মুসলিম বিশ্বের দুই গুরুত্বপূর্ণ দেশ সৌদি আরব ও পাকিস্তান। আঞ্চলিক সহযোগিতা ও বৈশ্বিক নানা ইস্যুতে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সৌদি আরব ওআইসির জম্মু ও কাশ্মির গ্রুপের সদস্য। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক অনেক পূরানো হলেও গত বছর জম্মু-কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে এই সম্পর্কে টানাপড়েন তৈরি হয়েছিল। পাকিস্তানকে এড়িয়ে অনেকটা ভারতঘেঁষা হয়ে পড়ছিল মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী ও সম্পদশালী এই দেশটি। সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের আমন্ত্রণে সৌদি আরব সফর করেছেন। এর ফলে দুই দেশের সম্পর্কে আবার নতুন মাত্রা পেতে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরব কয়েক বিলিয়ন ডলারের ত্রাণ ও ঋণ সহায়তা দিয়ে পাকিস্তানকে সহায়তা করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি আরব তাদের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার এবং সৌদি তেল আমদানিকারক দেশ ভারতকে চটাতে চায়নি। সৌদি আরব পাকিস্তানকে দেওয়া তিন বিলিয়ন ডলার ঋণের মধ্যে গত বছর এক বিলিয়ন ডলার প্রত্যাহার করে নেওয়ায় পাকিস্তান আর্থিক চাপের মুখে পড়ে। এছাড়া ইসলামাবাদকে দেওয়া কয়েক বিলিয়ন ডলারের তেল ঋণ সুবিধার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তা এখন পর্যন্ত নবায়ন করা হয়নি। কাশ্মির ইস্যুর পাশাপাশি এসব বিষয় নিয়েও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে।
কিস্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী জো বাইডেন বিজয়ী হওয়ার পর পাকিস্তান-সৌদি আরব সম্পর্কও ফের উষ্ণতার দিকে মোড় নেয়। মান-অভিমান ভেঙে গত মার্চে ইমরান খানকে ফোন করেন সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। এরপর বিন সালমানকে চিঠি লেখেন ইমরান খান। চিঠিতে বিন সালমানকে ‘ভাই’ সম্বোধন করেন তিনি।
অন্যদিকে দুই দেশের জনগণের মধ্যে যুগ যুগ ধরে যে ঘনিষ্ঠ ও আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সেটাকে একেবারে উপেক্ষা করাও দুই দেশের শাসকদের পক্ষে সম্ভব নয়। অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত এই সম্পর্কও দুই দেশের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে সম্পর্ক আবার জোড়া লাগাতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের এই নতুন মোড় নেওয়ার পথ ধরেই যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ব্যক্তিগত আমন্ত্রণে সৌদি আরব সফর করলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিন দিনের এই সফরে তার সাথে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি। ইমরান খানের এই গুরুত্বপূর্ণ সফরের যাবতীয় খুটিনাটি ঠিকঠাক করতে আগেই রিয়াদে এসে পৌছেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর এরইমধ্যে ছয়বার সৌদি আরব সফর করেছেন ইমরান খান।
ইমরান খানের এবারের এই সফরকালে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমানের সাথে আলোচনায় তারা দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা সম্প্রসারণ ও জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ইমরান খান সৌদি আরবে কর্মরত প্রায় ২৫ লাখ পাকিস্তানি কর্মীর নানা সমস্যা সমাধানের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন। উভয় দেশের কর্মকর্তারা অপরাধমূলক কর্মকান্ড মোকাবেলায় পশ্চিমাঞ্চলীয় জেদ্দা নগরীতে দু’টি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
দুদেশ জ্বালানি, অবকাঠামো, পরিবহন, পানি ও যোগাযোগ প্রকল্পে অর্থায়নের ব্যাপারে দু’টি সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরের বিষয়েও সম্মত হন। এছাড়া একটি শক্তিশালী সমন্বয় পরিষদ গঠনের ব্যাপারেও সম্মত হয়েছে দেশ দুটি।
যুক্ত বিবৃতিতে উভয়পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মির বিরোধের সমাধান এবং রাজনৈতিকভাবে আফগানিস্তানে চলমান সংঘাতের অবসান ঘটানোর আহবান জানিয়েছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের তিন দিনের সফরের দ্বিতীয় দিনে এই যুক্ত বিবৃতি দেয়া হয়।
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কাশ্মির নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ মিমাংসা সংলাপের মাধ্যমে করার যে আহবান সৌদি আরবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ । কেননা কাশ্মির ইস্যু নিয়েই পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। পাকিস্তান আশা করেছিল যে, কাশ্মির ইস্যুতে সৌদি আরব পাকিস্তানকে সমর্থন করবে। এছাড়া ওআইসির পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের বৈঠকের মাধ্যমে একটি বিবৃতি দিয়ে কাশ্মির ইস্যুতে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জানাতে সৌদি আরবের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছিল পাকিস্তান।
কিন্তু সৌদি আরব সেই অনুরোধ না রাখায় দুই দেশের সম্পর্কে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। ভারত সৌদি তেলের বড় ক্রেতা দেশ। সে কারণে সৌদি সরকার কাশ্মির ইস্যু নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে কথা বলে ভারতের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে চায়নি। এর ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সেই সম্পর্ক জোড়া লাগাতে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে সৌদি আরবে আসতে বিশেষ আমন্ত্রণ জানান। তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ইমরান সৌদি আরবে যান। সৌদি আহবানের মধ্যদিয়ে কাশ্মির নিয়ে দেশটির গতবারের অবস্থানের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়া হলো।
দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে এই অঞ্চলে স্থায়ী শাািন্ত ও স্থি’তিশীলতা প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে জম্মু ও কাশ্মিরসহ দীর্ঘদিনের বিরোধের অবসানের জন্য দুই দেশের মধ্যে সংলাপের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সাথে বিস্তারিত আলোচনার পর যুবরাজ সালমান আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানের গৃহীত ভূমিকার প্রশংসা করেন। তিনি কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখায় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে অস্ত্রবিরতি চুক্তি হয়েছে তাকে স্বাগত জানান।
ইমরান খান ২০১৮ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবার পর সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বন সালমানের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। প্রধানমন্ত্রী হবার পরবর্তী দুই মাসের মধ্যেই তিনি দু’বার সৌদি আরব সফর করেন। এর মধ্যে তিনি সৌদি ভিশন ২০৩০ এর অংশ হিসেবে ফিউচার ইনভেষ্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভ কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলেন।
দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তান মারাত্মক আর্থিক সংকটে ভুগছিল। এই সংকট উত্তরণে সৌদি আরব পাকিস্তানকে সহায়তার প্যাকেজ হিসেবে ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করে। এর মধ্যে ৩ বিলিয়ন ডলার ছিল দেরিতে পরিশোধযোগ্য তেল সহায়তা সুবিধা। সৌদি আরবের পথ ধরে সংযুক্ত আরব আমিরাতও পাকিস্তানকে ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যখন পাকিস্তান সফর করেন তখন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান নিজে গাড়ী চালিয়ে বিমানবন্দর থেকে তাকে ইসলামাবাদের একটি ছোট পাহাড়ের উপর তার সরকারি বাসভবনে নিয়ে যান। এ সময় যুবরাজ সালমান ইমরান খানকে বলেন, ‘সৌদি আরবে আমি হচ্ছি আপনার দেশের রাষ্ট্রদূত। সে বছরের শেষের দিকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য ইমরান খানকে নিজের ব্যক্তিগত বিমানটি প্রদান করেন যুবরাজ।
২০২০ সালে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে যখন হঠাৎ করে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয় তখনও ইমরান ঘোষণা করেন যে, ‘পাকিস্তান ও সৌদ আরব সব সময়ই ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে থাকবে।’
২০১৯ সালে যুবরাজ সালমানের পাকিস্তান সফরকালে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সৌদি-পাকিস্তান কৌশলগত সম্পর্ক নতুন মাত্রা লাভ করে। সৌদি আরব পাকিস্তানে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে পাকিস্তানের কৌশলগত বন্দর নগরী গোয়াদরে ১০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সৌদি তেল কোম্পানী আরামকোর তেল রিফাইনারী ও পেট্রোক্যামিকেল কমপ্লেক্স নির্মানের ঘোষণা দেয়া হয়। বাকি ১০ বিলিয়ন ডলার খনি ও নবায়নযোগ্য জ¦ালানী খাতে ব্যয় করার কথা বলা হয়। এর পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমান বাড়াতে দুই বিলিয়ন ডলারের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়।
অতীতে সৌদি আরব ও পাকিস্তান নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে সৌদি আরবের সহায়তা জ¦ালানী তেলের দাম কমিয়ে নেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এই প্রথম সৌদি আরব পাকিস্তানের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়ে আগ্রহী হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যসহ এই অঞ্চলে যখন ভূরাজনৈতিক নানা পরিবর্তন ঘটছে এবং বিভিন্ন ফ্রন্টে তা দৃশ্যমান হচ্ছে তখন সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের এই পুনরুজ্জীবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দরে সৌদি আরবের বিশাল বিনিয়োগ থেকে এটাই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সৌদি আরব ব্যাপক আঞ্চলিক সমন্বিত নেটওয়ার্ক- দ্য চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর বা সিপিইসিতে যুক্ত হতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এ থেকে অনুমান করা হচ্ছে, সৌদি আরবের পরবর্তী পরিকল্পনা হতে যাচ্ছে পাকিস্তানে রিয়াদের প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন করা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ কাজটি সহজ নয়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তি মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরবের বিশেষ অবস্থান এবং সৌদি-পাকিস্তান ঐতিহাসিক সম্পর্ককে সহজ মেনে নিতে পারছে না। এই দেশ দুটি যে তাদের সম্পর্ককে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে যেখানে ভবিষ্যৎ ভুঅর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেকে এই সর্ম্পকের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে উঠতে পারে। তবে ঐতিহাসিকভাবে দুদেশের মধ্যে যে সুসর্ম্পকের ভিত্তি রচিত হয়েছে তা খুব সহজে ফাটল ধরবে না। কৌশলগত কারনে পাকিস্তানের অবস্থান এশিয়ায় সৌদি প্রভাবের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।