দুবাইর রাজকুমারীর পালানোর দুঃসাহসিক অভিযান


  • মেহেদী হাসান
  • ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৫:০২

রাজপ্রাসাদ থেকে পালিয়ে যাওয়ার দুঃসাহিক এক অভিযানে নেমেছিলেন দুবাইয়ের এক রাজকুমারী। এজন্য ওমান থেকে পাড়ি দেন আরব সাগর। সাগর পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছার পর বিমানে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া ছিল তার লক্ষ্য। ৮ দিন সমুদ্র যাত্রার পর পৌঁছে যান ভারতীয় উপকূলে। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো না রাজকুমারীর। পিতার পাঠানো কমান্ডো বাহিনী অপহরণ করে দুবাই ফিরিয়ে নেয় তাকে। এই রাজকুমারীর নাম প্রিন্সেস লতিফা। তার শ্বাসরুদ্ধকর অপহরণ ঘটনা এবং পরবর্তীতে বন্দি রাখার চাঞ্চল্যকর ঘটনা ফাঁস হয়েছে প্রায় তিন বছর পর। এ ঘটনা হার মানিয়েছে হলিউড সিনেমাকেও।

প্রিন্সেস লতিফাকে কারা ধরিয়ে দিল, তা নিয়েও চলছে অনুসন্ধান। ফরাসি যে গোয়েন্দা তার পলায়ন পরিকল্পনা করেছিল, তার দিকেই আঙুল তুলছেন অনেকে। প্রিন্সেস লতিফার পলায়ন অভিযান এবং তাকে অপহরনের ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ব্যর্থ এ পলায়ন অভিযানের পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি বন্দিজীবন যাপন করছেন।

অপহরণের পর দুবাইয়ের একটি ভিলায় বন্দি রাখা হয় লতিফাকে। বন্দি অবস্থায় গোপন ফোনের মাধ্যমে প্রিন্সেস লতিফার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারতেন তার ঘনিষ্ঠ দুয়েকজন বন্ধু। কিন্তু হঠাৎ করে সেটাও বন্ধ হয়ে যায় । দীর্ঘদিন তার সাথে বাইরের জগতের কারো কোনো যোগাযোগ নেই। ফলে তার জীবন নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন ঘণিষ্ঠজনরা।

জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় লতিফার সাথে যারা গোপনে যোগাযোগ রাখতেন তাদের মধ্যে একজন তার মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষক টিনা। তিনি তাকে সর্বশেষ যখন দেখেন সেটা ছিল ভারত মহাসাগরে একটি ইয়টের ডেকে। সময়টি ছিলো ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। লতিফা গোপনে দুবাই থেকে সমুদ্র পথে ভারত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার যে অভিযানে নামেন তাতে টিনাও তার সাথে ছিলেন।

দুবাই শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাখতুমের ২৫ সন্তানের একজন হলেন প্রিন্সেস লতিফা। দুবাই ছাড়ার আগে লতিফা একটি ভিডিও বার্তা রেকর্ড করে রাখেন। ভিডিও বার্তায় প্রিন্সেস লতিফা জানায়, হতে পারে এটা আমার জীবনের শেষ ভিডিও। আমি দুবাই ছাড়তে চাই। কারন আমাকে গাড়ি চালাতে দেয়া হয় না। আমাকে কোথাও যেতে দেয়া হয় না। দুবাই থেকে কোথাও যাওয়ার অনুমতি নেই আমার। ২০০০ সালের পর থেকে আমি আর দেশের বাইরে যেতে পারিনি। পড়ালেখাসহ স্বাভাবিক জীবন যাপনের কোনো অধিকার আমার নেই।

লতিফা বলেন, ভবিষ্যত নিয়ে আমি আশাবাদী। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখব আমি আজ আমার ইচ্ছামত সব কিছু করতে পারছি। এমনটা যদি সত্যি সত্যি ঘটে তখন আমার কেমন লাগবে তা ভাবতে পারছি না। আমি সত্যিই এমনটা চাই।

