তুরস্ক-ইসরাইল সম্পর্ক ও মধ্যপ্রাচ্যে এর প্রভাব


  • মোতালেব জামালী
  • ২৬ জানুয়ারি ২০২১, ০৬:৩৯

তুরস্ক ও ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক বহু পুরনো। উসমানিয়া খেলাফত বা অটোমান সাম্রাজ্যের শাসক সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ ইহুদি উদ্বাস্তু বা শরণার্থীদরকে মধ্যপ্রাচ্যে স্বাগত জানিয়েছিলেন। তার উদ্যোগ অত্যন্ত কঠিন সময়ে ইহুদিদেরকে টিকে থাকতে সহায়তা করেছিল। এ কারণে ইহুদিরা অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি অত্যন্ত অনুগত ছিল। ইহুদি নেতা থিওডর হার্জল অটোমান সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদকে অনুরোধ করেছিলেন ফিলিস্তিন দখল করে ইহুদিদেরকে দেওয়ার জন্য। যদিও পরবর্তীতে ইহুদিদের নানা কর্মকাণ্ডে অটোমান সুলতানরা ইহুদিদের প্রতি ক্ষুব্ধ হন।

পশ্চিমাদের সহযোগিতায় ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হিসেবে তুরস্কই ১৯৪৯ সালে প্রথম ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদান করে। তখন থেকেই দেশ দুটির মধ্যে সামরিক, কৌশলগত ও কূটনৈতিক সম্পর্ক গভীর হয়ে ওঠে। দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্ব মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাণিজ্য ও পর্যটন খাতেও দুই দেশের সম্পর্ক দ্রুত বাড়তে থাকে।

ইসরাইলি বিমান বাহিনী তুরস্কের আকাশ সীমায় প্রশিক্ষণ মহড়া দিতে শুরু করে। একই সঙ্গে ইসরাইলি টেকনিশিয়ানরা তুর্কি যুদ্ধ বিমানের আধুনিকায়নে সহযোগিতা দিতে থাকে। দুই দেশ নিজেদের মধ্যে উচ্চ প্রযুক্তি বিনিময় ও পানি বন্টন পরিকল্পনাও গ্রহন করে। তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ২০০৫ সালে এক সরকারি সফরে ইসরাইলে যান। এ সময় তিনি ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘাত অবসানে ভূমিকা রাখার আশাাবাদ ব্যক্ত করেন।

কিন্তু গত দশক থেকেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্রমশ: অবনতি ঘটতে থাকে। ২০০৮-০৯ সালে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন ও ২০১০ সালের ৩১ মে অবরুদ্ধ গাজায় ত্রানবহর নিয়ে যাওয়ার সময় তুর্কি জাহাজ মাভি মারমারায় ইসরাইলি হামলায় ৯ জন নিহত হবার পর তুরস্কের সাথে ইসরাইলের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে।

এ ঘটনার জন্য ২০১৩ সালে ইসরাইল তুরস্কের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে।এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক আবার স্বাভবিক হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। কিন্তু এ বছরই তুরস্ক ইরানে ইসরাইলি গোয়েন্দাদের তৎপরতা চালানোর বিষয়টি প্রকাশ করে দিলে দু’দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। এরপর ২০১৫ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুন:স্থাপনে গোপন বৈঠকে বসে তুরস্ক ও ইসরাইল। ২০১৬ সালের জুন মাসে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে তারা একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে ফিলিস্তিনি জনগণ এর বিরুদ্ধে প্রবল বিক্ষোভ শুরু করে। বিক্ষোভ দমনে ইসরাইলি সেনারা নির্বিচার গুলি চালালে অবরুদ্ধ গাজায় ৬০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। এ ঘটনায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ক্ষুব্ধ হয়ে ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দেন। তিনি ইসরাইলকে একটি বর্ণবাদী দেশ আখ্যা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বেন ইয়ামিন নেতানিয়াহুর কঠোর সমালোচনা করেন।

