সৌদি যুবরাজের পছন্দ চীনা শাসন, মার্কিন সংস্কৃতি

-

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১০ এপ্রিল ২০২১, ০৫:৪০

ব্লাড অ্যান্ড অয়েল। বর্তমান সময়ের খুবই আলোচিত একটি বই। ব্রেডলি হোপ এবং জাস্টিন স্কেচক এ বইটিতে সৌদি আরবের বহুল আলোচিত ক্রাউন প্রিন্স ও দেশটির ডি-ফ্যাক্টো শাসক মোহাম্মাদ বিন সালমানের জীবনের অজানা কিছু অধ্যায় তুলে ধরেছেন। ব্যাপক আলোচিত এ বইয়ে সৌদি রাজপরিবার এবং এর ভেতরের অনেক অজানা অধ্যায় তুলে ধরা হয়েছে। ব্লাড অ্যান্ড অয়েলে সৌদি রাজপরিবারের অন্তরালের দৃশ্যপট, যুবরাজদের ব্যক্তিগত জীবন, দৃষ্টিভঙ্গিসহ অনেক কিছুই আলোচনায় এসেছে।

মোহাম্মাদ বিন সালমানের কাছে আমেরিকান সব কিছুই ভালো লাগে। জনপ্রিয় ভিডিও গেম কল অব ডিউটি থেকে শুরু করে অ্যাপলের যাবতীয় সব উপকরণ। পুরনো ফ্যাশনের বিগ ম্যাক অথবা খাবার হিসেবে ম্যাকডোনাল্ডসের বার্গার- সবকিছুই সৌদি যুবরাজের পছন্দ। এমবিএসকে পুরোপুরিভাবে মার্কিন সংস্কৃতি ও উপকরণের অন্ধভক্তই বলা যায়। তবে আমেরিকার অনেক কিছু ভালো লাগলেও মার্কিন প্রশাসন ও সরকার কাঠামোর বিষয়ে অবশ্য ভিন্ন চিন্তা রয়েছে তার। সরকারকাঠামো হিসেবে এমবিএসসের নিজস্ব পছন্দ হলো চীনের সরকারপদ্ধতি। কারণ তিনি মনে করেন, চীনা পদ্ধতিতে দেশ পরিচালনা করতে পারলে তার সিংহাসনটি যেমন নিরাপদ থাকবে তেমনি সৌদি আরবে আল সৌদের প্রভাব ও আধিপত্যও আরও অনেকদিন বহাল থাকবে।

বিন সালমান শুরু থেকেই পশ্চিমা মহলকে আস্থায় রাখার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। আর সে কারণেই, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তিনি সবসময়ই নিজেকে প্রগতিশীল, আধুনিক, উদারমনা এবং ধর্মনিরপেক্ষ মানসিকতার ব্যক্তিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। যদিও সৌদি আরবের শাসক পরিবার রক্ষনশীল হিসেবেই মানুষ জানেন।

এমবিএস সেখানে নিজেকে ব্যতিক্রম ও ভিন্নমাত্রার হিসেবে প্রমাণ করার জন্য সচেতনভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আর নিজেকে সেভাবে উপস্থাপন করতে গিয়ে তিনি শাসন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসার পর সৌদি আরব জুড়ে পশ্চিমা সংস্কৃতির নানা উপাদানের অন প্রবেশ ঘটিয়েছেন। সৌদি আরবে বেশ কয়েকদফা কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। সিনেমাহল চালু করা হয়েছে। নারীদের খেলাধুলার বড়ো কিছু ইভেন্টও আয়োজন করা হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করেছেন। এটি মূলত দীর্ঘ এক যুগের একটি চলমান প্রকল্পের রূপকল্প। যার উদ্দেশ্য হলো তেল নির্ভর সৌদি অর্থনীতিকে আরো বেশি বৈচিত্রময় করে তোলা। যদিও তার এতসব সংস্কারমূলক কার্যক্রমের তেমন কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া এখনো দেখা যায়নি।

