কেমন আছেন কাশ্মিরের মানুষ


  • মোতালেব জামালী
  • ১৩ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৪৮

গত কয়েক দশক ধরে কাশ্মিরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে সব ঘটনা ঘটছে, তা লুকানোর চেষ্টা করে আসছে ভারত। ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের অনেক স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক ও মানবাধিকার কর্মীর সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট স্থগিত করে রাখা হয়েছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই ভারতের শাসকরা কাশ্মিরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও পরিচিতি বদলে ফেলার ও বিকৃত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে আসছেন। কাশ্মিরের জনগণের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে যারা কথা বলছেন, তাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেওয়ার এবং নিজেদের অপরাধকে ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলার জন্য ভারতের শাসকরা সব সময়ই তৎপর।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসার পর কাশ্মিরের জনগণ তাদের মুক্ত মতামত প্রকাশ ও বিশে^র কাছে নিজেদের অবস্থা তুলে ধরার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম পেয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাশ্মিরের প্রতি সংহতি জানানোর পৃষ্ঠাগুলো যথেষ্টই সাড়া ফেলেছিল এবং কাশ্মিরের জনগণের স্বাধীকারের সংগ্রামের কথা অনলাইনে তুলে ধরা হতো। কিন্তু কাশ্মিরের জনগণের নতুন পাওয়া এই স্বাধীনতা বেশি দিন স্থায়ী হলো না।

ভারত সরকারের চাপের কারণে সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো কাশ্মির সংক্রান্ত বিভিন্ন পেজ ও কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক ও মানবাধিকার কর্মীদের একাউন্টগুলো বন্ধ করে দিতে শুরু করে। ২০১৬ সালে কাশ্মিরে বিক্ষোভ শুরু হলে ভারত সরকার ব্যাপক দমন-পীড়নের মাধ্যমে তা বন্ধ করার চেষ্টা করে।

এ সময় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ কাশ্মিরের চলমান ঘটনাবলী ও সেখানের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরার জন্য খোলা পেজগুলো বন্ধ করে দেয়। সাংবাদিকরাও তাদের প্রতিবেদনে লিখেছেন যে, সেখানে বিক্ষোভকারি সাধারণ মানুষের উপর পুরিশের বর্বরোচিত হামলা ও নির্যাতনের ভিডিও গুলো ব্লক করে দেয়া হয়েছে। কাশ্মিরের শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবিরাও দেখতে পেলেন যে, তাদের একাউন্টগুলো অকেজো হয়ে গেছে।

২০১৯ সালের ৫ আগষ্ট ভারত সরকার অধিকৃত কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল ও লকডাউন কার্যকর করার পর সোস্যাল মিডিয়াগুলো দ্রুততার সাথে আবারো কাশ্মিরের পরিস্থিতি নিয়ে লেখা বিষয়গুলো সেন্সর করা শুরু করে। ইন্টারনেট ও মোবাইল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে কাশ্মিরকে যখন বিশ^ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়, তখন ফেসবুক, ইনষ্টাগ্রাম ও টুইটার সেখানের মানুষের বিভিন্ন পোষ্ট রিমুভ, ভিডিও ব্লক ও অসংখ্য একাউন্ট বন্ধ করে দিতে থাকে। কাশ্মিরের অমানবিক পরিস্থিতি যেন বিশে^র সামনে তুলে ধরা না যায় সেজন্যই সোশাল মিডিয়াগুলো এ পদক্ষেপ নেয় বলে কাশ্মিরের জনগণের অভিযোগ।

পরবর্তীতে ভারত সরকার কাশ্মিরের লকডাউন কিছুটা মিথিল করে। কিন্তু সোশাল মিডিয়াগুলো কাশ্মির সংক্রান্ত সব পোষ্ট ও অন্যান্য বিষয় মুছে ফেলার কাজ অব্যাহত রাখে। সেন্সরশীপের সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে গত মার্চ মাসে টুইটার কাশ্মির সিভিটাস, ষ্ট্যান্ড উইথ কাশ্মির, দ্য কাশ্মির পোডকাস্টসহ বিভিন্ন একাউন্ট বন্ধ করে দেয়।

