এশিয়ায় তুরস্কের নতুন বন্ধু বাংলাদেশ


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২৪ জানুয়ারি ২০২১, ০৭:৫৪

পাশ্চাত্যের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে তুরস্কের। এ প্রেক্ষাপটে এশিয়ায় বন্ধু বাড়াতে মনোযোগী হয়েছে আঙ্কারা। পাকিস্তানের পর তুরস্ক এখন বাংলাদেশের সঙ্গেও উষ্ণ সম্পর্ক গড়তে চায়। বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করতে আগ্রহী দেশটি।

বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে সম্পর্ক ৮০০ বছরের বেশি পুরনো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আঙ্কারায় বাংলাদেশ দূতাবাস ভবন উদ্বোধনের সময় যথার্থই বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীতে।

আধুনিককালে ১৯৭৪ সালে দুটি দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও ভ্রাতৃপ্রতীম দুই জাতির মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল মধ্যযুগে। সুলতানি আমল, মুগল শাসন, ব্রিটিশ আমল হয়ে এ সম্পর্ক আধুনিক যুগে এসে আরও গভীরতর হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আধুনিক তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধেও এ ভূখণ্ডের মুসলিমরা তাদেরকে সমর্থন দিয়েছে। ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় দুই দেশের মধ্যে যে মিথস্ক্রিয়া ও সাংস্কৃতিক বিনিময় হয়েছে তার ফলে বহুমাত্রিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে ।

তুরস্কের ক্ষমতাসীন একে পার্র্টির শাসনামলে দেশটির অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির প্রভাব বিশে^র প্রতিটি প্রান্তেই পড়েছে। তুরস্ক যে বহুমাত্রিক বিদেশনীতি অনুসরণ করে চলেছে তা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভিন্ন ইস্যুতে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। তুরস্ক সাংস্কৃতিক বিনিময়, অর্থনৈতিক সহযোাগিতা, কূটনৈতিক তৎপরতা, মানবিক সহায়তা এবং পুরনো মিত্রদের পাশে দাঁড়ানোসহ নানাভাবে আন্তর্জাতিক প্রভাব বাড়াচ্ছে।

বসফরাস সেন্টার ফর এশিয়া স্টাডিসের সিনিয়র গবেষক নাজমুল ইসলাম মনে করেন, এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য তুরস্ক ২০১৯ সালে ‘এশিয়া এনিউ’ নামের একটি উদ্যোগ নেয়। এ উদ্যোগের লক্ষ্য বাণিজ্য, সংস্কৃতি, প্রতিরক্ষা ও বিনিয়োগসহ নানা খাতে সম্পর্ক গভীর করা। এই উদ্যোগে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে পারে। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। কৌশলগত গুরুত্ব বাড়ছে বাংলাদেশের। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগ্লু বলেছেন, গতিশীল অর্থনীতি ও তরুণ জনসংখ্যার বাংলাদেশ তুরুস্কও এশিয়া এনিউ উদ্যোগের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার।

মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের মৃত্যুদণ্ডকে কেন্দ্র করে ঢাকা- আঙ্কারা সম্পর্ক শীতল হয়ে পড়ার পর সাম্প্রতিক সময়ে আবার তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের কয়েকদফা সফর বিনিময়ের পর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তায়েপ এরদোয়ানের বাংলাদেশ সফরের পথও সুগম হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেছেন, এদেশ তুরস্কের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য একটি চমৎকার বাজার হতে পারে। কারণ এশিয়ার দুটি বড়শক্তি চীন ও ভারতের পাশে কৌশলগত অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। মুসলিম উম্মাহর মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ বিশ^ গড়া দুই দেশের অভিন্ন লক্ষ্য।

বাংলাদেশের লক্ষ্য তুরস্কের বিনিয়োগ আকর্ষণ করা। দুই দেশের বার্ষিক বাণিজ্য প্রায় ১০০ কোটি ডলারে উপনীত হয়েছে। এটাকে ২০ থেকে ৩০ কোটি উন্নীত করতে চায় তুরস্ক। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশ তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। বাংলাদেশের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি বা পিটিএ করতে চায় তুরস্ক।

