গদি কাঁপছে সৌদি যুবরাজের


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৩ মার্চ ২০২১, ১৩:৪৭

যুক্তরাষ্ট্র সরকার সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার রিপোর্ট প্রকাশ করার পর সবার মনে প্রশ্ন জাগছে, খুনে জড়িত সৌদি যুবরাজের ভবিষ্যৎ কোন দিকে গড়াচ্ছে। মোহাম্মদ বিন সালমান কি ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন? একজন অভিযুক্ত খুনিকে ক্ষমতায় রেখে সৌদি আরব কি মুসলিম বিশ্বে নেতৃত্বের আসনে থাকতে পারবে?

খাশোগি হত্যায় মোহাম্মদ বিন সালমান বা এমবিএসের জড়িত থাকার তথ্য আগেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। তবে এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ সরকারিভাবে এটি স্বীকার করল। যা সৌদি যুবরাজের জন্য সুনামির মতো আঘাত বয়ে এনেছে। এর মধ্যদিয়ে স্বীকৃতি পেল সৌদি যুবরাজ একজন অভিযুক্ত খুনি। আর এ রকম একজন ব্যক্তিকে শাসক হিসেবে রেখে সৌদি আরব প্রতিনিয়ত পিছিয়ে পড়বে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সৌদি যুবরাজ এখনই হয়তো খাশোগি হত্যায় দণ্ডিত হচ্ছেন না। তবে অদূর ভবিষ্যতে সেটি যে ঘটবে না, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্র সরকার তার বিরুদ্ধে এমন রিপোর্ট প্রকাশ করতে পারে, কদিন আগেও এমনটা আগে কেই ভাবতে পারেনি।

এখন প্রতিনিয়ত খুনের অভিযোগ মাথায় নিয়ে চলতে হবে সৌদি যুবরাজকে। এতে নিজ দেশে এবং বহির্বিশ্বে তার জনসমর্থন দারুণভাবে কমতে থাকবে। সারা বিশ্বে তিনি নিন্দিত হলেও নিজ দেশের একটি অংশের কাছে তার জনপ্রিয়তা ছিল। খাশোগি হত্যার রিপোর্ট প্রকাশের পর সেটিও দ্রুত কমে যাবে।

বিশ্বে তেলের চাহিদা ও দাম ক্রমাগত কমে যাওয়ায় সৌদি আরবের অর্থনীতি কঠিন সময় পার করছে। দেশটি তেল বিক্রির আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এ অবস্থায় বিদেশি বিনিয়োগ পেতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। কিন্তু খাশোগি হত্যার রিপোর্টের পর তার সেই চেষ্টা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। একজন খুনি চরিত্রের অস্থিরমনা শাসকের দেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে না বড় ব্যবসায়ীরা। এতে দীর্ঘমেয়াদে সৌদি অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ হতে থাকবে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই রিপোর্টের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। আঞ্চলিকভাবে এতে সৌদি আরবের প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্ক ও ইরান সুবিধাজনক অবস্থানে চলে যাবে। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তুরস্ক বেশ কয়েক বছর ধরে যে চেষ্টা চালাচ্ছে তার পাল হাওয়া লাগবে। অন্যদিকে ইরানও এতে শক্তিশালী হবে।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার স্পষ্ট করে দিয়েছে যে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তিতে ফেরার জন্য তারা যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে সৌদি সরকারকে মাথা ঘামাতে দেবে না ওয়াশিংটন। পরমাণু চুক্তিতে ফিরতে পারলে সৌদিকে টেক্কা দেওয়ার সক্ষমতা অর্জন করবে ইরান।

ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসন নিয়ে আগেই বেশ চাপে পড়েছিল সৌদি আরব। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইয়েমেনে আগ্রাসন বন্ধের জন্য সৌদিকে চাপ দিয়েছেন এবং অস্ত্র বিক্রি সীমিত করেছেন। এখন খাশোগি হত্যার রিপোর্ট যুবরাজের জন্য মরার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভূত হবে। শিগগিরই ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসন বন্ধ করতে বাধ্য হবেন সৌদির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বে থাকা যুবরাজ। প্রতিবেশি ইয়েমেন থেকে সৌদি আরব সরে গেলে ইরানের প্রভাব বাড়তে থাকবে। এতে সৌদি আরব আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে।

খাশোগি হত্যার রিপোর্টের পর মুসলিম বিশ্বে সৌদি আরবের ভাবমূর্তি বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। সৌদি যুবরাজই এখন কার্যত দেশটির শাসক। একজন অভিযুক্ত খুনিকে ইসলামি বিশ্বের নেতা হিসেবে মানবে না সারা বিশ্বের মুসলিমরা। তবে মুসলিম দেশগুলোতে সৌদি যুবরাজের মত নিষ্ঠুর স্বৈরশাসকদের প্রাধান্য থাকায় এখনই হয়তো বেশি প্রশ্নে মুখে পড়তে হবে না যুবরাজকে। তবে জনমনে তিনি ঘৃণার পাত্র হয়েই থাকবেন।

প্রায় এক শতাব্দী ধরে সৌদি বাদশারা মক্কা ও মদীনার দুটি পবিত্রতম মসজিদের জিম্মাদার বা কাস্টডিয়ান উপাধি ধারণ করছেন। প্রশ্ন উঠছে, সৌদির বর্তমান প্রবীণ ও অসুস্থ বাদশা মারা গেলে তার ছেলে এমবিএসও কি এমন উপাধি ধারণ করার যোগ্যতা রাখবেন?

সৌদি আরবের ওপর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সারা বিশ্বে মুসলিম জন মানসে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এক সময় সৌদি আরব মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও মানবিক সংকটে পাশে দাড়াত। কিন্তু যুবরাজ দেশটির কার্যত শাসকের আসনে বসার পর সেই দৃশ্য বদলে যায়। মুসলিম বিশ্বের সংকটে পাশে দাড়ানো তো দূরের কথা, বরং বহু সংকট তিনি নিজেই সৃষ্টি করেছেন। ইয়েমেনে আগ্রাসন, কাতারের ওপর অবরোধসহ নানা সংকট সৃষ্টির মাস্টারমাইন্ড ছিলেন বিন সালমান।

রাজনৈতিক ইসলামের উত্থান ঠেকাতে মুসলিম বিশ্বে বিভিন্ন দেশে স্বৈরশাসকদের ক্ষমতায় বসানো এবং তাদের মদত দেওয়ার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকায় রয়েছেন এমবিএস। ইহুদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে কয়েকটি মুসলিম দেশের তড়িঘড়ি করে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মূল হোতা ছিলেন সৌদি যুবরাজ। এর মাধ্যমে তিনি নিপীড়িত ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতার আকাংখায় ছুরিকাঘাত করেছেন।

তুরেস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তায়েপ এরদোয়ান ও ইমরান খানের মতো মুসলিম বিশে^র প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন যুবরাজ। তার বন্ধু হয়ে উঠছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি । যিনি মুসলিমদের ওপর নিপীড়নে অভিযুক্ত। তার ঘনিষ্ঠ ছিল আরেক ইসলামোফোবিক নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। মিশরের স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আরেক নিপীড়ক শাসক জায়েদ আল নাহিয়ানেও সঙ্গে তার মাখামাখিও সুবিদিত।

পরিবর্তিত বৈশি^ক পরিস্থিতিতে সৌদি যুবরাজকে এসব শাসকরা কতটা সুরক্ষা দিতে পারবেন তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। লিবিয়ার স্বেচ্ছাচারী নেতা খলিফা হাফতারকে ক্ষমতায় বসানো নিয়ে সৌদি আরবের দীর্ঘদিনের খেলাও ভণ্ডুল হতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। খাশোগি হত্যার রিপোর্টের পর দ্রুতই ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসন বন্ধ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রশ্ন উঠেছে, সৌদি যুবরাজকে খাশোগি হত্যার জন্য বিচারের মুখোমুখি হতে হবে কিনা। প্রেসিডেন্ট বাইডেন যুবরাজের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকার রিপোর্ট প্রকাশের পরপরই সৌদির ৭৬ জনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও তাতে যুবরাজের নাম নেই। এটা নি:সন্দেহে হতাশাজনক। তবে যুবরাজের বিরুদ্ধে নমনীয় অবস্থান নেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা শুরু হয়েছে। দেশটির অনেক আইনপ্রণেতাও যুবরাজকে কাঠগড়ায় দাড় করানোর দাবি তুলেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাট সদস্য এবং ওবামা প্রশাসনের মানবাধিকার বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী টম মালিনস্কি বলেছেন, যুবরাজের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের সংসদে খাশোগি হত্যায় জড়িতদেরও বিচারের দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাব উঠছে।

প্রভাবশীল ডেমোক্র্যাট নেতা ও প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি খাশোগি হত্যার রিপোর্ট প্রকাশের পর এক বিবৃতিতে বলেছেন, সৌদির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সম্পর্ক অবশ্যই পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। খাশোগি হত্যায় জড়িতদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। তিনি বলেন, সৌদির জানা উচিত যে তারা যেসব অপকর্ম করছে তার দিকে বিশে^র দৃষ্টি আছে। এজন্য আমরা তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করবই।

প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাট নেতা ও হাউস ইন্টেলিজেস্ট কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডাম বি স্কিফ বলেছেন, যুবরাজকে কঠোর শাস্তির আওতায় না আনা হতাশাজনক। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার এখন সরকারিভাবেই স্বীকার করল যে সৌদি যুবরাজের হাতে রক্ত রয়েছে। আর এই রক্ত একজন আমেরিকার বাসিন্দা ও সাংবাদিকের। এটা তো সাংঘাতিক ব্যাপার। এখনই বাইডেনের উচিত খাশোগি হত্যায় যুবরাজকে সরাসরি শাস্তি দেওয়া।

একথা সবারই জানা যে ভূরাজনীতির খেলায় আজ যিনি নায়ক কাল তিনিই ভিলেনে পরিণত হতে পারেন। এমনটাই ঘটেছে সৌদি যুবরাজের ক্ষেত্রে। কিছুদিন আগেই তার কতই না দাপট ছিল! আর এখন তিনি খুনে অভিযুক্ত।

ভূরাজনীতির খেলায় তিনি হয়তো শিগগিরই ফেরারি আসামি হতে পারেন, হতে পারেন দণ্ডিত। সুদানের তিন দশকের স্বৈরশাসক ওমল আল বশির এখন আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি। খাশোগি হত্যা কিংবা ইয়েমেনে গণহত্যার জন্য যুবরাজের এমন পরিণতি হবে না, তার গ্যারান্টি কে দিতে পারে?