প্রিন্সেস লতিফার পাসপোর্টের ওপর তার অধিকার ছিল না। তিনি সার্বক্ষনিক নজরদারিতে ছিলেন। এ অবস্থায় দুবাই ত্যাগ করার জন্য তাদের বিকল্প পথ বেছে নিতে হলো। তারা জাহাজে করে ওমানের তীর ঘেষে দুবাই ছাড়েন। আন্তর্জাতিক পানি সীমায় পৌছতে তাদের কয়েক ঘন্টা লেগে যায়। এজন্য তারা ব্যবহার করেছে ডিঙ্গি নৌকা আর জেট স্কি। আন্তর্জাতিক পানি সীমায় তাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল একটি ইয়ট। সেখানে পৌছতে তাদের সন্ধ্যা হয়ে গেল।

ইয়টে চড়ার পর হোয়াটস অ্যাপ মেসেজে এক বন্ধূকে লতিফা লিখেছেন আই অ্যাম ফ্রি। আমি মুক্ত। ইয়টে করে তারা ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে গোয়ায় পৌছার পরিকল্পনা করেন। এরপর সেখান থেকে বিমানে করে যুক্তরাষ্ট্র। পরিকল্পনা ছিলা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করবেন লতিফা।

আট দিন সমুদ্র অভিযানের পর তাদের ইয়ট যখন ভারতের কাছাকাছি আসে তখনই ঘটে বিপদ। ভারতীয় উপকূল থেকে ৩০ মাইল দূরে থাকতেই তাদের ইয়ট ঘেরাও করে ফেলা হয়। তাদের ইয়টে প্রবেশ করে কমান্ডো বাহিনী।

অভিযানে মুহুর্তে ধোয়ায় ছেয়ে যায় ইয়টের নিচতলা। সবাই দৌড়ে উপরে ওঠে। কেউ পালায় বাথরুমে।

টিনা সে দিনের ঘটনা বর্ননা দিয়ে জানান লতিফা ও তিনি বাথরুমে আশ্রয় নেই। কমান্ডো বাহিনী তাদের ধরার পর লতিফা চিৎকার করে বলছিল আমাকে দুবাই ফিরিয়ে নিওনা। আমাকে এখানে গুলি করে মেরে ফেল। কিন্তু লতিফাকে দুবাই ধরে নিয়ে যায় তারা। এটাই ছিল লতিফার সাথে তার শেষ দেখা।

লতিফাকে দুবাই নিয়ে বন্দি করে রাখা হয়। বন্দি অবস্থায় বাইরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়র পর হঠাৎ করে আরেকটি ভিডিও বার্তা প্রকাশিত হয় লতিফার। এ ভিডিও বার্তা নিয়ে সারা বিশ্বে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। প্রকাশ হয়ে পড়ে আরবের প্রভাবশালী রাজা দুবাইয়ের শাসক আর তার প্রাসাদের অন্ধকার চিত্র।

শেষ ভিডিও বার্তায় লতিফা ইয়টে তাদের সাথে সেদিন কী ঘটেছিল তার বর্ননা দেন। লতিফা জানান, আমি চিৎকার করছিলাম। আর হাত পা ছুড়ছিলাম সর্বশক্তি দিয়ে। এমন সময় একজন আমার বাহুতে ইনজেকশন পুশ করল। এরপর আমাকে তারা একটি ভারতীয় সামরিক জাহাজে তোলে। কমান্ডোরা আমাকে একটি বড় রুমে নিয়ে যায়। সেখানে বসা ছিল চার থেকে ৫ জন জেনারেল।

আমি তাদের আমার পরিচয় দিয়ে বলি আমি দুবাই যেতে চাই না। আমি রাজনৈতিক আশ্রয় নেব। আমাকে ছেড়ে দাও। কিন্তু তার কথা কেউ গুরুত্ব দেয়নি। তাকে তুলে দেয়া হয় আমিরাতি এক কমান্ডোর হাতে। সে আমাকে শুন্যে তুলে ধরল। আমি পা দিয়ে লাথি মারছিলাম। এরপর তার হাতে প্রচন্ড কামড় বসালাম। এরপর আমাকে আবার ইনজেকশন দেয়া হলো। অচেতন হওয়ার আগে আমি দেখলাম আমাকে একটি স্ট্রেচারে করে প্রাইভেট বিমানে তোলা হলো। লতিফা ভিডিও বার্তায় জানান কমান্ডো অভিযানে ১২ থেকে ১৫ জন ছিল। দুইজন ছিল আমিরাতি।