তুরস্ক তার সফ্ট পাওয়ার যেমন দিরিলিস আরতুগ্রুলের মত টিভি সিরিয়াল এবং তুর্কি গণমাধ্যমের মাধ্যমেও বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে চায়।

গবেষক নাজমুল ইসলাম মনে করেন , তুরস্ক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা খাতে যে উৎকর্ষ সাধন করেছে তারও অংশীদার করতে চায় বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের বড় সমস্যা রোহিঙ্গা সংকটে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যে ভূমিকা রেখেছেন তা অতুলনীয়। বাংলাদেশিরা দেখছেন যে সংকটে বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুদেশ ভারত ও চীন মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আর তুরস্ক দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক সব ফোরামে রাহিঙ্গা ইস্যুকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছে।

তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিনি এরদোয়ান কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে পশ্চিমা গণমাধ্যমে মর্মস্পশী নিবন্ধ লিখে বিশে^র মনযোগ আকর্ষণ করেছেন। তুরস্কের বহু দাতব্য সংস্থা রোহিঙ্গাদেও পাশে আছে বিরতিহীনভাবে।

তুরস্ক ও বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি আঙ্কারায় ঢাকা এবং ঢাকায় আঙ্কারা নতুন দূতাবাস ভবন তৈরি করেছে। ডিসেম্বরের শেষ দিকে ঢাকায় তুর্কি দূতাবাস উদ্বোধনের সময় এক ভিডিও বার্তায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ঢাকায় তুরস্কের দূতাবাস উদ্বোধন বিশেষ অর্থপূূর্ণ। তিনি বলেছেন, নতুন দূতাবাস উদ্বোধন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তুরস্কের গুরুত্ব দেওয়ার পরিচয় বহন করছে। আমরা এমন একটা কাঠামো চেয়েছি, যা শুধু তুরস্কেরই হবে না, বাংলাদেশেরও হবে।

এরদোয়ান দুই দেশের ক্রমবর্ধমান সম্পর্কের প্রশংসা করে তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালি মুসলমানদের অবদানের কথাও স্মরণ করেন। এরদোয়ান রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেন এবং বলেন, তাদের এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে রোহিঙ্গারা গণহত্যা থেকে বেঁচে গেছেন। তুরস্ক মানবিক সহায়তা নিয়ে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে জানান এরদোয়ান।

গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সফরে এসে তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সামরিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা চায় তার দেশ। তুরস্ক যৌথ উৎপাদন ও প্রযুক্তি হস্তান্তরেও রাজি। আমরা সবকিছু তৈরি করি না। কিন্তু আমরা আমাদের চাহিদার ৭০ শতাংশের বেশি উৎপাদন করি। অতীতে পরাশক্তির কাছ থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কিনতে গিয়ে আমরা নানা সমস্যায় পড়েছি। এ কারণে পরে আমরা নিজেরাই উৎপাদন করতে শুরু করি এবং এ খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করি। মিত্র ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা এবং প্রযুক্তি বিনিময়ও করেছি। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গেও যৌথ উৎপাদন ও প্রযুক্তি বিনিময়ে তুরস্ক রাজি আছে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, প্রযুক্তি হস্তান্তরে তুরস্কের এই আগ্রহ বিরল ঘটনা। কোনো দেশই সাধারণত এটা চায় না। তুরস্ক যে সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সহযোগী হতে চায় এটা তারই প্রমাণ। সামরিক বিশেষজ্ঞরাও একে সাধুবাদ জানিয়েছেন।

