আলজাজিরা নিয়ে নতুন বির্তক


  • মোতালেব জামালী
  • ০৪ মার্চ ২০২১, ১৫:১৬

কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল আলজাজিরা যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান বা রক্ষণশীল দর্শকদের জন্য একটি ডিজিটাল টিভি চ্যানেল চালু করেছে। নতুন এই প্রোগ্রামটির নাম রাখা হয়েছে ‘রাইটলি’। ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকেই ‘রাইটলি প্রোগ্রামের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আলজাজিরা এমন একটি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীলদের জন্য এই উদ্যোগ নিল, যখন ডানপন্থি মিডিয়াগুলোতে উগ্রপন্থা প্রচারণা অনেক বেড়ে গেছে। কেন আলজাজিরা যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল দর্শকদের টানতে চাইছে?

আলজাজিরা কর্তৃপক্ষের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার রক্ষণশীল সংবাদমাধ্যমের সমর্থন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রিপাবলিকানরা। এ কারণে দর্শকদের বড় একটি অংশ আলজাজিরার নতুন এই উদ্যোগের প্রতি আকৃষ্ট হবে। ‘রাইটলি’ নামের এই প্রোগ্রামটির এডিটর ইন চীফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থি সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজের সাবেক সাংবাদিক স্কট নরভেল। তিনি ফক্স নিউজে ১৬ বছর বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন।

২০১৩ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে আলজাজিরার উপস্থিতি রয়েছে। এ বছর সংবাদ মাধ্যমটি বাম ঘেষা ‘আলজাজিরা আমেরিকা’ নামে একটি নিউজ চ্যানেল ও ওয়েবসাইট চালু করে। যদিও ২০১৬ সালে এই চ্যানেলটি বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু তার পরও আলজাজিরা অনলাইন ‘এজে প্লাস’ ভিডিও নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের উপস্থিতি বজায় রেখেছে।

আলজাজিরা কর্তৃপক্ষের ‘ রাইটলি’ চালুর সিদ্ধান্তের কথা যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত সংবাদকর্মী ও ষ্টাফদের মধ্যে অনেকেই হতাশা ও ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, আলজাজিরা কর্তৃপক্ষের অঙ্গিকার ছিল তারা কথা বলার অধিকার বঞ্চিত হয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে চলে যাওয়া মানুষদের অধিকার ফিরিয়ে আনতে কাজ করবে। কিন্তু এখন তারা তাদের সেই অঙ্গিকার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

আলজাজিরার শতাধিক সংবাদ কর্মী ও ষ্টাফ এক খোলা চিটিতে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে ‘রাইটলি’ প্রোগ্রাম চালুর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। তারা বলেছেন, কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত আলজাজিরার মিশন ও নীতিমালার পরিপন্থি’। এটা প্রতিষ্ঠানের ব্রান্ড ও কাজের অপূরনীয় ক্ষতি সাধন করবে।

আলজাজিরার কর্মীদের এই বিরোধিতা প্রত্যাশিত ছিল। শুরু থেকেই আলজাজিরা ডানপন্থি রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আসছে। আঞ্চলিক রাজনীতি হোক, আর আন্তর্জাতিক রাজনীতিই হোক সব ক্ষেত্রেই এই নীত মেনে চলা হচ্ছে। কিন্তু ‘রাইটলি’ প্রোগ্রাম চালুর ক্ষেত্রে সেই নীতিমালা লংঘন করা হয়েছে। আহমেদ শিহাব ইলদিন নামের একজন সিনিয়র রিপোর্টার টুইটারে তার মত প্রকাশ করে বলেন, ‘কথা বলার অধিকার বঞ্চিত মানুষদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার কি হবে? আলজাজিরা কর্তৃপক্ষ কি মনে করছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকানরা তাদের কথা বলার অধিকার থেকে বঞ্চিত? এটি নিশ্চিত ভাবেই একটি বিভ্রান্তিপূর্ণ পদক্ষেপ। এটা কোনো উদ্ভাবন নয়। কোনো অগ্রগতি বা প্রগতির চিন্তাও নয়। এটা হচ্ছে রাজনীতি ও প্রতারনা।