দুবাই থেকে বের হওয়ার এত বছরের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায় লতিফার। এরপর থেকে তিনি বন্দি হয়ে আছেন। কারো কোনো সাহায্যের উপায় নেই। কোনো বিচার নেই। কোনো অভিযোগ নেই। লতিফার বান্ধবী টিনাকেও ধরে আনা হয় দুবাইয়ে। সেখানে তাকে দুই সপ্তাহ বন্দি করে রাখা হয়। টিনা জানিয়েছেন, ইয়ট্ েভারতীয় কমান্ডো ঝড়ের বেগে প্রবেশ করে। তাদের হাতে ছিল মেশিন গান। তারা অ গুলি করার ভয় দেখায়।

টিনা মুক্তি পাওয়ার পর লতিফার বিষয় গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে শুরু করেন। ফ্রি লতিফা ক্যাম্পেইন শুরু করেন। জাতিসংঘের কাছেও বিষয়টি অবহিত করেন তারা। এক পর্যায়ে লতিফার সাথে তার সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ২০১৯ সালের শুরুতে টিনা যখন ফিনল্যান্ডে তার পরিবারের কাছে ছিল তখন এক অজানা ব্যক্তির কাছ থেকে একটি মেসেজ পান। প্রিন্সেস লতিফাকে টিনা ব্রাজিলিয়ান মার্শাল আর্ট শিখিয়েছিলেন। তার একটি ব্রাজিলিয়ান ছদ্মনাম দিয়েছিলেন। একদিন অজ্ঞাত এক ব্যক্তি লতিফার ছদ্মনাম জানতে চান। এরপর তার সাথে আবার লতিফার ফোনে যোগাযোগ হয়। লতিফা জানায় সে ভিডিও মেসেজ পাঠাতে পারবে। ভিডিওতে দেখা গেল ৩৫ বয়সী পিন্সেস লতিফা একটি বাথরুমের কোনায় বসে ফিস ফিস করে কথা বলছে।

তিনি জানান বাথরুমে বসে ভিডিও করছেন। কারন এটাই একমাত্র রুম যা তিনি ভেতর থেকে লক করতে পারেন। তাকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে। জেলে দাসের মতো অবস্থায় আছেন। প্রিন্সেস লতিফা জানান আমার জীবন আমার হাতে নেই। আমাকে একটি ভিলায় রাখা হয়েছে। আর এটি জেলে পরিণত করা হয়েছে। সব জানালা বন্ধ। বাইরে রয়েছে ৫ জন পুলিশ। আর ভেতরে দুই জন নারী পুলিশ। ঘরের বাইরে বের হওয়ার কোনো অনুমিত নেই । পুলিশ আমাকে হুমকি দিয়েছে সারা জীবন এভাবেই কাটাতে হবে। আমার আর সূর্যের আলো দেখার সুযোগ হবে না।

৯ মাস ধরে বাইরের পৃথিবী থেকে লতিফার সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুবাইর ওপর চাপ বাড়তে থাকে। লতিফা জীবিত আছে কি না এ বিষযে জাতিসংঘ থেকে প্রমান হাজিরের আহবান জানানো হয়। এরপর লতিফাকে দেখতে যান তার সৎ মা প্রিন্সেস হায়া। তিনি তাকে লাঞ্চের দাওয়াত দেন। লতিফা ভিডিও বার্তায় জানায় এটা ছিল তাকে পরীক্ষা করার একটি পদক্ষেপ। তার সৎ মা তাকে জানায় যদি আমি ভাল আচরন করি তাহলে তারা আমাকে শীঘ্র মুক্ত করবে।

প্রিন্সেস হায়া লতিফা সম্পর্কে অনেক অসত্য তথ্য দেন। হায়া জানায় লতিফা মানসিক সমস্যায় ভুগছে। অপর দিকে লতিফা ভালো আছেন জাতিসংঘের কাছে প্রমানের জন্য প্রিন্সেস হায়া তার এক বন্ধুকে আমন্ত্রন জানান লতিফাকে দেখতে আসার জন্য। হায়ার এ বন্ধু জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সাবেক হাই কমিশনার মেরি রবিনসন।

২০১৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর মেরি রবিনসন দুবাই আসেন। ডিসেম্বরের একটি ছবিতে দেখা যায় মেরি রবিনসনের সাথে লাঞ্চ করছেন লতিফা। লতিফার সাথে মেরি রবিনসনের এ লাঞ্চ ছিল মূলত একটি ষড়যন্ত্র । আর এর পেছনে ছিল তার সৎ মা হায়া। এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে লতিফার কিছু জানা ছিল না। লাঞ্চে মেরি লতিফার সাথে আলোচনা করেন, খেলাধুলা, স্কাই ডাইভিং, নিরামিষ ভোজন এবং মেরি রবিনসনের একটি বই প্রকাশ বিষয়ে।

লতিফার সাথে তোলা ছবি রবিনসন জাতিসংঘে পাঠাতে রাজি হয়। আর সংযুক্ত আরব আমিরাত আট দিন পর এ ছবি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশ করে। লতিফা ভিডিও বার্তায় জানান, মেরি রবিনসন যে জাতিংসঘের মানবাধিকার বিষয়ক সাবেক কর্মকর্তা এ বিষয়ে তাকে কিছুই বলা হয়নি। এটা ছিল প্রতারণা।

লতিফার সাথে লাঞ্চ বৈঠক বিষয়ে মেরি রবিনসন বিবিসিকে বলেন, প্রিন্সেস হায়া তাকে ভুল তথ্য দিয়েছিল।

রবিনসনের সাথে লাঞ্চের পর লতিফাকে আবার ভিলায় পাঠানো হয়। তার জীবনে কিছুই পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু পরিবর্তন ঘটে হায়ার জীবনে। ২০১৯ সালের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর বের হয় দুবাই শাসকের স্ত্রী হায়া দুই সন্তানসহ লন্ডনে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি তার জীবন নিয়ে শঙ্কিত।

এ সময় লন্ডনের একটি আদালত রুল জারি করে জানায় দুবাই শাসক তার কন্যা লতিফাকে অপহরণ করেছেন।

লতিফার বন্ধু টিনা আশা করেন এবার হয়তো জাতিসংঘ প্রকাশ্যে চাপ সৃষ্টি করতে পারবে দুবাই শাসকের ওপর। কিন্তু তারপরও লতিফা বন্দিই থাকলো।

সম্প্রতি লতিফার সর্বশেষ আলোচিত ভিডিও প্রকাশের আগে দুবাই কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল লতিফা তাদের পরিবারের সাথে আছেন যত্নের সাথে। কিন্তু লতিফা ভিডিওতে জানিয়েছে সে মুক্ত নয় বরং বন্দি। তাকে আটকে রাখা ভিলাকে একটি জেলখানায় পরিণত করা হয়েছে।

প্রিন্সেস লতিফা এর আগে ২০০২ সালেও একবার পলায়নের চেষ্টা করেছিল। সেবারও সে ধরা পড়ে এবং সাড়ে তিন বছর বন্দি রাখা হয় তাকে। ২০১৮ সালে লতিফা দুবাই থেকে ভারত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালানোর যে পরিকল্পনা করেছিলেন তার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন ফরাসী গোয়েন্দা হারভে জুবার।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে ফরাসি এ গোয়েন্দাকে রহস্যজনক হিসেবে আখায়িত করা হয়েছে। ফরাসী এ গোয়েন্দা অর্থের বিনিময়ে লতিফার পলায়নের এ ঘটনা ফাঁস করে দিয়ে থাকতে পারে। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয় ফরাসী এ গোয়েন্দা জুবারের সাথে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের উচ্চ পর্যায়ের সম্পর্ক। লতিফাকে অপহরনের সময় হারভে জুবারও ছিল ইয়টে।

দুবাইয়ের শাসকদের এমন অপহরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ২০২০ সালের মার্চ মাসে লন্ডন হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয় ১৮ বছর আগে দুবাই শাসক মোহাম্মদ বিন আব্দুর রশিদ আল মাখতুম তার আরেক কন্যা শামসাকে লন্ডন থেকে অপহরন করে দুবাই ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। এরপর থেকে সে বন্দিজীবন যাপন করছে।