জো বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণই ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাদের সম্পর্কে কিছুটা চিড় ধরেছে বলেই মনে হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, তুরস্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা বাইডেনের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০১৬ সালের আগস্টে সর্বশেষ তুরস্ক সফর করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তার কিছুটা আগেই সিরিয়ায় ট্যাঙ্ক পাঠিয়েছিলেন এরদোয়ান। আঙ্কারায় প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে এরদোয়ানের পাশে বসে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছিলেন, আমরা তুর্কি অভিযানকে স্বাগত জানাই। সেই অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র বিমান হামলায় অংশ নিয়ে তুরস্কের পাশে দাঁড়ায়। তার আগের মাসেই এরদোয়ানকে উৎখাতের জন্য তুরস্কে একটি ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। ওই পরিস্থিতিতে এরদোয়ানের প্রতি সংহতি জানিয়ে ওই অভিযানে অংশ নেয় যুক্তরাষ্ট্র। সেনাদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত সংসদ ভবনও পরিদর্শন করেন বাইডেন।
সেই ঘটনার পাঁচ বছর পর বাইডেন এখন প্রেসিডেন্ট। এদিকে সিরিয়ায় সেই অভিযানের পথ ধরে বিভিন্ন দেশে তুরস্কের সামরিক হস্তক্ষেপ কয়েকগুণ বেড়েছে। বিভিন্ন অস্থিতিশীল অঞ্চলে তুরস্কের এই সামরিক হস্তক্ষেপ প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের ডজনখানেক কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারে জানা গেছে, সিরিয়ায় সামরিক অভিযানের মাধ্যমেই বিদেশে তুরস্কের সেনা হস্তক্ষেপের সূচনা হয়। সূচনা হয় আঙ্কারার সামরিক শক্তিমত্তা প্রদর্শনের নতুন যুগের।
তুরস্ক এরপর থেকে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও ককেশাসে শক্তিমত্তা দেখিয়েছে। নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল এরদোয়ানের। তবে ট্রাম্প তুরস্কের অর্থনীতিকে ধ্বংস করা হুমকি দিয়েছিলেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সাম্প্রতিক সময়ে এরদোয়ানের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি এরদোয়ানকে স্বৈরশাসক বলতেও ছাড়েননি। আর্মেনিয়ার গণহত্যাকে স্বীকৃতি দিয়ে তুরস্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন।
তবে তুরস্ক এখন আর আগের অবস্থানে নেই। উসমানীয় খেলাফতের পর সাম্প্রতিক দিনগুলোতে তুরস্ক বৃহত্তম সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে। ২০১৬ সালে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দিদের ওপর সরাসরি হামলার পর আরও কয়েকটি সামরিক অভিযানের মাধ্যমে কয়েকটি দেশের গতিধারা বদলে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনো ধরনের চাপ মোকাবেলার মতো কূটনৈতিক ও কৌশলগত দক্ষতা তুরস্ক অর্জন করেছে।
এরদোয়ান লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধের গতিধারা বদলে দিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করেই রাশিয়া থেকে এস-৪০০ নামের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছেন। পূর্ব ভুমধ্যসাগরে সমুদ্রসীমা নিয়ে তিনি ইউরোপের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন। নাগারনো কারাবাখে কয়েক দশকের যুদ্ধেও তিনি আজারবাইজানকে বিজয় এনে দিয়েছেন।
এরদোয়ান বলেছেন, তিনি বাইডেনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চান। তবে তুরস্কের স্বার্থ রক্ষা তার কাছে সবার আগে। সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরে বড় ধরনের একটি নৌ মহড়া শেষে এরদোয়ান বলেছেন, কোনো দেশের স্থল, সমুদ্র কিংবা সার্বভৌমত্বের দিকে আমাদের লোভ নেই। আমরা শুধু আমাদের মাতৃভূমি ও স্বার্থকে সুরক্ষা দিতে চাই।
অনেকে বিশ্লেষক বলছেন, ২০১৬ সালে তুরস্কে ব্যর্থ অভ্যুত্থান এরদোয়ানের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরদোয়ানের অনুরোধ সত্ত্বেও অভ্যুত্থানের আগে সেনা কমান্ডাররা সিরিয়ায় সামরিক অভিযানে রাজি হচ্ছিলেন না। ২০১২ সালে সিরিয়া তুরস্কের একটি নজরদারি বিমান ভূপাতিত করলে এরদোয়ান তার জবাবে সিরিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে হামলার জন্য ৫টি জঙ্গিবিমান পাঠানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু সেনা নেতৃত্ব তাতে রাজি হয়নি।
২০১৬ সালে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর এরদোয়ানবিরোধী সেনা কমান্ডারদের সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তিনি সিরিয়া অভিযানে সেনা পাঠান। ২০১৬ সালে দক্ষিণ তুরস্কে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের হামলায় বহু হতাহত হলে এরদোয়ান সিরিয়ায় ওই জঙ্গিগোষ্ঠীর আস্তানায় হামলার সিদ্ধান্ত নেন। তখন আমেরিকাও সহায়তা করে।
সামরিক অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তেমন গুরুত্ব দেন না এরদোয়ান। তিনি এক্ষেত্রে নির্ভর করেন ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সময় সেনাপ্রধানের দায়িত্ব থাকা হুলুসি আকার। গোয়েন্দা প্রধান হাকান ফিদান এবং প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ইব্রাহিম কলিনের ওপর। হুলুসিকে ওই অভ্যুত্থানের সময় বিদ্রোহী সেনারা গ্রেপ্তার করেছিল। তিনি এখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।
