লাদাখে চীনের কাছে হেরে যাচ্ছে ভারত


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২৭ জানুয়ারি ২০২১, ০৭:৫৪

লাদাখ সীমান্তে চীনা সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা গিয়েছিল বহু ভারতীয় সেনা। এরপর থেকে সেখানে মুখোমুখি অবস্থান করছে দুই দেশের সেনারা। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটে থাকা ভারতের পক্ষে এই অচলাবস্থা সামরিক সংকটের সৃষ্টি করেছে। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে, ভারত লাদাখে হেরে যাচ্ছে আর জয়ী হচ্ছে চীন।

হিমালয়ে গত আট মাসের বেশি সময় ধরে মুখোমুখি অবস্থান করছে এশিয়ার দুটি পরমাণু শক্তি ভারত ও চীন। এশিয়া ঘিরে নতুন যে ভূরাজনৈতিক খেলা চলছে তাতে এ সংঘাত বিশে^র জন্য দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।

গত বছর লাদাখে চীন ও ভারতের মধ্যে যে সংঘাত দেখা দিয়েছিল তাকে অনেক ভাষ্যকার অচলাবস্থা বলে মন্তব্য করেছেন। সেটা হয়তো অনেকাংশে ঠিকই আছে। কিন্তু এই অচলাবস্থাই ভারতের জন্য দুঃসংবাদ হয়ে হাজির হয়েছে। কারণ এই অচলাবস্থা দীর্ঘদিন বহন করার ক্ষমতা নেই ভারতের। কিন্তু এভাবে মুখোমুখি অবস্থান করতে চীনের কোনো সমস্যা নেই।

করোনার কারণে ভারতে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলেও চীনের অর্থনীতি ঘুরে দাড়িয়েছে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থান করার ভারতের সেনাবাহিনীর বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশ একাজে ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে অর্থ সংকটের কারণে ভারতের সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন আটকে গেছে। এতে ভারতের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী সুবিধাজনক অবস্থানে পৌছে যাচ্ছে চীন।

চীন ও ভারতের বর্র্র্র্তমান সংকট শুরু হয় গত বছর মে মাসে লাদাখ সীমান্তে। সে সময় দুই দেশের সেনাদের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্র্র্র্র্ষে ভারতের বহু সেনা প্রাণ হারায়। সেই সংঘাতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ন দিক ছিলো সেখানে কোনো গোলাগুলি হয়নি। চীনা সেনারা কাটাতার জড়ানো লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে ভারতীয় সেনাদের।

সেনা হত্যার মতো সংঘাতের পর থেকে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য ভারতের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে দফায় দফায় বৈঠকও হয়। সর্বশেষ বৈঠকটি হয় গত ৬ নভেম্বর। কিন্তু চীন এবার সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে লাদাখে তারা ভারতের কাছ থেকে দখল করে নেওয়া এলাকা ছাড়বে না। ফলে ভারতের জন্য এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

চীন যে এবার ভারতের বিশাল এলাকা দখল করে নিয়েছে তা নয়াদিল্লিও স্বীকার করে নিয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং সংসদে জানিয়েছেন যে চীন লাদাখে ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে নিয়েছে যা প্রায় ভুটানের সমান।

লাদাখে চীন ও ভারতের সেনারা ট্যাঙ্ক নিয়ে মাত্র কয়েক গজ দুরে মুখোমুখি অবস্থান করছে। সেখানে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার ফুট উচ্চতায় দুই দেশের লক্ষাধিক সেনা অবস্থান করছে। হিমালয়ের এই জায়গাটিতে তাপমাত্রা মাইনাস ২২ ডিগ্রিতে নেমে যেতে পারে। এখানে বিপুলসংখ্যক সেনা রাখতে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়।

ভারত জানে যে চীনের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বিশাল। এ কারণে নয়াদিল্লি চীনের সঙ্গে সামরিক সংঘাতে জড়ানোর চিন্তাও করতে পারছে না। চীনের বিরুদ্ধে কিছু অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েই ক্ষান্ত হতে হয়েছে নয়া দিল্লিকে। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের রাষ্ট্রীয় কেনাকাটায় চীনের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা এবং দেশটির কিছু অ্যাপস বন্ধ করা। কিন্তু এতে চীনের ওপর কোনো চাপ পড়বে না।

ভারতের এসব পদক্ষেপ অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ভারত চীনের বিরুদ্ধে সামরিক দিক থেকে কিছু পদক্ষেপ নিলেও যুদ্ধে জড়ানোর সক্ষমতা নেই নয়াদিল্লির। ভারতের অর্থনীতির এখন যে অবস্থা তাতে তাওে পক্ষে সামরিক সংঘাতে জড়ানো সম্ভব নয়।

চীনের সঙ্গে এই সংঘাতে টিকে থাকার জন্য ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়তে হচ্ছে। তাতে ভারতের সামরিক ব্যয় আরও বাড়ছে। তাছাড়া এই সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে কোনো অর্থনৈতিক ছাড় না দিয়ে বরং বাড়তি সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবে ।

চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সংকটের সমাধানের আশা ভারত ছেড়ে দিয়েছে। বরং চীন যাতে আরও ভূখণ্ড দখলে নিতে না পারে সেজন্য লাদাখে বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন করতে হয়েছে ভারতকে। কিন্তু এতে ইতিমধ্যে চীন যে বিশাল এলাকা দখল করে নিয়েছে তা পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।