ইউরেশিয়া টাইমসের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, তুরস্ক ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে কিছু সম্পর্ক ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ তুরস্কের কাছ থেকে হালকা সাজোয়াঁ যান কিনেছিল। এরপর ২০১৭ সালে ৬৮০টি হালকা সাজোয়াঁ যান কেনে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ৩হাজার সেনা কর্মকর্তা এখন পর্যন্ত তুরস্কে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্ক প্রতিরক্ষা শিল্পে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি লাভ করেছে। মাত্র দু'দশক আগে ১৯৯৯ সালেও তুরস্ক ছিলো বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্র আমদানীকারক দেশ, আর সেই দেশটিই ২০১৮ সালে এসে বিশ্বের ১৪তম বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে।

২০১৮ সালে প্রথমবারের দেশটি ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের প্রতিরক্ষা সামগ্রী রপ্তানি করতে সক্ষম হয।এরপর তুরস্ক ২০১৯-২৩ সাল সময়ের জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা করে, যাতে ২০২৩ সাল নাগাদ প্রতিরক্ষাসামগ্রীর রপ্তানি এক হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করার কথা বলা হয়। একই সাথে, চাহিদার ৭৫ ভাগ দেশেই উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।

গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ডিফেন্স নিউজ ম্যাগাজিন তাদের শীর্ষ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনকারীর তালিকায় স্থান দিয়েছে তুরস্কের সাতটি প্রতিষ্ঠানকে। সুইডেন-ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউট বা সিপরির তথ্য অনুযায়ী, সামরিক খাতে তুরস্ক ২০১৯ সালে ব্যয় করেছে দই হাজার কোটি ডলারের বেশি।

সামরিক বিশ্লেষক এবং বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট ফর পিস অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান বিবিসিকে বলেন, তুরস্কের ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রি একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্পখাত। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর দরকার এমন সব কিছুই তারা এখন তৈরি করে। বাংলাদেশ আগেও সমরাস্ত্র আমদানি করেছে তাদের কাছ থেকে। তাদের প্রযুক্তিও আধুনিক।

তিনি জানান, স্থল বাহিনীর জন্য ট্যাংক, কামান-সহ যুদ্ধাস্ত্র, আর্টিলারি ইকুইপমেন্ট, গোয়েন্দা কার্যক্রম বা নজরদারিতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান থেকে শুরু করে সব কিছু এবং নৌ বাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে সব কিছুই এখন তুরস্ক তৈরি করছে।

এখন সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে তুরস্কের বানানো ড্রোন নিয়ে। দেশটির চারটি কোম্পানি ড্রোন উৎপাদন করে থাকে। এগুলোর মধ্যে মেশিনগান এবং গ্রেনেড বহনকারী ড্রোনও রয়েছে।নিজস্ব ড্রোনের মাধ্যমে সিরিয়া ও লিবিয়ায়যুদ্ধে বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছে তুরস্ক।

আজারবাইজান সাম্প্রতিক যুদ্ধে আরমেনিয়ার বিরুদ্ধে তুরস্কের তৈরি ড্রোন ব্যবহার করে ব্যাপক সাফল্য পায়। এছাড়া, নিজস্ব স্যাটেলাইট এবং ভালো মানের রাডার আছে তুরস্কের। এখন তারা ক্রুজ মিসাইল তৈরির কাজ করছে। এর পাশাপাশি নৌ বাহিনীর জন্য তারা যেসব যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরি করছে তার মধ্যে রয়েছে অ্যান্টি শিপ মিসাইল, লাইটওয়েট টর্পেডো এবং সোনার সিস্টেম। তারা আন্ডারওয়াটার অ্যাটাক ড্রোন তৈরি নিয়েও কাজ করছে। একই সাথে যুদ্ধজাহাজের ইঞ্জিন তৈরি করা শুরু করেছে দু'বছর আগে।

মুনীরুজ্জামান বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেবল অস্ত্র নয়, বরং অস্ত্র কেনার পর দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষুদ্রাংশ সরবরাহ এবং ব্যাকআপ সার্ভিস দিতে পারে তুরস্ক। এছাড়া, সামরিক কোনো বিষয়ে প্রশিক্ষণের দরকার হলে, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রেও তুরস্কের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে।