কঠিন চ্যালেঞ্জে মাহমুদ আব্বাস, সুবিধায় হামাস

বাঁ থেকে: ইসমাইল হানিয়া এবং মাহমুদ আব্বাস

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১১ এপ্রিল ২০২১, ০৮:৫৬

দীর্ঘ ১৫ বছর পর ফিলিস্তিনের সংসদ এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হলে অবরুদ্ধ দেশটি রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে সম্ভাবনার এ নির্বাচন নিয়ে নানা শঙ্কা ও অনিশ্চয়তাও রয়েছে।

ফিলিস্তিনের সংসদীয় আসনগুলোয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২২ মে। এরপর ৩১ জুলাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচন ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর দীর্ঘদিনের বিরোধ দূর করতে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে প্রধান দুটো দল হামাস এবং ফাতাহ’র মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। স্বাধীন ফিলিস্তিন সরকার গঠনে আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে তারা এ পদক্ষেপ নিয়েছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফাতাহ। এবারের নির্বাচনে হামাস ছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের একটি জোট দাঁড়িয়েছে। এ জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ফিলিস্তিনের প্রয়াত জনপ্রিয় নেতা ইয়াসির আরাফাতের ভাতিজা নাসের আল কিদওয়া। তিনি জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।

মাহমুদ আব্বাসের অনেক ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীও এ জোটকে সমর্থন করছেন। সব মিলিয়ে ফাতাহ এবার তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে ভোটে লড়াই করতে যাচ্ছে। এতে ফাতাহর ভোট বিভক্ত হওয়ায় নির্বাচনে আবারো হামাসের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে। ২০০৬ সালে সর্বশেষ নির্বাচনেও ইসলামপন্থী হামাস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল।

গত ৪ এপ্রিল ফিলিস্তিনের নির্বাচন কমিশন সংসদ নির্বাচনে ৭টি দল ও ২৯টি স্বতন্ত্রসহ মোট ৩৬ প্রার্থীর তালিকা অনুমোদন করেছে। এতে ১৩২ আসনের বিপরীতে প্রার্থী হচ্ছেন ১৩৮৯ জন। তাদের মধ্যে নারী প্রার্থী ৪০৫ জন। মোট প্রার্থীদের মধ্যে নারী প্রার্থী ২৯ শতাংশ। নির্বাচনে ধর্মনিরপেক্ষ ফাতাহর বিপক্ষে ইসলামপন্থী হামাসের মূল লড়াই হবে। তবে এবার হামাসের প্রতিপক্ষের ভোট বহু ভাগে ভাগ হওয়ায় দলটির অবিশ্বাস্য ভালো ফল করতে পারে।

ফাতাহ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। ইসরাইলের দখল করা ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড পশ্চিমতীরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তার দল। বিপরীতে ২০০৭ সাল থেকে ইসরাইল অবরুদ্ধ করে রাখা গাজায় লড়বে হামাস।

নির্বাচনে ফাতাহর অন্তঃকোন্দল চরমে পৌছেছে। এছাড়াও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে ফাতাহ। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নেতৃত্ব নাসের আল-কিদওয়ার সঙ্গে আছেন ফিলিস্তিনের আপোসহীন নেতা মারওয়ান বারঘুতি। ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ইসরাইলের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় প্রতিরোধ আন্দোলনে বা ইন্তিফাদায নেতৃত্ব দেন মারওয়ান। এ ছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ফিলিস্তিনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা সালাম ফায়াদও তাদের সঙ্গে রয়েছেন।

এদিকে ইসরাইলের দখল করা পূর্ব জেরুজালেমে ভোটগ্রহণ এখনো অনিশ্চিত। কারণ ইসরাইল সেখানে ফিলিস্তিনের সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কিন্তু ফিলিস্তিনের নেতারা যে করেই হোক এ শহরে ভোট করতে চাইছেন। কারণ ভবিষ্যত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হবে এ অঞ্চল।

ফিলিস্তিনের গাজা বিষয়ক বিশ্লেষক হানি হাবিব মনে করেন , নির্বাচনে ফাতাহ ও হামাস ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন জো বাইডেন প্রশাসনকে ‘আলোচনার জন্য প্রস্তুত’ বলে বার্তা দিতে চাইছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে এ সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে।

২০০৬ সালের নির্বাচনের পর থেকেই ফাতাহর সঙ্গে হামাসের রাজনৈতিক বিরোধ দেখা দেয়। ২০০৭ সালে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নিলে এটা আরও তীব্র হয়। তখন থেকেই গাজা অবরুদ্ধ করে রেখেছে ইসরাইল। এবার হামাস নমনীয় অবস্থান নিয়েছে। দলটির নেতা ইসমাইল হানিয়া বলেছেন, মে মাসে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে জয় পেলেও তার দল ঐকমত্যের সরকার গঠন করবে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে হামাস নেতাদের গণহারে গ্রেফতার চালিয়ে যাচ্ছে দখলদার ইসরাইলি সেনারা। হামাস বলছে, ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ ফিলিস্তিনের নির্বাচনকে ব্যাহত এবং নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে চাচ্ছে। হামাস আরো অভিযোগ করেছে যে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ তাদের সদস্যদের ভয় দেখাচ্ছে, তাদের হুমকি দিয়ে বলা হচ্ছে যে নির্বাচনে দাঁড়ালে তাদের জেলে ঢোকানো হবে।

