তুরস্ক-মিসর সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যের জন্য কী বার্তা দিচ্ছে?


  • মোতালেব জামালী
  • ১৭ মে ২০২১, ১৫:৩৪

নানা ইস্যুতে তুরস্ক ও মিসরের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই টানাপড়েন চলে আসছিল। ২০১৩ সালে মিসরের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর দেশটির সাথে তুরস্কের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে। দুই দেশ কার্যত সম্পর্ক ছিন্নই করে ফেলে। সম্প্রতি দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দুই দেশের সম্পর্কের এই নতুন মোড় শুধু তাদের মধ্যেই সীমবদ্ধ থাকবে না, তা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন আনবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

তুরস্ক ঘোষণা করেছে যে, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু মে মাসে কায়রো সফর করবেন। এরইমধ্যে তুরস্কের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল মিসর সফর করেছেন। তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর তুরস্ক ও মিসরের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। যা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতেও নানা পরিবর্তন আনতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে দেশ দুটির শীর্ষস্থানীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বৈঠকের মধ্য দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে পরিবর্তন আসার ইঙ্গিত দেওয়া হয়।

গ্রিসের সাথে মিসর সমুদ্রসীমা নিয়ে চুক্তি করার পর দুই দেশের সর্ম্পকে এই পরিবর্তন আসতে থাকে। এই চুক্তির পর তুরস্কের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কায়রো সমুদ্রে তুরস্কের মহীসোপানের দাবিকে সম্মান করে। এর মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়। শুরু হয় গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যায়ে আলোচনা। মিসর ও তুরস্ক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যে সব ক্ষেত্রে দুই দেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেখানেও এর প্রভাব পড়বে।

লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে মিসর ও তুরস্ক ভিন্ন ভিন্ন পক্ষকে সমর্থন করেছে। লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহী জেনারেল খলিফা হাফতার ও তবরুক শহরভিত্তিক পার্লামেন্টকে সমর্থন দিয়েছিল মিসর। শুধু মৌখিক সমর্থন নয়, তাদেরকে সরাসরি সামরিক সহায়তাও দিয়েছিল মিসর। অন্যদিকে জাতিসংঘ সমর্থিত গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড বা জিএনএ সরকারকে সমর্থন ও সামরিক সহায়তা দিয়েছিল তুরস্ক। জেনারেল খলিফা হাফতার তার বাহিনী নিয়ে রাজধানী ত্রিপোলি অবরোধ করে রেখেছিলেন। সেই অবরোধ ভাঙতে এবং জাতিসংঘ সমর্থিত গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড বা জিএনএকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সহায়তা করেছিল তুরস্ক।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লিবিয়ায় তুরস্কের ভূমিকা ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং দুই পক্ষকে একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে আসতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। পরবর্তীতে দুই পক্ষের প্রতিনিধি নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। এর মাধ্যমে লিবিয়ায় সংঘাতের অবসান ও একটি নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ প্রশস্ত হয়। তবে মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এ কথাও বলা হয়েছে যে, লিবিয়ায় রাজনৈতিক অগ্রগতি অর্জিত হলেও ২০২১ সালজুড়ে গৃহযুদ্ধ অব্যাহত থাকতে পারে।

তুরস্ক ও মিসরের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে যে আলোচনা চলছে তার ইতিবাচক প্রভাব লিবিয়া পরিস্থিতির ওপরও পড়বে। তুরস্কও মিসরের সস্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলে লিবিয়ার বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যেও বিরোধের অবসান ঘটতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলে মিসরের সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে। যদি সেখানে কোনো ধরনের উত্তেজনা দেখা দেয়, তাহলে মিসর তার সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে। অন্যদিকে রাজধানী ত্রিপোলিতেও কোনো ধরনের উত্তেজনা দেখা দিলে তুরস্ক তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। মোটকথা দুই দেশই লিবিয়ায় নিজেদের স্বার্থ বজায় রেখে একটি রাজনৈতিক সমাধানের পথে সব পক্ষকে এগিয়ে নেয়ার মতো প্রভাব খাটাতে সক্ষম। সেখানে এই অঞ্চলের অন্য কোন দেশ বা ইউরাপীয় ইউনিয়নের হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ নেই।

মিসর ও তুরস্কের মধ্যে চলমান আলোচনায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের আলোচনায় সমুদ্রসীমাই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। আলোচনা শুরু হয়েছে এ বিষয়টি নিয়ে। এই আলোচনার চড়ান্ত পরিণতি পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সমুদ্রসীমা নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে উত্তেজনায়ও প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে গ্রিসের উপর এর প্রভাব পড়বে অনেক বেশি। তুরস্ক ও মিসরের মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনা শুরুর ঘোষণা দেয়ার পর গ্রিসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে তিন বার বৈঠক করেছেন। এছাড়া গ্রিসের প্রধানমন্ত্রীও কায়রোতে এসে মিসরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাতাহ আল সিসির সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। এই ঘন ঘন সফর পূর্ব পূর্বভূমধ্যসাগরে সমুদসীমা নিয়ে তুরস্ক ও মিসরের মধ্যে সম্ভাব্য সমঝোতায় গ্রিসের উদ্বেগ ও আতঙ্ককেই স্পষ্ট করে তুলেছে।

