সদস্যেরই ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। তারা চাইলে এই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ইসরায়েলের উপর কূটনৈতিক চাপ সৃস্টি করতে পারে।
আরব লীগের এক জরুরি ভার্চুয়াল বৈঠকের পর সংগঠনের মহাসচিব আহমদ আবুল গেইত এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘জেরুসালেমে ইসরায়েলের সীমা লঙ্ঘন। ফিলিস্তিনি ও আরব বিদ্বেষী ইহুদি উগ্রপন্থিদের ইসরায়েল সরকারের প্রশ্রয় দেয়ায় পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আরব লীগ তার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদেরকে বর্তমান পরিস্থিতিতে নীরব থাকার জন্য জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এসব দেশ ইসরায়েলের সাথে তাদের কূটনৈতিক সম্পককে কাজে লাগিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির একটি সমাধানের উপায় বের করতে সহায়তা করার ক্ষেত্রে যে ব্যর্থ হয়েছে সেজন্যও সংগঠনটি এসব সদস্য দেশকে কোনো কিছু বলছে না। এসব মুসলিম দেশের ব্যর্থতাকে তাদের নৈতিক পরাজয় ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে তাদের বাড়ীঘর থেকে যখন বের করে দেয়া হচ্ছে। পবিত্র রমজান মাসে আল আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডে ইবাদতরত ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েলি বাহিনী ও উগ্রপন্থি ইহুদিরা নির্বিচার হামলা করেছে। অবরুদ্ধ গাজায় বিমান হামলা চালিয়ে শিশুসহ অর্ধশতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। তখন ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনকারি প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলোর নীরবতা তাদের বিশ^াসযোগ্যতাকে কেবল নিজ দেশে নয়, দেশের বাইরেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
এসব দেশের এই অবস্থান থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, আরব দেশগুলোর সরকারের কাছে ফিলিস্তিন ইস্যুটি তার প্রাপ্য মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আরব বিশে^র জনগণের কাছে ফিলিস্তিন ইস্যুটি এখনো আগের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ও আবেগপূর্ণ একটি ইস্যু।
ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এতদিন দুই রাষ্ট্র সমাধানের যে কথা বলা হয়ে আসছে তা বর্তমানে অনেকটাই কাযকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। গাজা ভূখন্ড ও পশ্চিমতীরে এবং বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফিলিস্তিনিরা এখন বুঝতে শুরু করেছে, দুই রাষ্ট্র সমাধানের নীতি বা চিন্তা ধারা এখন তার কাযকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। বরং হামাসের রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশল তাদের কাছে অধিকতর গ্রহনযোগ্য বলে মনে হচ্ছে।
এখন ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বসবাসরত ফিলিস্তিনিদেরকে তাদের সমঅধিকারের জন্য লড়াই করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। কেননা দুই রাষ্ট্র সমাধানের বিষয়ে আরব দেশগুলোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। পশ্চিমা বিশ^ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে মাথা ঘামাতে ততটা আগ্রহী নয়। সত্যি কথা বলতে গেলে ফিলিস্তিনিরা এখন একাকী হয়ে পড়েছে। স্বধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রাম ও আত্মদান শেষ পর্যন্ত কোনো ফল বয়ে আনবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এখন ইসরায়েলের ওপর যে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করে তাদের দাবিকে সামনে আনতে হবে। এছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।