তুরস্কের কর্মকর্তারা বলছেন, এরদোয়ানের মনোভাব হলো তার্কি ফার্স্ট বা তুরস্ক সবার আগে। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দ্বন্দ্বে দ্বৈত ভূমিকা পালন করে থাকেন। এরদোয়ান লিবিয়ায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে পরোক্ষ যুদ্ধে জড়িয়েছেন আবার যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষেপিয়ে ২৫০ কোটি ডলার খরচ করে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছেন। ভূমধ্যসাগরে গ্রিস ও সাইপ্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও ক্ষেপিয়ে তুলেছেন। ইইউ নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিলেও তাকে পাত্তা দেননি এরদোয়ান।
প্রতিবেশী দেশগুলোতে শক্তিমত্তা প্রদর্শনের পাশাপাশি এরদোয়া কাতার ও সোমালিয়ায় সামরিক ঘাঁটি বানিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি উপসাগরীয় ও আফ্রিকার শৃঙ্খে নিজেদের শক্তিমত্তার জানান দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের জার্মান মার্শাল ফান্ডের গবেষক ওজগুও বলেন, এরদোয়ান দেখতে পাচ্ছেন যে তার এসব অভিযান নিয়ে প্রতিপক্ষ তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তুরস্ক এখন বাধাহীন। রণাঙ্গনের পরিস্থিতি বদলে দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে তুরস্ক।
তুরস্কেও এই আত্মবিশ^াসের পেছনে আছেন প্রতিরক্ষা সামগ্রী তৈরিতে দেশটির অভাবনীয় সাফল্য। এরদোয়ানের জামাতা সেলককু বেরাক্তারের তৈরি ড্রোন চারটি দেশের যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তর ইরাকে কুর্দি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে হামলায় তুরস্ক তার নিজস্ব ড্রোন ব্যবহার করেছে। লিবিয়ায় তুর্কি ড্রোন রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যর্থ করে দিয়েছে।
সিরিয়ার ইদলিবে তুর্কি ড্রোন আকাশসীমা দখল করে গত বছর তিনটি জঙ্গিবিমান, আটটি হেলিকপ্টার ও ১৫১টি ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছে। এসব অভিযান বিশে^র দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেছেন, তুরস্কের দাবির অর্ধেক সত্য হলেও তার প্রভাব মোড় ঘোরানো বা গেম চেঞ্জারের।
রণাঙ্গনে এই সাফল্যেও পাশাপাশি এরদোয়ানের ব্যক্তিগত কূটনীতিও ঘটনাপ্রবাহকে বদলে দিচ্ছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দিদের ওপর হামলার প্রস্তুতি নেয় তুরস্ক। এ খবর জানতে পেরে এরদোয়ানকে হুশিয়ার করে দেওয়ার জন্য ফোন করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু কথা বলার পর ট্রাম্প এরদোয়ানের যুক্তি মেনে নিয়ে উল্টো সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। ট্রাম্পের ওই নাটকীয় সিদ্ধান্তে এরদোয়ানের কর্মকর্তারাও বিস্মিত হন।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে এরদোয়ানের রসায়নে কেমন হবে তা নিয়ে কৌতুলের শেষ নেই। বাইডেন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট হওয়ার বেশ কয়েকদিন পর এরদোয়ান তাকে অভিনন্দন জানান। সম্প্রতি বাইডেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনকে খুনী বলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করেন এরদোয়ান। এরদোয়ান বলেন, বাইডেনের ওই মন্তব্য অগ্রহণযোগ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদের সঙ্গে তা মানানসই নয়।
আঙ্কারা বরং যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার জন্য কূটনৈতিক সম্পর্ককে ঢেলে সাজাচ্ছে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার পাশাপাশি সৌদি আরব ও মিশরের সঙ্গেও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র জানে, তুরস্ককে ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে তার অনেক নীতি বাস্তবায়নই কঠিন হবে। তাই আঙ্কারাকে প্রতিপক্ষের দিকে ঠেলে দিতেও রাজি নয় বাইডেন প্রশাসন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্মেনিয়ায় গণহত্যার স্বীকৃতি দিলেও এর আগে বাইডেন কথা বলেছেন এরদোয়ানের সাথে। তুরস্ক এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতিতে বলা হয়েছে এটা যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান তুরস্ক তা নাও মানতে পারে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উদীয়মান চীন এবং দীর্ঘদিনের প্রতিপক্ষ রাশিয়ার বৈরিতা অনিবার্য। এক্ষেত্রে বিশে^র নেতৃত্বের আসনে থাকতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে তার ন্যাটো মিত্র তুরস্ককে খুবই প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র শত্রুর সংখ্যা না বাড়িয়ে বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতেই বেশি আগ্রহী হবে। পাশ্চাত্যে চীনের প্রভাব বাড়ানো ঠেকাতে তুরস্ককে দরকার যুক্তরাষ্ট্রের।
দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকলে তাতে উভয়েরই লাভ। ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক চান বাইডেন। এজন্য ভূমধ্যসাগরে গ্রিস ও সাইপ্রাসের সঙ্গে তুরস্কের বিরোধের অবসান চাইবে ওয়াশিংটন।
তুরস্কও নমনীয়তা প্রদর্শন করতে শুরু করেছে। আশা করা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র তুরস্কের সঙ্গে বাইডেন প্রশাসনের সম্পর্ক খারাপ হবে না। দুই দেশের সম্পর্ক তিক্ত হলে বাইডেনের অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়নই কঠিন হবে। তাই এরদোয়ানের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি রোধও বাইডেনের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।