ভারত ও চীনের সীমান্ত পরিস্থিতি এখন বদলে গেছে। চীনকে তার দখলে যাওয়া এলাকার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে আর ভারতকে নতুন এলাকা না হারানোর জন্য সীমান্তে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন রাখতে হচ্ছে। এটা কত দিন চলবে তা বলা মুশকিল। তবে তা যে দীর্ঘস্থায়ী হতে যাচ্ছে তা স্পষ্ট। ফলে সীমান্তে বিপুল সেনা মোতায়েন রাখায় ভারতের রাজকোষ প্রচণ্ড চাপ পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ভারতের কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় স্বীকার করেছেন, এ সংকটের কূটনৈতিক সমাধান হচ্ছে না। ফলে মুখোমুখি অবস্থানই এখন নিষ্ঠুর বাস্তবতা। শুধু চীন সীমান্তেই নয়, চির বৈরি পাকিস্তানের সঙ্গেও উত্তেজনা চলছে ভারতের। পাক সীমান্তেও সজাগ থাকতে হচ্ছে ভারতকে।

ভারতের মোট সামরিক বাজেটের ৬০ ভাগই ব্যয় হয় তার সাড়ে ১৩ লাখ সেনা সদস্যের বেতন ভাতা পরিশোধ করতে। ভারতকে চীনের মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে থাকতে হলে সামরিক ব্যয় আরও বাড়বে। কিন্তু বাড়তি অর্থ যোগান দেওয়া দুর্বল অর্থনীতির ভারতের পক্ষে কঠিন। ফলে ভারতের সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য যে বরাদ্দ ছিল তা ব্যয় হবে সীমান্ত উত্তেজনার কারণে। চীনও হয়তো এটাই চাইছে যে ভারতের সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন বন্ধ থাকুক। চীনের এই ইচ্ছার ফাঁদেই পড়েছে ভারত।

যেমন ভারতের নৌবাহিনীর জন্য ২০০ জাহাজ কেনার চিন্তা থাকলেও তা কমিয়ে এখন ১৭৫টি করার চিন্তাভাবনা চলছে। ভারত তৃতীয় বিমানবাহী রণতরীর পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে অর্থসংকটের কারণে। অথচ চীনের হুমকি মোকাবিলার জন্য ভারতের দরকার নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করা। কিন্তু লাদাখের মত ঘটনায় সেনাবাহিনীর জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য ভারতকে সেই পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়েছে।

বিপরীতে চীনের তৃতীয় বিমানবাহী রণতরী নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে এ ধরনের ৬টি রণতরী নির্মাণের পরিকল্পনা চীনের নৌবাহিনীর। মনে রাখতে হবে যে চীনের সামরিক বাজেট ভারতের চারগুণ।

চীনের অর্থনীতি ভারতের ৬ গুণ বড়, যদিও দুটো দেশের জনসংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। করোনাকালে দুই দেশের অর্থনীতির এই ব্যবধান আরও বেড়েছে। চীন কয়েক বছরের মধ্যেই বিশে^র বৃহত্তম অর্থনীতি হতে যাচ্ছে। ভারতের চেয়ে চীনের সেনাবাহিনীতে দেড়গুণের বেশি সেনা রয়েছে। চীনের রয়েছে বিশে^র বৃহত্তম স্থলবাহিনী।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও স্বীকার করেছে, গত দুই দশকে চীনের সেনবাহিনীর প্রযুক্তি, সম্পদ ও রাজনৈতিক ইচ্ছাসহ সবক্ষেত্রে অনেক শক্তিশালী ও আধুনিক হয়েছে। ভারত লাদাখে মুখোমুখি অবস্থানের খরচ বহনে অপারগ হলেও চীনের সেখানে দীর্ঘমেয়াদে বিশাল সেনাবহর রাখার সক্ষমতা রয়েছে। হিমাঙ্কের নীচের তাপমাত্রায় বাসের অযোগ্য লাদাখে বিপুল সেনাবাহিনী মোতায়েন রাখার জন্য দরকার অর্থের পাহাড়।

ভারত তাই চীনকে নিয়ে মহাবিপদে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনী ফায়দা হাসিলের জন্য প্রতিবেশি পাকিস্তানে ছোটখাট হামলা চালিয়ে বাহবা নিলেও চীনের ব্যাপারে তিনি একেবারেই নির্বাক। এমনকি চলমান এই উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে মোদি চীনের একবারও সমালোচনা করেননি। মোদি বরং চীনকে উত্তেজিত না করার নীতি গ্রহণ করেছেন। মোদিকে ৫৬ ইঞ্চি বুকের পাটাধারী বলে তার ভক্তরা প্রচার চালালেও চীনের ব্যাপারে তার নীরবতায় তারাও মুখে কুলুপ এটে থাকেন।

অর্থনৈতিক সংকটের কারণে লাদাখে উভয় সংকটে পড়েছে ভারত। তাকে হয় চীনের কাছে ভূখণ্ড হারানোর বেদনা সয়ে যেতে হবে অথবা তার সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের চিন্তা বাদ দিতে হবে। চীন এটাই চাচ্ছে।