২০১৮ সালে ইসরাইলি রাষ্ট্রদূতকে তুরস্ক থেকে বহিস্কার করা হয়। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে জেরুসালেম থেকে তুরস্কের কন্সাল জেনারেলকে বহিস্কার করে ইসরাইল। এসব ঘটনায় দু’দেশের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে। এর প্রভার পড়ে দু’দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কেও। এমনকি ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যে ২০১৬ সালে তুরস্ক ও ইসরাইল গ্যাস পাইপ লাইন স্থাপন প্রকল্প নিয়ে যে আলোচনা শুরু করেছিল ইসরাইল তা স্থগিত করে দেয়। এসময় ইসরাইল ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। তারা তুরস্কের শত্রু দেশ গ্রীস ও গ্রীক সাইপ্রাসের সাথে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে শুরু করে।

অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থ্পানের ঘোষণা দেয়। এতে তুরস্কও নড়েচড়ে বসে। মধ্যপ্রাচ্যের দ্রুত পরিবর্তিত ভূÑরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের আভাস দেন। তবে একই সাথে তিনি এথাও বলেন যে, ইসরাইলের ফিলিস্তিন নীতি আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরাইলের নিষ্ঠুর আচরণ মেনে নেয়া যায় না।

মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে তুরস্কের উত্থান এখন এই অঞ্চলের সব দেশকেই মেনে নিতে হচ্ছে। সিরিয়া থেকে শুরু করে লিবিয়া হয়ে আজারবাইজানের নাগর্নো-কারাবাখ পর্যন্ত তুরস্কের সামরিক শক্তির প্রদর্শন ইতিমধ্যে সবাই দেখেছে। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান নিজেকে মুসলিম বিশে^র একজন প্রধান নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। তিনি তার পূর্বসুরি অটোমান শাসকদের মতোই নিজেকে একজন বিজয়ী শাসক ও নেতা হিসেবে তুলে ধরতে চান। কিন্তু এক্ষেত্রে ইসরাইলের সাথে তুরস্কের দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক একটা বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। কারণ অনেক মুসলিম দেশই ইসরাইলের সাথে তুরস্কের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে ভালো চোখে দেখেনা। এর কারণ হচ্ছেছ ফিলিস্তিনিদের উপর দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর নির্মম নির্যাতন ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ড।

সংযুক্ত আরব আমিরাত এই অঞ্চলে তুরস্ককে তার প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করে। কাতারের সাথে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) অন্য দেশগুলোর বিরোধের যে মিমাংসা এ মাসের শুরুর দিকে হয়েছে তাতে কাতারেরই জিত হয়েছে। এক্ষেত্রে তুরস্কের সাথে কাতারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক একটি বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। তুরস্কের কারণেই কাতারকে সাড়ে তিন বছরের অবরোধেও কাবু করতে পারেনি সৌদি আরব ও তার মিত্ররা। অনেকটা বিনা শর্তেই কাতারের সঙ্গে সমঝোতা করতে হয়েছে তাদেরকে। এটিও সৌদি আরব ও আমিরাতের জন্য একটি বড় পরাজয়। আমিরাত সেটারও প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করছে তুরস্ককে কোনঠাসা করার মাধ্যমে।

সম্প্রতি ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদানের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। তুরস্ককে ঠেকাতে তারা এখন ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে। অন্যদিকে লিবিয়ায় জাতিসংঘ সমর্থিত সরকারকে তুরস্ক সমর্থন দেয়ায় আমিরাত সেখানে বিদ্রোহী জেনারেল হাফতারের বাহিনীকে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। মোট কথা যেখানেই তুরস্ক যাচ্ছে, সেখানেই আমিরাত তার প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গালফ ষ্টেট এনালাইটিকস এর সিইও জর্জিও ক্যাফিরো বলেন, ইসরাইলের সাথে আমিরাতের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যই হচ্ছে তুরস্ককে ঠেকানো। কারণ আমিরাত তুরস্ককে বড় হুমকি মনে করছে। সে জন্যই দেশটি ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক করে মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের তুরস্কবিরোধী দেশগুলোর সাথে একটি জোট গঠন করতে চায়। কিন্তু এ কাজটা যে খুব সহজ হবে না তা আমিরাতও খুব ভালো করেই জানে।