অধিকৃত কাশ্মিরে ভারতের অনুসৃত নীতির সমালোচনাকারি বিভিন্ন একাউন্ট বন্ধ ও পোষ্ট সরিয়ে ফেলে ফেসবুক ও টুইটার লোকজনের মুখ বন্ধ করতে চায়। কারণ তারা এই ভূখন্ডে ভারতের সামরিক দখলদারিত্ব কায়েম এবং বাইরের লোকজন এনে বসতি স্থাপন করিয়ে কাশ্মিরিদের ভূমি দখল করার বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছে। কিন্তু তাদের কন্ঠস্বর স্তব্ধ করার মাধ্যমে সোশাল মিডিয়া নেটওয়ার্কগুলো কার্যত নির্যাতিত-নিপীড়িত এসব লোকের বাক স্বাধীনতাকেই খর্ব করছে।

কাশ্মির সিভিটাস কানাডায় নিবন্ধিত একটি বেসরকারি সিভিল সোসাইটি ও কৌশলগত প্রচারণা চালানোর একটি উদ্যোগ। সংগঠনটি অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মিরের জনগণের আর্থ-সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এটি একটি উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ সংগঠন। যেটি বিরোধপূর্ণ এই অঞ্চলের ব্যাপারে ভারত যে সব মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে তা শান্তিপূর্ণ ভাবে চ্যালেঞ্জ করছে। এই সংগঠনটি কাশ্মিরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কোন গনতান্ত্রিক সমাজ বা রাষ্ট্র এই অধিকারকে অস্বীকার করতে পারে না।

জাতিংসংঘ সনদে কাশ্মিরিদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কেবল তাই নয় ১৯৪৮ সালে নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত ৩৯ ও ৪৭ নম্বর প্রস্তাবসহ কাশ্মিরের উপর জাতিংঘে যে ১৮টি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে তার নীতিমালার আলোকেই এই সংগঠনটি তার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। নিরাপত্তা পরিষদের ঐ দুটি প্রস্তাবেই কাশ্মিরের জনগণের পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে প্রস্তাবে কাশ্মিরের মর্যাদা নির্ধারণে জাতিসংঘের তত্বাবধানে সুষ্ঠু ও অবাধ গণভোট অনুষ্ঠানের কথাও বলা হয়েছে।

সংগঠনটি বিশ^াস করে যে, কাশ্মির বিরোধ শুধু মাত্র ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় বিষয় নয়, বরং এটি একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু। এখানে মূল পক্ষ হচ্ছে বিরোধপূর্ণ এই ভূখন্ডের জনগণ। যারা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। যাদের এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে, ভারতের দখলদার বাহিনীর তাদের ভূখন্ড দখল করে এটাকে বহিরাগত লোকজনের আবাসস্থল বানানোর বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর আইনগত ভাবেই সব অধিকার রয়েছে।

কাশ্মির সিভিটাস নামের এই সংগঠনটির কর্মকর্তা অধ্যাপক ফারহান মুজাহিদ চকের বলেন, তাদের এই সংগঠনটি কশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখান উভয় পাশের ধর্ম, বর্ণ ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের স্বাধীনতার গনতান্ত্রিক রীতিনীতি, সাম্য ও মর্যাদা রক্ষার নিয়ম মেনে চলে। তারা কাশ্মিরি জনগণের নৈতিক, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন চান। তিনি প্রশ্ন তোলেন ভারত অধিকৃত কাশ্মিরে যারা সত্য কথা বলছে ও সত্য ঘটনা তুলে ধরছে তাদের কন্ঠস্বর ফেসবুক ও টুইটার কেন থামিয়ে দিচ্ছে? এব্যাপারে এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কাছে বিভিন্ন সময়ে জানতে চাওয়া হলেও তারা কোন জবাব দিচ্ছেনা। কিন্তু কিছুদিন পর স্থগিত রাখা এসব একাউন্ট আবার হঠাৎ করেই চালু করা হচ্ছে। বেড়েছে নির্যাতন-নিপীড়নও।