সমুদ্রসীমা নিয়ে তুরস্ক ও মিসরের মধ্যে কোনো চুক্তি হলে তার নানামুখী প্রভাব পড়তে পারে। প্রথমত সমুদ্রসীমা নিয়ে ২০১৯ সালের শেষের দিকে লিবিয়ার সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। যা পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সমুদ্রসীমা নিয়ে নতুন যে কোনো চুক্তিতে তুরস্কের দাবিকে সমর্থন করবে। গ্রিস ও সাইপ্রাসের মধ্যে কোনো সমুদ্রসীমা থাকবে না। এছাড়া ইসরাইল থেকে ইষ্টমেড পাইপলাইন প্রকল্পের মাধ্যমে ইউরোপের দক্ষিনাঞ্চলে যে গ্যাস সরবরাহ করা হবে তাতে তুরস্কের ভূমিকা থাকবে।

নতুন এই বাস্তবতা গ্রিস কোনোভাবেই মানতে চাইবে না। তুরস্ক ও লিবিয়ার মধ্যে সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরের পর গ্রিস যেভাবে প্রত্যাখ্যন করেছিল মিসর ও তুরস্কের মধ্যে চুক্তিও সেভাবেই প্রত্যাখ্যান করবে। এমনকি গ্রিস পূর্ব ভূমধ্যসাগরে নিজের অবস্থান জোরদার করার জন্য উত্তেজনা তৈরি করতে পারে।

তুরস্ক ও মিসরের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হলে তার প্রতিক্রিয়ায় মিসরের সাথে গ্রিসের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। ইতোমধ্যে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করেছে। সম্প্রতি সাইপ্রাস, গ্রিস, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের যে বৈঠক হয়েছে তাতে মিসরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসার পর বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন স্পর্শকাতর ক্ষেত্রে উত্তেজনা বাড়তে শুরু করেছে। ইয়েমেনের ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন এলাকায় রকেট ও ড্রোন হামলা শুরু করে। ইরান ও ইসরাইলের মধ্যেও সাগরে উত্তেজনা বেড়ে গেছে। যা আরো বাড়তে পারে। ইরানের নাতাঞ্জ পরমানু কেন্দ্রে বিস্ফোরণের ঘটনার পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। এদিকে ইরানের পরমানু কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অলোচনা এখনো ঝুলে আছে। তুরস্ক ও মিসরের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হলে তার প্রভাব এসব ক্ষেত্রেও পড়তে পারে।

এদিকে সৌদি আরব নিজের উদ্যোগেই তুরস্কের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন করতে চাইছে। ইরানের সাথে দেশটির উত্তেজনা এবং ইয়েমেন পরিস্থিতির কারণে সামরিক সহায়তার জন্যই তুরস্কের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী হয়ে উঠেছে সৌদি আরব। সম্প্রতি তুরস্কও জানিয়েছে যে, তারা সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক জোড়া লাগাতে চায়। আঙ্কারা একথাও জানিয়েছে যে, সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগী হত্যাকান্ডের ব্যাপারে দেশটির আদালত যে রায় দিয়েছে তার প্রতি তুরস্কের শ্রদ্ধা রয়েছে। সৌদি বাদশাহ সালমানের সাথে টেলিফোনে কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান। এ থেকে সৌদি আরবের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে তুরস্কের আগ্রহের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে নানা পরিবর্তনের ফলে এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে নতুন নতুন জোট গড়ে উঠছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে যা বাহরাইন ও সৌদি আরব পর্যন্ত সম্প্রসারিত হতে পারে। তুরস্কও জোটে অন্তর্ভুক্ত হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এ অঞ্চলের দেশগুলোর সাথে ইরানের যে বৈরিতা চলছে তার সমীকরণের উপরও এর প্রভাব পড়বে। তুরস্ক ও মিসরের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হলে তা এই পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করবে।

মিসর তুরস্কের মধ্যে যে আলোচনা শুরু হয়েছে তার পরিণতি বা ভবিষ্যৎ শেষ পর্যন্ত কী হবে তা নিয়ে চূড়ান্ত কথা বলার সময় এখনো আসেনি। অনেক ক্ষেত্রে দুই দেশের অবস্থান পরস্পর বিরোধী বা বিপরতিমুখী। এছাড়া তুরস্কের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের যে আলোচনা মিসর শুরু করেছে তা নিয়ে দেশটির বর্তমান মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত ও গ্রিস মোটেই সন্তুষ্ট নয়।

এসব দেশ মিসরের কৌশলগত অবস্থান বা পরিকল্পনাকে শেষ পযৃন্ত বানচাল করার চেষ্টা চালাতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষক ধারণা করছেন। তবে তুর্েকর পররাষ্ট্র মন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলুর কায়রো সফরের মধ্য দিয়ে অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে। আলোচনা থেমে যাবে নাকি সামনে অগ্রসর হবে তা সফরের পরই জানা যাবে। সেদিক থেকে তার এই সফরকে সিদ্ধান্তমূলক হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় থেকেই তুরস্কের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। বাইডেনের আমলে এসে তার কোনো পরিবর্তন এখনো হয়নি। অন্যদিকে মিসরে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্কও ভালো নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্ক ও মিসরের এই বৈরি সম্পর্কও সম্পর্কও দেশ দুটিকে পরস্পরের কাছে আসতে উৎসাহিত করতে পারে।