চীন নিয়ে কোন পথে এগোবেন বাইডেন


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২৬ জানুয়ারি ২০২১, ১২:৫২

করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে চীন এক রকমের আন্তর্জাতিক অবরোধের মধ্য দিয়ে পার করলেও সেই দৃশ্যপট খুব শীঘ্রই পাল্টে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। চার বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া ও ইউরোপে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিটি বাতিল করার পর প্রাথমিকভাবে চীন এক রকম বিচ্ছিন্নই হয়ে পড়েছিল। কিন্তু চার বছর পর এসে বিগত কয়েক মাসে চীন এশিয়া ও ইউরোপের অনেক দেশের সাথেই বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি সম্পন্ন করেছে, যা রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।

যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বায়নের কথা বলে যেভাবে বিশ্বজুড়ে একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি করতে চেয়েছিল, চীন সেই পথে না গিয়ে বেল্ট বা রোড ইনিশিয়েটিভের মতো ছোট ছোট আঞ্চলিক জোট গঠন করে বেশি সফলতা পেয়েছে।

মার্কিনদের জন্য অভ্যন্তরীণ বিভেদই হলো এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পও ৭০ মিলিয়নের বেশি ভোট পেয়েছেন। ক্যাপিটল হিলে হামলা ও হোয়াইট সুপ্রিমেসির অস্বাভাবিক উত্থান জাতিগত বিভক্তির ইঙ্গিত বহন করে। জো বাইডেন হোয়াইট হাউসে বসতে সক্ষম হলেও জাতিকে একত্রিত করা তার জন্য সহজ হবে না বলেই বিশ্লেষকরা মত দিয়েছেন। এর বিপরীতে শি জিন পিং-এর নেতৃত্বে চীন বরং একতাবদ্ধ হয়েই আছে। দেশটিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো খাতে বেশ উন্নতিও হয়েছে।

গত ৪ বছর মার্কিন প্রশাসনের চীনবিরোধী নানা ভূমিকা চীনের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে টানাপড়েনের মধ্যে ফেললেও জো বাইডেন আর সেই পথে হাঁটবেন বলে মনে হচ্ছে না। তাই জো বাইডেনের আগামী সময়ের কৌশল ও নীতিমালার দিকে চীনা কর্তৃপক্ষ নিয়মিত নজর রাখছে।

কোল্ড ওয়ার শেষ হওয়ার পর বিশ্ব মূলত দুটি তত্ত্ব দ্বারা খুব বেশি প্রভাবিত হয়েছে। একটি হলো স্যামুয়েল হান্টিংটনের ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন তত্ব। যার সার কথা হলো, ভবিষ্যতে লড়াই ও যুদ্ধ হবে ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতা আর সংস্কৃতির মাঝে। এ সময়ের সবচেয়ে আধিপত্যবাদী সভ্যতা হবে প্রোটেস্ট্যান্ড এ্যাংলো স্যাক্সন সভ্যতা এবং অন্য সভ্যতাগুলোকে এই সভ্যতার বিরুদ্ধেই লড়াই করে টিকে থাকতে হবে।

দ্বিতীয় যে তত্বের কথা খুব শোনা গিয়েছিল তাহলো ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার এন্ড অব হিস্টোরি। যার মূল কথা হলো কম্যুনিজম এবং কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পর আবারও পুঁজিবাদের উত্থান হবে। বাজার অর্থনীতির প্রসার ঘটবে এবং উদারমনা মুল্যবোধগুলোর বিকাশ ঘটবে।