কাশ্মিরের জনগণের কন্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য ভারত সরকার যখন নজীরবিহীন তৎপরতা চালাচ্ছে। তাদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে এবং কাশ্মির ইস্যুকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে থেকে সরিয়ে নিচ্ছে। ঠিক সেই সময়ে টুইটারও কাশ্মিরিদের উপর সেন্সরশীপ আরোপ করছে। মোদি সরকার ২০১৯ সালে কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার পর এই ভূখন্ডে আগের চেয়েও আরো বেশি সেনা সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।

যেসব সাংবাদিক কাশ্মির পরিস্থিতির উপর প্রতিবেদন লিখতে চাইছেন তাদের উপর সেন্সরশীপ আরোপ ও ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে। হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সাধারন মানুষ এমনকি শিশুদেরও গ্রেফতার করা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার আগেও অধিকৃত কাশ্মির ছিল বিশে^র মধ্যে সবচেয়ে বেশি সেনা মোতায়েন করা এলাকা। বর্তমানে কাশ্মির উপত্যকায় ১০ লাখেরও বেশি ভারতীয় সেনা মোতায়েন রয়েছে।

কাশ্মির হচ্ছে জতিসংঘের এজেন্ডায় সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে অমিমাংসিত থাকা সংঘাতপূর্ণ একটি ইস্যু। সেখানে ১৯৯০ এর দশকের শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ৯৫ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। সন্ধান পাওয়া গেছে ৬৭০০ অজ্ঞাত পরিচয় মানুষের কবর ও গণকবর। কত নারী যে হয়রানী ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তার কোন হিসাব নেই। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেই টুইটার ও ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যম ভারত সরকারের পক্ষ নেয়ার কাজটি পছন্দ করেছে। বর্তমানে ভারত সরকার নিজেদেরকে গনতান্ত্রিক দাবি করলেও তারা দিন দিনই কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠছে।

যুক্তরাষ্ট্রবিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউস সম্প্রতি ভারতের ওপর একটি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে ভারত অধিকৃত কাশ্মিরকে ‘মুক্ত নয়’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে একইসঙ্গে একটি গনতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের অবনমন ঘটিয়ে “আংশিক মুক্ত” দেশ হিসেবে অভিহিত করা হয়।

ভারতে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করা সংগঠন ফ্রি স্পীচ কালেকটিভ এর সহপ্রতিষ্টাতা গীতা শেসু বলেন, সোশাল মিডিয়া মনিটরিং করা নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার লংঘন করার শামিল। এ ধরণের নজরদারি সম্পূর্ণভাবে নিবর্তণমূলক। এটি গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে কতৃত্ববাদী শাসনের দেশের পরিচয় বহন করে।

বেসামরিক স্বেচ্ছাসেবীদের দিয়ে সাধরণ মানুষের উপর গোয়েন্দাগিরে করানো নাৎসী জার্মানীর উদাহরণই বহন করে। জার্মানীতে ঐ সময় গোয়েন্দাগিরি করার জন্য সাধারণ নাগরিকদের নাম তালিকাভূক্ত করা হতো এবং একজন আরেকজনের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য প্রদান করতেন। এ ধরণের তৎপরতা একটি অসুস্থ কাজ এবং এর মাধ্যমে নাগরিকদের সামাজিক সংহতিতে ফাটল ধরানো ও বিভাজন সৃষ্টি করা হয়। এর মাধ্যমে সমাজে প্রতিবেশিসহ সবার উপর সন্দেহের বীজ বপন করা হয়। নিরুৎসাহিত হয় সামাজিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ। শুধু কাশ্মির নয় গোটা ভারতে এখন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।