ইসরাইল মনে করছে, নির্বাচনে হামাস জয়ী হবে। একারণে ইসরাইল ফিলিস্তিনে নির্বাচনের বিপক্ষে। নির্বাচনে হামাস জয়ী হলে ইসরাইল কি করবে তা এখনও স্পষ্ট নয়।

নির্বাচনে মাহমুদ আব্বাসের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছেন ফাতাহর নেতা মারওয়ান বারঘুতি। ২০০৪ সালে ৫ ইসরাইলিকে হত্যার অভিযোগে তিনি ইসরাইলি কারাগারে ৫ দফা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন। ফাতাহর মধ্যে তিনি ভীষণ জনপ্রিয়। দলের একাংশ তার পক্ষে মনোয়নপত্র দাখিল করেছে।

বারঘুতি ভবিষ্যতে মাহমুদ আব্বাসের স্থলাভিষিক্ত হবেন বলে মনে করা হচ্ছে। ৮৫ বছর বয়সী আব্বাস দলের কাছে জনপ্রিয় নন।

প্যালেস্টাইন সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বারঘুতি প্রার্থী হলে তিনিই সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন। এবারের নির্বাচনে ৭৮ শতাংশ ফিলিস্তিনি ভোট দিতে পারেন বলে জরিপে উঠে এসেছে। জরিপে দেখা যায়, ২২ শতাংশ ভোটার বারঘুতিকে, ১৪ শতাংশ ভোটার হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে এবং মাত্র ৯ শতাংশ ভোটার মাহমুদ আব্বাসকে ভোট দিতে পারেন। নির্বাচনে হামাস ও ফাতাহ জোটবদ্ধ হয়ে একক প্রার্থী না দিলে বারঘুতি জয়ী হবেন বলে জরিপে উঠে এসেছে।

তবে সংসদ নির্বাচনে ২৭ শতাংশ ভোটারের সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আছে হামাস। ফাতাহ পেতে পারে ২৪ শতাংশ এবং বারঘুতির জোট ২০ শতাংশ। সংসদ নির্বাচনে হামাস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে হয়তো মাহমুদ আব্বাসকে সমর্থন দিতে পারে।

আব্বাসের সাবেক উপদেষ্টা এবং ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির সিনিয়র বিশ্লেষক ঘাইথ আল ওমারি নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ফাতাহর বিভক্তি একটা নাটকীয় ও বড় ধরনের ঘটনা। এটা আব্বাসের নির্বাচনী কৌশলের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি ফাতাহর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবেন কিনা সেটা অনিশ্চিত।

১৬ বছর ধরে মাহমুদ আব্বাস ফাতাহর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০০৬ সালের পর তিনি ফিলিস্তিনি সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ নেননি। এর বড় কারণ হামাসের কাছে পরাজয়ের আশঙ্কা। আব্বাস আশা করেছিলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে হামাসের সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌছানো যাবে। কিন্তু নিজ দলেই তিনি কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছেন।

ঘাইথ আল ওমারি বলেন, ২০০৫ সালে আব্বাস প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এটাই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা। বারঘুতি ও কিদওয়ার যৌথ চ্যালেঞ্জকে আব্বাস উপক্ষো করতে পারবেন না। দলে তাদের গভীর প্রভাব রয়েছে। আব্বাসের ক্ষমতায় থাকাকেই তারা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারেন।

বারঘুতি আশির দশক থেকে ফিলিস্তিনি ইন্তেফাদার অন্যতম নেতা। ইসরাইলি কারাগারে থেকেই তিনি নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। বারঘুতির সমর্থকরা বলছেন,আব্বাসকে কেন্দ্র করে ধর্মনিরপেক্ষ ফাতাহ এখন এক ব্যক্তির দলে পরিণত হয়েছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে ডিক্রির মাধ্যমে দেশ শাসন করছেন আব্বাস।

বারঘুতির সমর্থক জোটের নেতা হানি আল মাসরি বলেছেন, ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা এখন আর সংস্কারের অবস্থায় নেই। এটা গভীর পরিবর্তন দরকার। তবে আব্বাসের সমর্থকরা বারঘুতি সমর্থকদের দলত্যাগী বলে মন্তব্য করেছেন।

এ পরিস্থিতিতে আব্বাস নির্বাচন বাতিল করে দিতে পারেন বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন। তবে রামাল্লার রাজনৈতিক বিশ্লেষকও ও আব্বাসের সাবেক মন্ত্রী ঘাসাম খতিব বলেন, এ পর্যায়ে নির্বাচন বাতিল করা হলে আব্বাসকে রাজনৈতিকভাবে চড়া মাশুল গুণতে হবে।

ফলে আব্বাস হয়তো চাইবেন ইসরাইল সরকার নির্বাচনে বাতিল করুক। হামাসের জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ¦ল হলে ইসরাইল সেটা করতেও পারে। ইতিমধ্যেই হামাস নেতাদের গ্রেফতার করে ইসরাইল এ ধরনের বার্তা দিয়েছে। আবার পূর্ব জেরুজালেমে ভোটগ্রহণে ইসরাইল এখনও সম্মতি দেয়নি। এসব অজুহাতে আব্বাস নির্বাচন বাতিল করার চেষ্টা করতে পারেন। অনেকে মনে করেন ভোট বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আব্বাস অজুহাত খুঁজছেন।