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধে এ দুটো তত্ত্বই প্রযোজ্য হতে পারে। চীনে একটি কর্তৃত্বপরায়ন শাসন চলছে। অনেকটা সাবেক সেভিয়েতের আদলে। হোয়াইট হাউজ প্রশাসনের তুলনায় চীনা প্রশাসন অনেকটাই ভিন্ন। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে যুদ্ধ করেছে তা কোনো সুফল বয়ে আনেনি। বিগত দুই দশকে আফগানিস্তান, ইরাক এবং মিশরে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে গনতন্ত্রের সুবাতাস দিতে চেয়েছে তা মোটামুটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। কেননা দেশে দেশে সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে অনেকটা ভিন্নতা রয়েছে। তাই অন্য কোনো দেশ চাইলেই তার মতো করে আরেকটি দেশের ওপর কিছু চাপিয়ে দিতে পারবে না।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনীতি এমন একটি খেলা যেখানে যুদ্ধ হলো এক ধরনের কৌশলগত বিচ্যুতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় সংকট হলো বিগত বছরগুলোতে তারা রাজনীতির চেয়ে যুদ্ধের দিকেই বেশি মনোযোগ দিয়ে এসেছে। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোল্ড ওয়ারের সময়ে যুদ্ধ করে নয় বরং রাজনীতির মধ্য দিয়ে জয় করেছে। ১৯৯০ সালে বার্লিন ওয়াল পতনের পরপর জর্জ বুশ সিনিয়র প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু করেন। তিনি বিশ্বের প্রায় সব মোড়লকেই ইরাকের বিরুদ্ধে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। এমনকী চীন, ইরান ও সিরিয়াও মার্কিন উদ্যেগে সাড়া দেয়। এসব দেশ যে সরাসরি ঐ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তা নয়, তবে সিনিয়র বুশ তার রাজনৈতিক দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে সাবেক সেভিয়েতের পতন পরবর্তী বিশ্বে একটি নতুন ধারার সূচনা করতে পেরেছিলেন।

তিনি রাশিয়া ও ইরানের মতো পুরনো শত্রুকেও নিজের দিকে টানতে কোনো ভুল করেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এরকমই আরেকটি রাজনৈতিক চাল চেলেছিল। সেবার যুক্তরাষ্ট্র জার্মানী, ইতালী ও জাপানের সাথে সখ্যতা গড়েছিল। সিনিয়র বুশ সেই একই পথে হেটেছিলেন। কিন্তু এর পরবর্তী বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র তার রাজনৈতিক কৌশলে অনেকগুলো ভুল করে ফেলে নিজেকে অনেকটা মিত্রশূন্য এবং অনাস্থার জায়গায় নিয়ে যায়।

চীন যতই উন্নতি করুক, উন্নয়নে ও শক্তিতে তারা এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হতে পারেনি। তবে একটি বার্তা তারা দিতে পেরেছে আর তাহলো শত্রু হিসেবে তারা খুব সহজও হবে না। চীন বিগত ৪০ বছর ধরে নিজেদের উন্নয়নের জন্য টানা চেষ্টা করে গিয়েছে। নিজেদের মতো করে দরিদ্র একটি দেশ থেকে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়েছে। প্রযুক্তিতে তারা এখন বিশ্বের অনেক দেশকেই পেছনে ফেলে দিয়েছে। বাস্তবতা হলো, চীনের এ উত্থানের নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও কম নয়।

৪০ বছর আগে, চীনের অর্থনীতি যখন দুর্বল অবস্থায় ছিল তখন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে অস্বাভাবিক কিছু সুবিধা দিয়েছিল। চীনকে তারা যৎসামান্য ট্যারিফে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানির সুবিধা দিয়েছিল। পশ্চিমা সব প্রযুক্তিকেও খুবই কম দামে চীনের কাছে হস্তান্তর করেছিল। চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এ মধুচন্দ্রিমা শেষ হয় ১৯৮৯ সালের পর। ২০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট ্র প্রকাশ্যে চীনের বিষয়ে তার অস্বস্তির কথা জানায়। চীনের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপারটি চুরি করেছে বলে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯০ সালে অভিযোগ করে। জুনিয়র বুশের আমলে এসে এ সম্পর্কে আরো খারাপ হতে থাকে।

২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ারে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র আবারও চীনের বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে। যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করেই বলতে শুরু করে চীন নয়, বরং তাদের আসল শত্রু কট্টরপন্থী মুসলিমরা। এরপর আবার যুক্তরাষ্ট্র চীনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে আর চীনও এ সুযোগকে ভালোভাবেই কাজে লাগায়।

চীনও ভুল করেছিল বেশ কয়েকবার। চীনের উচিত ছিল পরাশক্তিগুলোর সাথে দুরত্ব কমানো ও সম্পর্ক বৃদ্ধি করা। কিন্তু চীন তা করতে পারেনি। জিয়াং জেমিন ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে ছিলেন। তার সময়ে চীনে প্রত্যাশিত সংস্কার বা অগ্রগতি কিছুই হয়নি। বরং চীনের নেতৃত্বের ভুলের কারণে চীন বাহিরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং বড় পরিসরের বৈশ্বিক গেম থেকে চীন যেন ঝড়ে পড়ে যায়।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিষয়ে হিসেব করতে ভুল করেছিল। তারা শুরু থেকেই চীনকে সার্বিকভাবে সাবেক সেভিয়েতের জমজ রাষ্ট্র বলেই মনে করতো। কিন্তু শি জিন পিং ক্ষমতার নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয়ার পর চীন ঘুরে দাঁড়ায়। তারা কখনোই সাবেক সেভিয়েতের মতো করে দেশ চালায়নি। চীনের বর্তমান জনসংখ্যা এখন ১৪০ কোটি এবং এই বিপুল সংখ্যক মানুষ যে মানের উন্নত জীবন যাপন করে তা কয়েকবছর আগেও তারা কল্পনা করতে পারেনি।

চীনের ক্ষমতাসীন দলের সদস্য সংখ্যা এখন নয় কোটি। প্রতি ১৫ জন নাগরিকের মধ্যে একজন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত। ফলে, বর্তমানে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যেখানে চীনা জনগন আর কমিউনিস্ট পার্টি যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। চীনের সমাজে রীতিমতো একটি বিপ্লব ঘটে গেছে।

একই সময়ে ইউরোপ বা আমেরিকার চিত্র এমন ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং পেনশন সিস্টেমে বিগত কয়েক বছরে অনেকটাই কমে গেছে। পশ্চিমা সভ্যতা ও সমাজ ব্যবস্থা টিকেই আছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর ওপর। এখন এ সকল সুবিধাদি কমে যায় গোটা সমাজ ব্যবস্থাতেই অভূতপূর্ব সব সমস্যা দেখা দিয়েছে। করোনা মহামারিতে এ সংকটগুলো আরো প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে।

মার্কিন সমাজ ব্যবস্থা আগে থেকেই উন্নত হওয়ায় এখন নানাবিধ সংকটে অব্যবস্থাপনাগুলো প্রকাশিত হচ্ছে। আর চীনের মতো দেশগুলো ক্রমাগতভাবে উন্নয়ন করায় তারা প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার সংকটের অভিজ্ঞতা এখনও অর্জন করেনি। চীনের সামনে পশ্চিমা অনেক দেশের মডেল থাকায় তারা পশ্চিমা দেশগুলোর ভুল থেকে আগেই শিখে নিয়ে নিজেদেরকে ত্রুটিমুক্ত রাখার সুযোগ পাচ্ছে।

ঐতিহাসিকভাবেই চীনের মানুষ সঞ্চয়ে অভ্যস্ত। তারা তাদের আয়ের ৫০ শতাংশ সঞ্চয় করে। তাদের টাকা গুলো রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। ব্যাংক আবার মুদ্রাস্ফীতির হারের নীচে সুদের হার নির্ধারন করে জনগনকে বাড়তি সুবিধাদি প্রদান করে।

মার্কিনীদের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার সাথে চীনের মানুষের আর্থিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যর্থতা, সুদের হারের ভিন্নতা এবং প্রশাসনিক নজরদারি চীনের অর্থনীতিকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বিগত কয়েক বছরে চীন প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক ঋণ শোধ করেছে অথচ এরপরও দেশটির অর্থনীতি কোনো চাপের মুখে পড়েনি।

এ কারণেই চীন সামরিক খাতে অভাবনীয় পরিমান বিনিয়োগ করতে পারছে। চীন এরই মধ্যে বিশ্বের শীর্ষ অস্ত্র রফতানিকারক ও প্রস্তুত কারক দেশে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি, বিভিন্ন আঞ্চলিক জোট করে বিশ্ব রাজনীতির হিসেবেও চীন ক্রমান্বয়ে একটি ফ্যাক্টর হয়ে আবির্ভুত হচ্ছে। জো বাইডেনের নতুন প্রশাসন এ বাস্তবতাকে অনুধাবন করে চীনকে আগামী দিনগুলোতে কীভাবে মোকাবেলা করে এখন তাই দেখার বিষয়।