আমিরাতের এই তৎপরতা ও বিরাজমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে একজন বাস্তববাদী নেতা হিসেবে এরদোয়ানও ইসরাইলের ব্যাপারে তার দেশের সরকারি অব¯স্থান দ্রুত পুন:নির্ধারণ করেছেন। প্রকাশ্যে ইসরাইলের কঠোর সমালোচনা করা থেকে সরে এসে এখন তিনি দেশটির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিয়েছেন। ইসরাইলও তুরস্কের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ইঙ্গিত দিয়েছে। ইতোমধ্যে ইসরাইলে তাদের নতুন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দিয়েছে তুরস্ক।

পূর্ব-ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে সরবরাহের লক্ষ্যে একটি পাইপলাইন নির্মানে ২০১৬ সালে আলোচনা শুরু করে তুরস্ক ও ইসরাইল। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির কারণে প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা আর অগ্রসর হয়নি। এর পরিবর্তে ইসরাইলের উদ্যোগে ২০১৯ সালে ‘ইষ্টমেড পাইপলাইন’ নামে একটি গ্যাস সরবরাহ ফোরাম গঠন করা হয়। এই পাইপ লাইন নিয়ে এ অঞ্চলের আন্ত:রাষ্ট্র সর্ম্পকের ওপর বড় প্রভাব ফেলছে।

ইসরাইল, মিশর, ফিলিস্তিন, জর্ডান, গ্রীস, গ্রীক সাইপ্রাস প্রশাসন, ইতালী ‘ইষ্টমেড পাইপলাইন’ ফোরামের সদস্য। ইসরাইলের সাথে সম্পর্কের অবনতির কারণে তুরস্ককে বাদ দিয়ে ফোরামটি গঠন করা হয়। এছাড়া ইসরাইলের সুপারিশে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে এই ফোরামের পর্যবেক্ষক মর্যাদা দেয়া হয়। একইসঙ্গে তুরস্কের শত্রু দেশ গ্রীস ও গ্রীক সাইপ্রাসের সাথে গত বছর জুলাই মাসে গ্যাস সরবরাহের চুক্তি নবায়ণ করে ইসরাইল। এতে কিছুটা হলেও চাপের মুখে পড়ে তুরস্ক।

তুরস্ক মনে করে পূর্ব-ভূমধ্য সাগরীয় অঞ্চলের গ্যাস সম্পদ থেকে তুরস্ককে বঞ্চিত করার জন্যই এই ফোরামটি গঠন করা হয়েছে। এ পরিস্থিতিও তুরস্ককে ইসরাইলমুখি করতে বাধ্য করে। এখন তুরস্ক বলছে যে, ২০১৬ সালে নেয়া পরিকল্পনা অনুযায়ী গ্যাস পাইপলাইন নির্মান প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে এর মাধ্যমই দ্রুত ও স্বল্প খরচে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ করা যাবে। কিন্তু ইসরাইল এতে সাড়া দেবে বলে মনে করেন না ইসরাইলের বিশেষজ্ঞরা।

অন্যদিকে তুরস্কও এই অঞ্চলে তার নীতি থেকে সরে আসবেনা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ইস্তাম্বুলের ইয়েদিতেপ বিশ^বিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক মাসুদ কাসিন বলেন, তুরস্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে তার অনুসৃত বর্তমান নীতির কোন পরিবর্তন করবে বলে মনে হয়না। আন্তর্জাতিক আইন ও সমুদ্র আইনের শর্তাবলীর আলোকে তুরস্ক সেখানে তাদের জলসীমায় গ্যাস অনুসন্ধানে তার বৈধ অধিকারের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবে। ফলে ইসরাইল ও তুরস্কের মধ্যে সর্ম্পকে দূরত্ব থেকেই যাবে।