ছোটখাটো যে কয়েকটা সংস্কারমূলক পদক্ষেপ তিনি নিয়েছিলেন তার বেশিরভাগই একের পর এক মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগের নীচে চাপা পড়ে যায়। এমবিএস এর বিরুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে এবং বাইরে প্রতিপক্ষকে হত্যা, সহিংসতা বৃদ্ধি ও গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ রয়েছে। তার সময়ে এসে সৌদি আরবে মৃত্যুদন্ড দেয়ার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর অধিকাংশক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার উদ্দেশ্যেই এই রায় দেয়া হচ্ছে। সৌদি আরবের যে কয়েক হাজার শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছে, তাদের ওপর মারাত্মকভাবে দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে। একইসাথে, মানবাধিকার কর্মী, বিরোধী নেতাকর্মী, ভিন্নমতাবলম্বী ধর্মীয় স্কলার এমনকী সৌদি রাজ পরিবারের সিনিয়র অনেক সদস্যকেও জেলে রাখা হয়েছে।

সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সামান্য একটি টুইট করলে কিংবা দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের কথা বললেও অনেককে মিথ্যা অভিযোগে গুম করা হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রেই জেলে আটক এই মানুষগুলোর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের কোনো সত্যতা মিলছে না। এমন একটি আলোচিত ঘটনা হচ্ছে সৌদি আরবের জনপ্রিয় ইসলামিক স্কলার সালমান আল আওদাহকে জেলে নেয়া ও মৃত্যুদন্ড দেয়ার ঘটনাটি। সালমান আল আওদাহ’র ওপর এমবিএস রুষ্ট হন যখন তিনি কাতার অবরোধ করার সৌদি অবরোধের বিরুদ্ধে টুইট করেন। তিনি কাতার ও সৌদি আরবের বন্ধুত্ব কামনা করে দোয়া করেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, সৌদি যুব প্রজন্মের কাছে সালমান আল আওদাহ ব্যাপক জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য হওয়ায় এমবিএস তাকে মুক্ত অবস্থায় রাখার সাহস পায়নি।

সৌদি আরবে কর্মরত সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদরা এক ধরনের দমবন্ধ অবস্থার মধ্যে আছেন। বিন সালমানের বিরুদ্ধে সৌদি আরবের বাইরে থেকে কথা বললেও যে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে তার বড়ো প্রমাণ ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক ও লেখক জামাল খাশোগজির নির্মম হত্যাকান্ড। খাশোগজির হত্যকান্ডের মধ্য দিয়ে এমবিএস মূলত সৌদি প্রবাসী নাগরিকদেরকেও একটি সতর্কবার্তা দিয়েছেন। খাশোগজির মতো একজন পরিচিত ব্যক্তিকে যদি এভাবে হত্যা করা হয় তাহলে এমন পরিণতি অন্য যে কারোই হতে পারে।

সৌদি যুবরাজের স্বৈরতান্ত্রিক মতের প্রতিফল সৌদি সীমানার বাইরেও প্রসারিত হয়েছে। শুধু ইয়েমেনে যে যুদ্ধের সূচনা তিনি করেছেন তা সাম্প্রতিক মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। ইয়েমেনের এ করুণ পরিনতির মূল কারনই ছিল সৌদি নেতৃত্বাধীন অবরোধ ও চলমান বোমাবর্ষণ।

এমবিএস এর নেয়া সৌদি অর্থনীতির রূপান্তর ও উদারীকরণ এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রগতিশীলতার চর্চাকে ইতিবাচক ও যুগান্তকারী হিসেবে দেখানো হলেও এগুলো এক ধরনের আইওয়াশ। অর্থনীতিকে উদার করার কথা বললেও সরকার, প্রশাসন ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে তিনি মোটেও সংস্কার করতে চাননি। উল্টো সৌদি আরবের রাজনৈতক ও সামাজিক কাঠামোগুলোকে তিনি অনেকটাই পরাধীন করে ফেলেছেন। চীনের ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্ট পার্টির সরকার পদ্ধতির আদলে তিনি বিরোধী দলহীন একটি সরকার কাঠামো গড়ার লক্ষ্য নিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, সৌদির ডি ফ্যাক্টো শাসক চীনের শাসন পদ্ধতির চেয়ে এক কাঠি এগিয়ে আরো বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন প্রয়োগ করতে চান।

গোটা সৌদি আরবে রাজ পরিবারের আধিপত্যকে আরো বৃদ্ধি করার জন্য তিনি নানামুখী কৌশল নিয়েছেন। দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে রাজ পরিবারকে সম্পৃক্ত করে এবং যুবরাজদের বিনিয়োগের মাত্রা বাড়িয়ে অর্থনীতির ভগ্নদশা দূর করারও চিন্তা করছেন। অনেকে মনে করেন তিনি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে মডেল সামনে রেখেই অগ্রসর হচ্ছেন।

