এবার পাকিস্তানকে কাছে চায় সৌদি আরব

-

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৬ মার্চ ২০২১, ০৭:৪৬

পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘদিন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল সৌদি আরবের। তবে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের হঠকারিতায় সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। এখন চরম বেকায়দায় আছেন যুবরাজ। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রবল ধাক্কা খেয়ে এবার তিনি পুরনো মিত্র পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকেছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিসরেরও একই অবস্থা।

মাত্র কয়েক মাস আগের কথা। পাকিস্তানের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে। এর মূল কারণ ছিল কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে ভারতের নিপীড়নমুলক কর্মকান্ড নিয়ে সৌদি নেতৃত্বাধীন ওআইসিকে ভূমিকা রাখতে অনুরোধ করেছিল ইসলামাবাদ। কিন্তু ভারতের ঘনিষ্ঠ সৌদি যুবরাজ তাতে সাড়া দেননি। বরং পরোক্ষভাবে ভারতের পক্ষ নেয় সৌদি সরকার।

এদিকে ইরান ও তুরস্কের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা এবং ওআইসির বিকল্প প্ল্যাটফরম দাঁড় করানোর প্রচেষ্টায় ইসলামাবাদের শামিল হওয়ায় ক্ষুদ্ধ হন সৌদি যুবরাজ। পাকিস্তানকে চাপে ফেলতে তিনি নানা কৌশল গ্রহন করেন। সৌদি আরবের সাথে যোগ দেয় আরব আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ। তারা পাকিস্তানকে অর্র্র্থনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত করার সিদ্ধান্ত নেন।

ইসলামাবাদকে ২০১৮ সালে সৌদি আরবের দেওয়া ৩০০ কোটি ডলার ঋণ নির্ধারিত সময়ের আগেই ফেরত চায় রিয়াদ। সৌদি আরবের ধারণা ছিল এতে পাকিস্তান মাথা নোয়াবে। কিন্তু তা হয়নি। চীনের কাছ থেকে ধার করে ২০০ কোটি ডলার পরিশোধ করে পাকিস্তান। এদিকে আরব আমিরাতও পাকিস্তানীদের জন্য ভিসা বন্ধ করে দেয়।

এরই মধ্যে বিশ্বে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র বদলে যেতে থাকে। হোয়াইট হাউসে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। যুবরাজের মিত্র ডোনাল্ড ট্রাম্প বিদায় নেন। ক্ষমতায় আসেন যুবরাজের প্রতি বৈরি মনোভাবের জো বাইডেন। শুরু হয় যুবরাজের ঘোর অমানিশার দিন। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে এরই মধ্যে বিশিষ্ট সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যায় যুবরাজের জড়িত থাকার তথ্য ফাঁস হয়েছে। হোয়াইট হাউজ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যুবরাজ নয় বাদশাহর সাথে তারা সর্ম্পক বজায় রাখতে আগ্রহী।

চাপের মুখে সৌদি যুবরাজ আবার ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। পাকিস্তানের সহায়তা এখন তার জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই তিনি ঋণের বাকি ১০০ কোটি ডলার আদায় স্থগিত করেছেন। অন্য কথায় ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছেন। পাকিস্তানে বাকিতে ৩২০ কোটি ডলারের তেল বিক্রির চুক্তি থেকেও সরে আসতে চাইছিল সৌদি আরব। সেটাও বাতিল করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এখন পাকিস্তানে আবার বিনিয়োগের দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে সৌদি আরব।

পাকিস্তান সরকার সম্প্রতিক দিনগুলোতে সৌদি আরবের কড়া সমালোচনা করেছে। ইরান ছাড়া অন্য কোনো দেশ প্রকাশ্যে সৌদি আরবের এমন সমালোচনা করেনি । এমনকি সৌদি আরবকে বাদ দিয়ে তুরস্ক ও ইরানের দিকেও হাত বাড়ানোর কথা জানিয়েছে পাকিস্তান। এ নিয়ে সৌদ আরব কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখালেও পাকিস্তানের অবস্থানে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি।

প্রশ্ন উঠছে তাহলে এখন কেন এমন ইউটার্ন নিল সৌদি আরব? আসলে সৌদি রাজতান্ত্রিক শাসকের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে যাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। ইতোমধ্যে ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসন বন্ধের জন্য কঠোর বার্তা দিয়েছেন বাইডেন। সৌদি আরবে অস্ত্র রফতানি বহুলাংশে বন্ধ করে দিয়েছেন। ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার উদ্যোগ নিয়েছেন বাইডেন। সবশেষে এসেছে খাশোগি হত্যার নথি প্রকাশ।

সৌদি রাজতন্ত্র এখন সত্যিকার অর্থেই অসহায় হয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে মুসলিম বিশ্বে তার প্রভাবের দ্রুত ক্ষয়। মৃতপ্রায় ওআইসির বিকল্প সংস্থা তৈরির জন্য তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া, কাতার ও পাকিস্তানের প্রচেষ্টাও সৌদি আরবের বড় মাথাব্যথার কারণ।

তবে সবার ওপরে আছে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত নীতি। এখন টিকে থাকার জন্য সৌদি আরবের প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প শক্তি চীনের সহায়তা। আর চীনকে কাছে পেতে সৌদি আরবের দরকার বেইজিংয়ের ঘনিষ্ট ইসলামাবাদের সহায়তা। সত্তরের দশকে পাকিস্তানের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্র বেইজিংয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছিল।

সৌদি আরব চাচ্ছে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার সেতুবন্ধন হোক পাকিস্তান। সৌদি আরবের মতই একই উপলব্ধি জন্মেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশরের স্বৈরশাসকদেরও। তারাও এখন পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক চাচ্ছে।

শুধু যে সৌদি আরবের পাকিস্তান নীতি পরিবর্তন হচ্ছে তা নয় আরব আমিরাতও সম্প্রতি পাকিস্তানকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে টেলিফোনে কথাও বলেছেন আবু ধাবির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি সম্প্রতি মিশর সফর করে প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পাকিস্তানে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে মিশরের ব্যবসায়ীরা।

দীর্ঘদিন মার্কিন বলয়ে থাকা সৌদি আরবের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ততটা ঘনিষ্ট নয়, যতটা ঘনিষ্ট ইরান ও পাকিস্তানের সঙ্গে। তবে সৌদি আরব চাচ্ছে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উষ্ণ করতে। দেশটির পরমাণু কর্মসূচিতে সহায়তা দিচ্ছে চীন। সৌদি আরবে ইউরেনিয়াম কারখানা তৈরি করেছে চীন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল সৌদি আরবের পরমাণু কর্মসূচিতে বাধা দিলে চীনের সহায়তায় তা এগিয়ে নিতে চায় রিয়াদ। সৌদি যুবরাজ বলেছেন, ইরান পরমাণু শক্তির অধিকারী হলে তার দেশও একই পথে হাটবে।

অর্থনৈতিক কারণেও চীনমুখী হতে চায় সৌদি আরব। সৌদির আয়ের দুই তৃতীয়াংশই আসে তেল বিক্রি করে। আর চীন বিশ্বের বৃহত্তম তেল আমদানিকারক। সৌদি আরবের তেলের ওপর এখন আর নির্ভরশীল নয় যুক্তরাষ্ট্র। চীনকে অনেক কম দামে তেল দিচ্ছে ইরান। সৌদি আরবও সেপথে হাটতে চায়। চীনও নিশ্চয় এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি হবে না।

ইরানের পর সৌদি আরবের সঙ্গেও ঘনিষ্ট মিত্রতা তৈরি করতে সক্ষম হলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য খর্ব করতে সক্ষম হবে চীন। এটা হবে চীনের বিশাল বিজয়। ২০১৯ সালে সৌদি ও ইরানের মধ্যে বৈরিতা নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এরপর ইরানে ৪০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগে চুক্তি করে চীন।

এবার সৌদির বৃহত্তম তেল আমদানিকারক হতে সক্ষম হলে চীন হতে পারবে মধ্যপ্রাচ্যের বড় মধ্যস্তকারী। এই পথ সহজেই খুলে দিতে পারে পাকিস্তান। তাই সৌদি শাসকরা এখন পাকিস্তানের সহায়তার জন্য মরিয়া।

কূটনৈতিক সর্ম্পক কখনও একতরফা হয় না। অর্থনৈতিক সংকটে থাকা পাকিস্তানও চাচ্ছে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের মতো বড় অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গেও সম্পর্ক ঝালাই করতে। আবু ধাবির যুবরাজ নাহিয়ানের সঙ্গে ইমরান খানের টেলিফোন আলাপ ও মিশরে কুরেশির সফর এরই অংশ।

সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের সাথে নতুন বোঝপড়ায় লাভবান হতে যাচ্ছে পাকিস্তান। চীনের বিনিয়োগে গড়ে উঠা গোয়াদর বন্দরে এক হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগে তেল শোধনাগার তৈরি করার প্রক্রিয়া আবার জোরদার করেছে সৌদি আরব। আগামী ৬ মাসের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে বলে আশা করছেন দুদেশের কর্মকর্তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি আরব ও আমিরাত দেখেছে পাকিস্তানকে চাপ দিয়ে কোনো কাজ হয়নি। তাই এখন তারা নিজেরাই পিছু হটেছে। সৌদি আরব ও আমিরাত আবার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়লেও ইসলামাবাদ তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলবে। এক্ষেত্রে পাকিস্তান বেশ দক্ষতার সাথে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করে চলেছে।

তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য জোরদার করার জন্য পাকিস্তান চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। যেমন তেহরান, ইস্তাম্বুল ও ইসলামাবাদের মধ্যে রেললাইন তৈরির উদ্যোগ এগিয়ে চলছে। আবার ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে গ্যাস পাইপলাইন তৈরি হচ্ছে। ফলে সৌদি আরব ও আমিরাত চাচ্ছে না মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পরমাণু শক্তির অধিকারী পাকিস্তানকে দূরে সরিয়ে রাখতে।

তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের কাছ থেকে যে দুর্ব্যবহার এর আগে পাকিস্তান পেয়েছে তা ভুলে যাওয়া তাদের জন্য কঠিন। তাই ভবিষ্যতে তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে পাকিস্তানের মিত্রতার বন্ধন আরও দৃঢ় হবে।