নজিরবিহীন গৃহযুদ্ধে রক্তবন্যা মিয়ানমারে


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১৩ এপ্রিল ২০২১, ০৮:২৪

মাত্র চার বছরেরও কম সময় আগের কথা। মিয়ানমারের অসহায় রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল সেনাবাহিনী। মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজ জনগোষ্ঠী তখন রোহিঙ্গা নিধনে সহযোগী হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এখন সেই সেনাবাহিনীর হাতে বার্মিজরাই বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে। উপায়ান্তর না পেয়ে এখন তারা সেনাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে। ফলে মিয়ানমারে শুরু হয়েছে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ, বইছে রক্তবন্যা। এর শেষ কোথায় কেউ জানে না।

পহেলা ফেব্রুয়ারির সেনা অভ্যুত্থানের আগে জার্নি উইন ছিলেন জাতিসংঘের অর্থায়নের পরিচালিত একটি পর্যবেক্ষণ কমিটির কর্মকর্তা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার অস্ত্রবিরতি পর্যবেক্ষণ করতেন তিনি। দেশটির বৃহত্তম শহর ইয়াঙ্গুনের বাসিন্দা ২৭ বছর বয়সী এই তরুণী এখন সেই চাকরি ছেড়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীতে নাম লিখিয়েছেন।

তিনি টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, ‘সন্ত্রাসী সেনাবাহিনীর মুলোৎপাটনের প্রস্তুতির সময় এসে গেছে। আমি সশস্ত্র বিপ্লবে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। ’

তার মত বহু তরুণ-তরূণী অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ায় টাডামাডো নামে পরিচিত মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।

জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত ক্রিশ্চিন স্ক্র্যানার বার্জেনার গত ৩১ মার্চই হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে মিয়ানমারে রক্তবন্যা আসন্ন। দেশটিতে নজিরবিহীন গৃহযদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মিয়ানমার ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। তার ওই বক্তব্য অক্ষরে অক্ষরে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।

মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে। কিন্তু সেনাবাহিনীর সীমাহীন বাড়াবাড়ির কারণে তা এখন রক্তাক্ত যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। ১১ এপ্রিলের মধ্যেই সেনাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৭০০ বিক্ষোভকারী। নিহতদের মধ্যে শিশু-কিশোরও অর্ধ শতাধিক। এ পরিস্থিতিতে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে সেনাদের বিরুদ্ধে কাধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করছেন নৃতাত্তিক গোষ্ঠী ও দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বামাররা। এতে নিরাপত্তাবাহিনীর অনেক সদস্যকেও প্রাণ দিতে হচ্ছে। ১০ এপ্রিলই অন্তত ১৪ জন পুলিশকে হত্যা করেছে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা। এর আগেও এভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর অনেককে হত্যা করা হয়েছে। কয়েকদিন আগে তেজ শহরে বিক্ষোভ দমনে গিয়েছিল ৬ ট্রাক সেনা। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা বন্দুক, ছুড়ি ও তাজা বোমা নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করে। পরিস্থিতি বেসামাল দেখে আরও ৫ট্রাক সেনা আনতে হয়।

সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য গঠন করা হয়েছে ফেডারেল আর্মি নামের বিদ্রোহী গোষ্ঠী। দেশটির অনেক নৃতাত্তিক বিদ্রোহী গোষ্ঠী এতে যোগ দিয়েছে। তাদের হাতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রও রয়েছে। ফলে মিয়ানমার এক রক্তাক্ত বধ্যভূমিতে পরিণত হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

মিয়ানমারের জান্তাবিরোধীরা দেখতে পাচ্ছে, বৈশ্বিক নানা সমীকরণে আন্তর্জাতিক চাপের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে উৎখাতের সম্ভাবনা নেই। একমাত্র সশস্ত্র বিদ্রোহই সেনা শাসনের যাতাকল থেকে তাদের মুক্তি দিতে পারে।

জাতিসংঘের কমিটিতে কাজ করা জার্নি উইন বলেন, মানুষ এখন বুঝতে পারছে যে বিদেশিদের সহায়তার আশায় বসে থেকে লাভ নেই। যা করার আমাদের নিজেদেরই করতে হবে। আমরা অস্ত্রশস্ত্র না দিয়ে তো আমাদের তরুণদের সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়ে মরতে বলতে পারি না।

দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার জনগোষ্ঠী ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে দীর্ঘদিন সংঘাত ও বৈরিতা চললেও সেনাশাসনের কারণে তারা পরস্পরের কাছে এসেছেন। এখন তাদের অভিন্ন লক্ষ্য সেনাশাসন উৎখাত। বামাররা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। তারা বলছে, সেনাদের উৎখাত করা গেলে তারা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের লড়াইকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করবেন। ফলে মিয়ানমারে এখন সেনাশাসন বিরোধী নজিরবিহীন শক্তি দেখা যাচ্ছে। এটাই সেনাশাসন বিরোধী আন্দোলনের বড় শক্তি।

বামাররা মিয়ানমারের মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ। বাকিরা ১০০ নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সদস্য। ১৯৪৮ সালে দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বামাররাই রাজনীতি ও সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রন করেছে। তবে শুরু থেকেই আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে ও বামারদের শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলো। সেনাবাহিনী হত্যা ও ধর্ষণের মাধ্যমে বিদ্রোহ দমনে চেষ্টা করে। এতে সমর্থন দেয় বামাররা। মিয়ানমারের ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী অং সান সুচি বা তার দল এনএলডিও সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের পক্ষ নেয়।

কাচিন তরুণ জিন বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার জনগোষ্ঠীও এখন সেনাবাহিনীর নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। তাই তাদেরকে নিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহের এটাই মোক্ষম সময়। বামাররা আগে আমাদের কথা শুনত না। এখন তারাও তাতমাদৌর নিপীড়নের শিকার। তাদের উপযুক্ত শিক্ষা হচ্ছে।

জাতিসংঘ কর্মসূচির কর্মকর্তা জিন উইন বলেন, আমি অহিংস আন্দোলনে বিশ্বাস করতাম। কিন্তু মিয়ানমারের অতীত ইতিহাসের কথাও ভুলে গেলে চলবে না। সেনাবাহিনী নির্মমভাবে বিক্ষোভ দমন করেছে বারবার। কাজেই আমাদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে যে অহিংস আন্দোলনে কাজ হবে কীনা?