আলজাজিরার উপস্থাপক ও প্রোডিউসার দিনা তাকরুরি টুইটে বলেন, ‘আমি ১০ বছরের বেশি সময় ধরে আলজাজিরায় কাজ করছি। এখানে আমরা যে মূল্যবোধ ভিত্তিক সাংবাদিকতাকে ধারণ করি তা হচ্ছে, কথা বলার অধিকার বঞ্চিত মানুষদেরকে তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কাজ করা । সত্য কথাটা বলাকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমাদের আদর্শকে ধারণ করা। আমি জানি যে এটাই হচ্ছে আলজাজিরা। আর এই মিশন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমাদের বেশ কিছু সহকর্মী জীবন ও নিরাপত্তার ঝুকি নিয়েছেন।

শুধু আলজাজিরার সংবাদকর্মী ও স্টাফরাই নন, বাইরেরও অনেকে আলজাজিরা কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তে বিষ্মিত হয়েছেন। কারণ আলজাজিরার নীতিমালা সম্পর্কে যারা জানেন তারা এ বিষয়টিকে খুব সহজভাবে নিতে পারছেন না। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ^বিদ্যালয়ের মিডিয়া ও পাবলিক অ্যাফেয়ার্স বিভাগের অধ্যাপক উইলিয়াম ইউমানস আলজাজিরার নীতিমালা ও কার্যক্রম সম্পর্কে সব সময় খোঁজ খবর রাখেন। তিনি ২০১৭ সালে এ বিষয়ে একটি বইও লিখেছেন।

‘রাইটলি’ প্রোগ্রাম সম্পর্কে তিনি বলেন, সাধারণত নতুন কোনো প্রোগ্রাম চালু করার আগে আলজাজিরার বিভিন্ন বিভাগের ব্যবস্থাপক গণ কাজের ধারা, সম্পাদকীয় নিয়ন্ত্রণ, মূল্যবোধ ঠিক রাখাসহ অন্যান্য সব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। কিন্তু ‘রাইটলি’ প্রোগ্রাম চালুর ব্যাপারে সেই ধারাটি অনুসরণ করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘যখন রাইটলি প্রোগ্রাম চালুর ঘোষনাটি দেয়া হলো তখন মানুষ স্তম্ভিত হয়েছে। আলজাজিরার বিভিন্ন বিভাগের ব্যবস্থাপকদের অনেকেই হয়তো বিষয়টি জানতেন না।

মিডিয়া শিল্প বিশ্লেষক কেন ডক্টর আলজাজিরার এই নতুন উদ্যোগ সম্পর্কে বলেন, ‘ সবার মনেই স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রশ্নটি জাগবে, যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষনশীল দর্শক-শ্রোতাদের কেন প্রয়োজন হলো আলজাজিরার? সেখানে ব্যবসার সুযোগ আছে, সেখান থেকে আপনি প্রচুর অর্থ কামাতে পারবেন এ জন্যই কি এই দর্শক-শ্রোতাদের প্রয়োজন হয়ে পড়লো?’ কিংবা সেখানে কি রাজনৈতিক এজেন্ডা আছে যেটাকে সার্ভ করতে চায় আলজাজিরা? তিনি প্রশ্ন তোলেন আসলে আলজাজিরা কর্তৃপক্ষ কি চান?’

আলজাজিরা ১৯৯৬ সালে আরবি ভাষার চ্যানেল চালু করে মধ্যপ্রাচ্যের সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠে। চ্যানেলটি এই অঞ্চলের স্বেচ্ছাচারি শাসকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা, ইরাক ও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন চালানোর প্রতিবেদন প্রচার করে পশ্চিমা টিভি চ্যানেলগুলোর ‘সম্প্রচার উপনিবেশবাদ’ ও সামরিক আপপ্রচারের বিরুদ্ধে একটি একটি শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে আলজাজিরা।

এর প্রতিক্রিয়ায় ২০০৪ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ কাতারে আলজাজিরার সদর দফতরে বিমান হামলা চালিয়ে সেটি গুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন বলে সে সময়ে ডেইলি মিরর পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এই খবরে বলা হয়, বুশ আলজাজিরার প্রতি ক্ষোভ থেকেই এমন মন্তব্য করেছিলেন। বুশ অত্যন্ত সিরিয়াস ভাবেই কথাটি বলেছিলেন এবং তিনি আলজাজিরার সদর দফতরে হামলার সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়েই ফেলেছিলেন। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের সময় সেখানে আলজাজিরার ব্যুরো অফিসে বোমা হামলা চালায় মার্কিন বাহিনী। এতে সেখানে অবস্থানরত একজন সাংবাদিক নিহত হন।

এরপর ২০০৬ সালে আলজাজিরা ইংরেজি চ্যানেল চালু করার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি আন্তর্জাতিক মিডিয়া অঙ্গনেও অবস্থান পাকাপোক্ত করে নেয়। আলজাজিরার প্রয়োজনীয় জনবল ও আর্থিক সামর্থ্য থাকার কারনে তারা এমন সব বিষয়ের উপর প্রতিবেদন সম্প্রচার শুরু করে যা আন্তর্জাতিক অন্য কোনো মিডিয়া করার সামর্থ্য রাখেনা বা সব সময় করতে পারেনা।

আলজাজিরা তার আগের সেই নীতিমালা ও অবস্থান থেকে সরে এসে কেন যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থি’ দর্শক-শ্রোতাদের সমর্থন আদায়ের জন্য ‘রাইটলি’ প্রোগ্রাম চালু করতে যাচ্ছে সে প্রশ্নটি সবাইকে ভাবাচ্ছে। বিশ্লেষকরা এখানে বেশ কয়েকটি বিষয়কে সামনে এনেছেন।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন আলজাজিরার মাধ্যমে কাতার ‘ সফট পাওয়ার বা মৃদু ক্ষমতা চর্চা’র কৌশলকে কাজে লাগিয়ে থাকে। রাজনীতি বিজ্ঞানী জোসেফ নায়ী’র মতে, ‘মৃদু বা হাল্কা’ ক্ষমতা চর্চার কৌশলটা হচ্ছে কোনো একটি এজেন্ডাকে সামনে এনে অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করে তার সমর্থন লাভ করা। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে কাউকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে সেই এজেন্ডার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড় তোলা।

গত ২৫ বছরে কাতার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক ইস্যুর বা বিরোধের মীমাংসার ক্ষেত্রেই মধ্যস্থতাকারি কিংবা মধ্যস্থতায় উদ্যোগ গ্রহনকারির ভূমিকা পালন করেছে। এটি কাতারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল।

আলজাজিরার মতো একটি শক্তিশালী টিভি চ্যানেল কাতারের এই ভূমিকা পালনে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। ‘রাইটলি’র মতো নতুন প্রোগ্রাম চালুর ক্ষেত্রেও কাতারের এই লক্ষ্য কাজ করছে। এখানে ভৌগলিক, জনসংখ্যা বা রাজনৈতিক ইস্যু কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। একই লক্ষ্য অর্জণে আলজাজিরা কর্তৃপক্ষ এর আগে ‘আলজাজিরা আমেরিকা’ চ্যানেল চালু করেছিল। যদিও সেটি তার কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।

২০১৭ সালে কাতারের উপর সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও বাহরাইন অবরোধ আরোপ করেছিল। কাতারের ‘সফট পাওয়ার’ চর্চার কারণেই দেশটি তার উপর আরোপিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। কাতার অবরোধ আরোপকারি দেশগুলোর দেয়া কোনো শর্তই মেনে নেয়নি। এবং শেষ পর্যন্ত এসব দেশ অবরোধ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় এবং বিজয়ীর হাসি হাসে কাতার। এক্ষেত্রে আলজাজিরাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রে গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়ের পর রিপাবলিকানদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া ডানপন্থি মিডিয়া হাউস হিসেবে পরিচিত ফক্স নিউজের সাথেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আলজাজিরা কর্তৃপক্ষ এই সুযোগটি গ্রহন করে সেই ফাকা স্থানটি পূরণ করতে চাচ্ছে। তারা ‘বিভক্ত রিপাবলিকনদের ভয়েস’ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে চাইছে। এক্ষেত্রে সঠিক সাংবাদিকতা ও সম্পাদকীয় নীতিমালা তাদের সেই লক্ষ্য পরণে সহায়ক হতেও পারে। এখন কেবল অপেক্ষার পালা, দেখার পালা রিপাবলিকানদের ‘ভয়েস’ হিসেবে আলজাজিরা কতটুকু নিজেদেরকে তুলে ধরতে পারে।