২০১৯ সালে এক বানিজ্য সফরে চীনে গিয়ে বিন সালমান চীনের সন্ত্রাস বিরোধী আইন ও মৌলবাদ বিরোধী পদক্ষেপের প্রশংসা করেন। অথচ চীন এই দুটো আইন ব্যবহার করেই দেশটির জিনজিয়াং প্রদেশে থাকা ২০ লাখ উইঘুর মুসলিমের বিরুদ্ধে অত্যাচার করে যাচ্ছে। যেখানে এমবিএস একটু হলেও উইঘুর সম্প্রদায়ের পক্ষে কথা বলবেন বলে সবাই আশা করেছিল, সেখানে চীনকে উইঘুর নিধনের অবাধ লাইসেন্স দেয়ার মাধ্যমে তিনি চীনকে অনেক বড়ো ছাড় দিয়ে আসেন।

সেই সফরে সৌদি আরব ও চীনের মধ্যে ২৮ বিলিয়ন ডলারের মোট ৩৫টি অর্থনৈতিক ও বানিজ্য চুক্তিও সাক্ষরিত হয়েছিল। সৌদি যুবরাজ যেভাবে তার ক্ষমতাকে সংহত করতে চেয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র তাতে পরোক্ষভাবে সহায়তা করে গেছে। এমনকী খাশোগজি হত্যাকান্ডের পর বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার পরও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে এমবিএসকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। এর নেপথ্য কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তেল বানিজ্য স্বার্থ।

সৌদি আরব প্রতিবছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল অংকের সমরাস্ত্র কেনায় মার্কিন অর্থনীতির বিকাশেও সৌদি প্রভাব কম নয়। মোহাম্মাদ বিন সালমানও বুঝে গেছেন, তার সিংহাসনের নিরাপত্তা ও আল সৌদ বংশের অব্যহত যাত্রার জন্য পশ্চিমা সমর্থনের কোনো বিকল্প নেই। যদিও বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন সৌদি আরবের নাজুক মানবাধিকার পরিস্থিতি ও ইয়েমেন যুদ্ধের বিষয়ে বেশ কট্টর সমালোচনা করেছেন। তারপরও বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই অবস্থানও খুব একটা তাৎপর্যপূর্ন কিছু নয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব থেকে যে ধরনের সমর্থন ও সহায়তা চায়, তার জন্য সৌদি আরবে গণতন্ত্রের চেয়ে বরং আল সৌদ পরিবারের রাজতন্ত্র থাকলেই বেশি ভালো সাড়া পাওয়া যাবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিগত কয়েক বছর ধরেই সৌদি আরবের প্রধান প্রতিরক্ষা অংশীদার। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার আমলে সৌদি আরবের কাছে ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির চুক্তি করে গেছেন। রেকর্ড পরিমান অর্থের সমরাস্ত্র চুক্তি এবং তেল বানিজ্যের ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে, সৌদি যুবরাজ তেলসমৃদ্ধ রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশালী শাসক হিসেবে আগামীতেও আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে যাবেন। তার অংশীদার ও সহায়ক শক্তিরও তেমন একটা অভাব হবে না। ওআইসি এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির মূল নিয়ামক হওয়ার কারণে পশ্চিমা পরাশক্তিরাও সৌদি সমর্থনকে হারাতে চায় না।

বাইডেন প্রশাসন বিন সালমানের নানা কর্মকান্ড নিয়ে নিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছে। বাইডেন জানিয়েছেন, সৌদি আরব তার আভ্যন্তরিন রাজনীতি ও নীতি নির্ধারনে কতটা সংস্কার আনছে তার ওপরই ভবিষ্যতের মার্কিন-সৌদি সুসম্পর্ক নির্ভর করছে। তবে, মার্কিন বিশ্লেষকদের এক্ষেত্রে ভিন্ন অবস্থান রয়েছে। তাদের মতে বাইডেনের এখন মার্কিন স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।

বিন সালমান কোথায় কী মানবাধিকার লংঘন করে বেড়ালো, তা নিয়ে বাইডেনের ব্যতিব্যস্ত হওয়া অপ্রাসঙ্গিক। হয়তো এই সব নীতি নির্ধারকদের চাপে বাইডেন আগামীতে তার অবস্থাণে থাকতে পারবেন না। তেমনটা হলে বিন সালমানের চলার পথটা সামনের দিনগুলোতে আরো মসৃনও হয়ে যেতে পারে।