সেনাবাহিনী তো সন্ত্রাসী বাহিনীতে রূপ নিয়েছে। তিনি বলেন, সশস্ত্র বিপ্লব সফল হলে মিয়ানমারের সামনে সুদিন অপেক্ষা করছে। তখন সব জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে মিয়ানমারে একটি সত্যিকার ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব হবে।

মিয়ানমারের জাতিগত তিনটি সশস্ত্র সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করে দেশের এক তৃতীয়াংশ অংশ। ইতিমধ্যেই তারা সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এই তিনটি গ্রুপ হলো মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স আর্মি, আরাকান আর্মি এবং তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি।

দেশটির কারেন ও কাচিন বিদ্রোহীরা অভ্যুত্থানবিরোধী জনমতের সুযোগে ইতিমধ্যে সেনাদের কিছু চৌকি দখল করে নিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, জাতিগত সংখ্যালঘুরা সুচির দল এনএলডি আর তাতমাদৌর বিরোধের সুযোগ নিতে তৎপর। দেশটির সশস্ত্র গ্রুপগুলো বর্তমান অবস্থাকে নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ের ঐতিহাসিক সুযোগ হিসেবে নিতে চাইছে।

থাই সীমান্তের কাছে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে সবচেয়ে সংগঠিত সংখ্যালঘু সশস্ত্র গ্রুপ কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন। সেনাবাহিনী সেখানে ২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবার বিমান হামলা চালায়। এর ফলে ওইসব গ্রামের ভীতসন্ত্রস্ত্র লোকজন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছেন থাইল্যান্ডে। এছাড়া অন্যান্য এলাকার জনগণ চীন ও ভারতের দিকে ছুটছেন। কিন্তু কেউ তাদের আশ্রয় দিতে রাজী নয়। কারণ ওই তিনটি দেশের সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দারুন সখ্য।

মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের মধ্যবর্তী স্থানে লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। তারা দেশ থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু থাইল্যান্ড তাদের ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন তাদের খাবার নেই, পানি নেই। ফলে এখন তাদের জন্যে একটাই পথ খোলা- সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধ। নিরুপায় এসব মানুষ দেশে ফিরে বাঙ্কার খুঁড়ে তাতে অবস্থান নিচ্ছেন। মিয়ানমারের চারদিকে তাই গৃহযুদ্ধের দামামা। সশস্ত্র বিক্ষোভকারীদের সাথে স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এবং অনেক চাকরিজীবীরাও যোগ দিয়েছেন।

যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে মিয়ানমারের অর্থনীতিও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সংঘাতময় পরিস্থিতির কারনে লোকজন ঘরের বাইরে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছে না। অনেকে ক্ষেত খামারেও যেতে ভয় পাচ্ছেন। শ্রমিক ধর্মঘটে বন্দর অচল হয়ে পড়ায় আমদানি রফতানি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।

মিয়ানমারের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ সেনাবাহিনীর হাতে। খনি, টেলিকমসহ সব বড় খাত তাদের দখলে। কিন্তু গণহত্যার কারণে সেনাবাহিনীর ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আসতে শুরু করেছে। এতে অর্থনীতি ভেঙে পড়বে বলে মনে হচ্ছে। তাছাড়া মিয়ানমারে এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগও আসবে না।উল্টো পশ্চিমা দেশগুলো বিনিয়োগ নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। অনেকে মনে করছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে দমাতে চাইলে দেশটির অর্থনীতিকে প্রথমেই পঙ্গু করে দিতে হবে। তাহলেই সেনাবাহিনী পরাস্ত হবে।

তবে একথা সত্য যে মিয়ানমারের এই হত্যাযজ্ঞে বহির্বিশ্বে এবার তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। এর একটি বড় কারণ রোহিঙ্গাদের ওপর নিধনযজ্ঞ। তখন মিয়ানমারের বার্মিজ জনগোষ্টী এবং অং সান সুচি এবং তার দল সেনানাবহিনীর হত্যাযজ্ঞের পক্ষ নেয়। অনেক সময় বার্মিজরা হত্যাযজ্ঞে সরাসরি অংশও নেয়। এমনকি দেশটির অনেক বৌদ্ধবিক্ষুও রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞের সহযোগী ছিল। একারণে দেশটি এবং তাদের জনগণের ওপর সারাবিশ্বের মানুষের ভীষণ রকমের বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে।

অসহায় বিপন্ন রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ সরকার এবং এদেশের জনগন। আন্তর্জাতিক বিশ্বও এগিয়ে এসেছিল। কিন্তু এখন বার্মিজদের পাশে কার্যত কেউ নেই। নিজ জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন করতে করতে মিয়ানমার এখন কার্যত একটি ক্লীব রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এখান থেকে কিভাবে দেশটি ঘুরে দাঁড়ায়, তা দেখার জন্য বিশ্ববাসীকে হয়তো বহুদিন অপেক্ষা করতে হবে।